somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তখন আমার বয়স ছিল ছাব্বিশ (একটি গল্প)

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


যেবার আমি মারা যাই; তখন আমার বয়স ছিল ছাব্বিশ। সেবার বসন্ত তখনো আসেনি। যে চাকরিটা তখন করতাম সেটা মাত্র দুই বছর আগেই পেয়েছি।

আমি ঘরের বড় ছেলে। বড় বোনটার বিয়ে হয়েছিল। ভাইটা ইন্টারে পড়ত।


চাকরির প্রথম বেতনের টাকাটা দিয়ে পরিবারের সবাইকে কিছুনা কিছু কিনে দিয়েছিলাম। মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য পাঞ্জাবি, ছোট ভাইটার জন্য শার্ট আর প্যান্ট।

ঘরের জন্য একটা ফোনও কিনেছিলাম। আর আপার জন্য একটা ভাল দেখে শাড়ী পাঠিয়েছিলাম।

তবে আমার জন্য আমি কিছু কিনি নি।


আমার একটা অসুখ ছিলো। কেউ জানত না। আমিও জেনেছি কিছুদিন আগে।

ছোটকাল থেকে আমার মাথা মাঝে মাঝে প্রচন্ড রকমের ব্যাথা করত। মাইগ্রেনের ওষুধ খেয়ে ব্যাথাটাকে কোনোরকমে দমিয়ে রাখতাম। একদিন সবার সাথে ক্লাস করছিলাম। সেদিনও সকাল থেকে মাথাটা ব্যাথা করছিল। চোখে আগে থেকে দেখতাম কম। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল। ব্যাথা সহ্যের লিমিট ক্রস করে। আমি ক্লাসেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি।


বন্ধুরা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিলো। হুঁশ ফিরলো। ডাক্তার আমাকে কয়েকটা পরীক্ষা করাতে বললেন। করালাম। সেখানে ধরা পড়লো আমার ব্রেনে টিউমার জন্মেছে।


অসুখের খবর আমি কাউকে জানায়নি। বুঝলাম আমি আর বেশিদিন বাঁচবোনা। সর্বোচ্চ হলে কয়েক বছর হয়তো। চিকিত্‍সা সম্ভব না।


তারপর থেকে পড়ালেখা ছেড়ে দিই। পরিবারের জন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাইটার নামে একটা একাউন্ট খুলে সেখানে টাকা জমাতাম। কারন আমার পরে পরিবারের দায়িত্বটা ভাইটাকেই নিতে হবে।


চাকুরি করতেছি। দুই বছর হয়ে গেল। মাথা ব্যাথার অনেকগুলো ওষুধ পকেটে পকেটে নিয়ে ঘুরি। চোখের গ্লাসটাও অনেক পাওয়ারের এখন।


সে সময়ের প্রতিটা রাত্র যেত আমার কেঁদে কেঁদে। কাউকে কিছু বলতাম না। বলেইবা লাভ কি? ডায়েরিতেও কিছু লিখতামনা। রাত্রে উঠে নামাজ পড়ে পড়ে কাঁদতাম। মৃত্যুর প্রহর গুনতাম।


এরই মাঝে মা একদিন বললেন: হাসেম, অনেক তো হয়েছে। এবার একটা বিয়ে করে ফেলনা বাপ। নাতি নাতনির মুখ দেখাবিনা আমাদের?


মায়ের কথাটা আজো আমার কানে বাজে। আমি মাকে না বললাম। বললাম, আরো পরে করবো মা। কিন্তু মা নাছোড়বান্দা। বললেন, আমি তোর কোনো কথাই শুনবো না। আমি মেয়ে দেখছি।


মায়ের কথার উপরে কখনো কোনোদিন কথা বলিনি। মা আমাকে খুব ভালবাসেন। মাকে বললাম: দেখ মা, তোমার এই রোগা শুকনা ছেলের সাথে কে তার মেয়েকে বিয়ে দিবে? তার চেয়ে বরং আগে কিছুটা স্বাস্থ্য হোক, তারপর নাহয় বিয়েটা করব।


কিন্তু মা অনড়। আমাকে বলে কি জানেন! বলে: আরে বাপ, স্বাস্থ্য দেখবি বিয়ের পরেই হয়ে যাবে। আমি তোর আর কোনো কথা শুনবোনা। আমি মেয়ে দেখার ব্যাবস্থা করছি।



মা একটা মেয়েকে তার ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করেছেন। মেয়েটা অনেক ভালো, সুন্দরও কম না। আমি মেয়েটাকে দুইবার মাত্র দেখেছিলাম। চেয়ে তাকিয়ে থাকার মত রুপ ছিলো তার। চিবুকের বাঁ পাশে তার একটা ছোট্ট তিল ছিল।

আমি তার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম।


ঐ সময়টায় আমি খুব হতাশ হয়ে পড়ি। আমার কারণে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এটা আমি কখনো চাইতামনা। আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থনা করতাম, যেন আমি বিয়ের আগে আগেই মারা যাই।

আমি জানি এ ধরনের দোয়া করা নিষেধ। কিন্তু স্রষ্টার কাছে আমার আর কিইবা চাওয়ার আছে!


বাবা মা বিয়ের দিনতারিখ সব ঠিকঠাক করে ফেললেন।

সেকেন্ডগুলোকে তখন আমার নিকট বছরের মত মনে হত। প্রতিদিন ভাবতাম, ঘুম থেকে যদি আর জেগে উঠতে না পারি তাহলে কতইনা ভাল হয়! কিন্তু আশাটা কখনো ফলেনি।


বিয়ের সময়টা ক্রমশ ঘনিয়ে আসতে লাগল। আমার উদ্বিগ্নতাও বাড়ছে।

বিয়ের তিনদিন আগে মা বললেন শহর থেকে নতুন বৌর জন্য যা যা লাগে তা কিনে আনতে।

যাবার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিলনা। কিন্তু যেতেই হলো। উপায় ছিলনা আর...


কিছুদূর রিস্কা করে পরে একটা লোকাল বাসে উঠলাম শহরে যাবার উদ্দেশ্যে।

মনের মধ্যে কিছু সাংসারিক দৃশ্য ভেসে উঠছিল।

অবচেতন মনকে তো আর বাঁধা দেওয়া যায়না। তবুও মনটাকে সেখান হতে ঘুরাতে চেষ্টা করলাম।


বাসে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়। ক্রমশ বাড়ছিল ব্যাথাটা।এসময়টায় খুব খারাপ লাগে। চিত্‍কার করে কাঁদতে মনে চায়



অনেক কোলাহলে আমার চেতন ফিরে আসল। ঘুমে ছিলাম নাকি অজ্ঞান ছিলাম মাথায় কাজ করলনা। নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম। প্রথমে কিছুই বুঝিনি। পরে বুঝতে পারলাম, যে বাসে করে যাচ্ছিলাম সেটা এক্সিডেন্ট করেছিল। কয়েকজন মারাও গেছে, অনেকে মারাত্মক আহত হয়েছে। আমি মাথায় আর কাঁধে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলাম। ব্যান্ডেজ লাগানো ছিল এসবে।


এক্সিডেন্টে এত মানুষের সাথে আমিও মারা গেলে অন্তত কিছুটা শান্তি পেতাম। কিন্তু বিধি বাম।

আমার মরণের দরকার ছিল, ওদেরনা। অথচ আমি মরিনি।

খোদার উপর রাগ হচ্ছিল তখন খুব।


হঠাত্‍ মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। ভাবলাম, আমি হারিয়ে যাব। আর সবাই ভেবে নিবে আমিও মারা গেছি।


পকেটে যে কয়টা টাকা ছিল তা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি অজানার উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য আর বাড়িতে ফিরবনা। মৃত হয়ে যাব ।



আজ এগার বছর। আমি নিজের নাম চেঞ্জ করেছি, নিজেকেও চেঞ্জ করে ফেলেছি। কেউ এখন আমাকে চিনেনা। এমনকি মাও না।

গ্রামে গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। সত্যিই কেউ চিনেনি।

বাবা মারা গেছেন। মা এখনো জীবিত আছেন। একেবারে বৃদ্ধা হয়ে গেছেন।

ভাইটা একটা সরকারি চাকরি করে। বিয়ে করেছে। পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে তার। কোলে নিয়েছিলাম। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলতে চেয়েও বলেনি। বেশিক্ষন কোলে রাখিনি, চলে এসেছি।


হেনারও খোঁজ নিয়েছিলাম। আপনাদেরকে বলিনি, যার সাথে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল ওই মেয়েটার নাম ছিল হেনা।

আমার মৃত্যুর খবর শুনে মেয়েটা নাকি খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। খুব কষ্ট পেয়েছিল সে। ভালবেসেছিল হয়তো আমাকে।

শুনেছি আর নাকি বিয়ে না করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে তার পিতামাতার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছিল। এখন বেশ সুখে আছে।

তবে মনের খবরটা আমি জানিনা।

একটা মেয়ে আর একটা ছেলে আছে এখন হেনার সংসারে।


আমার বয়স এখন সাতত্রিশ। আমি মারা গিয়েছিলাম এগার বছর আগে। যেবার আমার বয়স ছিল ছাব্বিশ। সেবার বসন্ত তখনো আসেনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২৩
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×