আগের পর্ব
নেশার খোয়ারি কাটতে পাক্কা দুটো দিন। এই দু'দিন আমি কোনরকমে মঞ্জুর ভেন্টিলেটারে গা ঢাকা দিয়েছিলাম। অচেনা বিছানায় যেমন শুয়ে ভালো ঘুম হয় না, এও তেমন। কিন্তু কী করব, উপায় নেই। পুরো নেশা না কাটলে যাই কী করে। শেষে যদি পড়ে আবার হাত-পা ভাঙি, তাহলে ভূতের চেহারাও যে পালটে যাবে!
ভোরবেলা মঞ্জু সেই যে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়েছে, আর ফ্ল্যাটে ঢোকেনি। ঢুকবেও না। আর কিছু না হোক, প্রাণের ভয় সকলেরই আছে। কে আর ইচ্ছে করে ভূতের হাতে প্রাণ দেয়।
তিনদিনের দিন, আমি আবার আমার ঘুলঘুলিতে ফিরে এলাম। দেখি, এই দু'দিনেই আমার ঘরের চেহারা পালটে গিয়েছে। জানলায় নতুন পর্দা হয়েছে। বিছানায় কটকি চাদর পাতা। বালিশে বালিশে নতুন চাদর দেওয়া ওয়াড় পরিয়েছে সুধা। ঘরে ঝুল নেই, মাকড়শা নেই, এমনকি সেই লেজকাটা টিকটিকিটাও নেই। আমার ফটোয় একটা ফুলের মালা ঝুলছে। পঞ্চমুখী ধূপদানিতে ধূপ।
ব্যাপার কী? হল কী? আজ যে আমার খাতির। তাহলে কি পেনশন আর গ্রাচুইটির টাকাটা পেল সুধা! এতদিনে পাওয়া উচিৎ। ছ'মাস হতে চলল, তাই হবে হয়তো। আমি নিচে নেমে আমার ফটোর মালা দুলিয়ে দিয়ে বললাম, কি দেবু মিত্তির, কেমন লাগছে? আজ যে বরবেশ। বাহ! বেশ আছ, তোফা। জ্যান্ত শালা কোনদিন তোমার কপালে ফুলের মালা জুটল না, চিরকাল গালাগাল হজম করলে, আজ মরে সুরতখানা বেশ খোলতাই করেছ। বেঁচে থাক বাবা, সুখে আনন্দে বেঁচে থাক। আমি শালা মরে ভূত হয়েছি, আমি এখন খাবি খাই।
ঘরের তালা খোলার আওয়াজ হল। আমি তড়াক করে লাফ মেরে আমার ঘুলঘুলিতে উঠে এলাম। ঘরে সুধা ঢুকল। সঙ্গে একজন দশাসই পুরুষ। ছ'ফুটের ওপর লম্বা। মাথায় মিলিটারি ছাঁট ছাঁটা। হাতের গুলিগুলো গা-চাপা জামা ফুঁড়ে ফুলে ফুলে উঠছে। পায়ে নতুন কেনা শু মসমস করছিল। কোমরের বেল্টে চকচকে রিভলবার।
আমি তাজ্জব হয়ে তাকিয়েছিলাম। এ মালকে তো কোনদিন দেখিনি। এ কে বাবা! সুধা হাসতে হাসতে বলল, উফ! আর পারি না রজতদা। সারা ট্যাক্সিতে তুমি এমন হাসিয়ে মেরেছ যে, এখনও আমার কুলকুল করে হাসি পাচ্ছে।
রজত বলল, হাসাব না! এসে দেখি, তুই মুখখানাকে ভিমরুলের চাকের মত করে বসে আছিস সুধা। তোর জীবনে যেন কোন সুখ নেই, শান্তি নেই, আনন্দ নেই। আরে মানুষ তো মরবেই। তোর বর মরেছে বলে তুই যেমন ভেঙে পড়েছিস, এমন আমি কাউকে দেখিনি। ঘরদোরের কী ছিরি করে রেখেছিলি বল। এই দু'দিনে তবু একটু মানুষের মত দেখাচ্ছে। বুঝলি, তোকে আমি এখানে রাখব না, আমার সঙ্গে দেরাদুন নিয়ে যাব।
সুধা আঙুলে শাড়ির খুঁট জড়াতে জড়াতে বলল, যাহ্! তাই কি হয় নাকি! তুমি কী যে বল।
রজত বলল, আমি ঠিক বলিরে। তোর মামাত ভাই সনৎ যেদিন তোর কথা আমাকে বলেছে, সেদিন থেকেই আমার মন বলছে, তোর একটা কিছু হিল্লে করা দরকার। এরকম একটা ভূতের জীবনে কি মানুষ বাঁচতে পারে। হাতের ক'টা টাকা, সেগুলো যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন কী করবি। আরে জীবন অনেক বড়, আর তোর কী বয়স বল। আমি তোর বিয়ে দেবই দেব। আর যদি দিতে না পারি, তাহলে আমিই করব। আমি তো কনফার্মড ব্যাচেলর। একজন আইবুড়োকে মালা দিতে নিশ্চয়ই তোর আপত্তি হবে না।
কথাগুলো শেষ করেই রজত হো হো করে হেসে উঠল। হাসির শব্দ শুনে আমার মনে হল, আরে এ ব্যাটা শোলের সেই আমজাদ। হাসে না তো যেন জয়ঢাক, বুকে ঘুষি মারে।
আমি মনে মনে বললা, বাহ্! বেশ ব্যবস্থা। সুধার দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে। তা তুমি কে বাবা! বেঁচে থাকতে তো তোমাকে কোনদিন দেখিনি। আইডেন্টিটিও জানিনা। একবার ভাল করে ঝুলি ঝাড়, তোমাকে পরখ করে নিই।
সুধা রজতের কথা শুনে কি-সব ভাবছিল। এসময়ে সুধা বলল, আমি আরেকটু ভাবি, কী বল। একেবারে এত বড় একটা লাফ মারব!
রজত বলল, নিশ্চয়ই ভাববি। একশোবার ভাববি। ভাবনাচিন্তা না করে ভূতে কাজ করে, মানুষ করে না। মানুষের কাজ হল, যাহা করিবে তাহা ভাবিয়া করিও।
ভূতের উল্লেখে সুধার বোধ হয় আমার কথা মনে পড়ল। সুধা আমার ফটোর দিকে তাকিয়ে বলল, রজতদা তুমি ভূতে বিশ্বাস কর?
রজত আবার সেই হাড়কাঁপানো হাসি হেসে বলল, ভূত? ভূত তো মনে। ভূতে বিশ্বাস করতে হলে তোর রজতদাকে আর বাঁচতে হত না। কত মিলিটারি অ্যাকশন করেছি, কত মানুষ মেরেছি। তারা যদি সব মরে ভূত হয়ে তেড়েফুঁড়ে আসত, তাহলে কি আর বাঁচতাম। কবেই অক্কা পেতাম।
সুধা চোখ বড় বড় করল। তুমি ভূতে বিশ্বাস কর না! কিন্তু আমি তোমাকে ভূত দেখাতে পারি। আমার হাতেই একটা পোষা ভূত আছে। তাকে আমি যা বলি, তাই সে করে। ডাকব, দেখবে?
রজত ইজিচেয়ারে নিজেকে আরো ছড়িয়ে বসল। তারপর হাসি গলায় বলল, কিরে, ছিকলিটিকলি বেঁধে রেখেছিস, না আবার বাঁদরের মত খাবলে কামড়ে দেবে? তারপর দরাজ গলায় হেসে বলল, যা ডাক। দেখি একবার তোর ভূতবাবুকে...
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



