‘ধ্যাত! নচিকেতা কারো নাম হয় নাকি? এই ব্যাটা নিশ্চয়ই নিজের নাম নিজে রেখেছে!’
আমার অবিশ্বাসে আরো ঘি ঢেলে দিলেন টুট্টু মামা। ‘নচিকেতা’ উল্টালে কি হয় দেখছো ভাইগনা? ‘তাকেচিন’।
এরপর আমার আর সন্দেহ রইলো না যে লোকটা নিজের নাম পাল্টেছে। মনে মনে বললাম, ‘ফাউল!’
ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৯৩:
ভুট্টুমামার এক বন্ধু কোলকাতা থেকে কিছু গানের ক্যাসেট পাঠিয়েছে। ক্যাসেটগুলোর নাম এবং শিল্পীরা সবাই উদ্ভট।
১. এই বেশ ভালো আছি-নচিকেতা (অনুভূতিঃ আপনে ভালো থাকলে আমার কি? রাস্ট্র কইরা বেড়ান!)
২. তোমাকে চাই-সুমন (অনুভূতিঃ বুইড়া ধামড়া ব্যাটা, নাম আবার সুমন; আবার হেতেরে চায়। ভীমরতি!)
৩. ঝরা সময়ের গান-মহীনের ঘোড়াগুলি (অনুভূতিঃ এইটা নাকি আবার ব্যাণ্ড! ঘোড়ার ডিমের ব্যাণ্ড! এরা কি সোলস, মাইলস চিনে? আইয়ুব বাচ্চুর নাম জানে?)
যাইহোক, নচিব্যাটার ক্যাসেটের প্রচ্ছদটা পছন্দ হলো খুব। ডাস্টবিনের পাশে বসে দাঁত কেলিয়ে বসে আছে। শার্টের বুক খোলা, রাফ এণ্ড টাফ! প্রচ্ছদের উল্টো পিঠে শিল্পী পরিচিতির যায়গায় লিখা, ‘এই সময়ে একগাল দাঁড়ি, মুখে একরাশ হাসি, আর বুক ভরা জ্বালা নিয়ে কোথা থেকে এসেই সে চিৎকার করে গাইতে শুরু করলেন-‘এই বেশ ভালো আছি’। এই বলে তিনি বোঝাতে চাইছেন-আসলে আমরা কেউ ভালো নেই।‘
ব্যাপারটা পছন্দ হলো। গান গুলো শুনতে শুরু করলাম। তখন ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝিনি যে পরের দেড়যুগ আমার কেটে যাবে অসম্ভব প্রতিভাবান এই শিল্পীর গান শুনে শুনে।
শুনতে শুনতে গানগুলো মুখস্ত হয়ে গেলো। সেই সদ্য শৈশব পেরুনো বয়সে প্রিয় গানের তালিকায় ছিলো ‘এই বেশ ভালো আছি, বুড়ো ভাম, মন দিয়ে লেখাপড়া, শুনবোনা গান। আড্ডায় আসরে খুব জমে উঠলো গানগুলো, কারণ মফস্বলে তখনো প্রতিবাদ ভিত্তিক গান খুব একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। আর গানের কথাও যে এমন আটপৌঢ়ে হতে পারে-সে সম্পর্কেও ধারণা ছিলো না তেমন। আমার কাছ থেকে ক্যাসেট নিয়ে দোকান থেকে কপি করে নেয়ার হিড়িক পড়ে গেলো। মনে আছে, বহুবার রাস্তায় যেতে যেতে দেখেছি, দোকানে ভীড় করে লোকজন শুনছে ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’, ‘নীলাঞ্জনা’। ততদিনে নচি’র গানের শব্দ চয়নের ভক্ত হয়ে গেছি।
মফস্বলে নচি’র এ্যালবাম পাওয়া কঠিন হয়ে যেতো। দু’একটা যাও পাওয়া যেতো, রেকর্ডিং এর অবস্থা এতো বাজে, যে শোনা যেতো না। সে সময় একদিন স্কুল পালিয়ে ঢাকায় এলাম একা একা। পকেটে অনেক দিন ধরে জমানো ছয়’শো টাকা। মালিবাগে এক আত্মীয় থাকাতে তখন ঢাকার মার্কেট বলতে চিনি একটাই-মৌচাক মার্কেট। স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে রাস্তা মনে করে মৌচাক মার্কেটে চলে এলাম। তখন মার্কেটের পেছনে আরেকটা মার্কেট ছিলো, নামটা সম্ভবত আনারকলি মার্কেট। সেখানে পেলাম বহু আকাঙ্খিত নচি’র পরবর্তী দু’টি এ্যালবাম ‘কে যায়’ ও ‘কি হবে’ এর মাস্টার প্রিন্ট। সেই যুগে ঢাকা টাংগাইলের গাড়ি ভাড়া ছিলো ৩০ টাকা, আর ক্যাসেটের দাম ১২০ টাকা। যাই হোক, পকেটে পর্যাপ্ত টাকা থাকায় ক্যাসেট দুটো কিনে ফেললাম। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বলে কপালে কি দুর্গতি হয়েছিলো, তা আর নাইবা বললাম। আমি আর আমার বন্ধু অনুপম বসে বসে গান শুনতামঃ ‘অনির্বাণ, একদিন ঝড় থেমে যাবে, বারো টাকা, স্বাধীনতা, সকাল থেকে লুকোচুরি, কালো মেয়ে, নীলাঞ্জনা-২, ৩, দুনিয়ার প্রেমিক এক হও, একা একা পথচলা...আরো কতো গান!
মফস্বলে নচিকেতা জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে ‘চল যাব তোকে নিয়ে’ রিলিজ হবার পর। তারপর ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার কল্যাণে নচি’র জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি হয়ে ওঠে। এলাকার প্রথম শ্রোতা হিসেবে তখন খুব গর্ব হতো। এমনকি, পত্রিকায় নচি’কে নিয়ে কোন লেখা বের হলে বন্ধুরা নিজ দায়িত্বে তার কপি দিয়ে যেতো বাসায়।
সদ্য কৈশোর পেরুনো বয়সের যে ভাংচুর মনোভাব, সেখানে নচিকেতার গান মনের ভেতর একটা পরিবর্তন এনে দিয়েছিলো। একই সাথে বিদ্রোহ আর প্রেম কিংবা বিনয় আর স্পষ্টবাদিতা যে সহাবস্থান করতে পারে-তা শিখেছি নচি’র গান থেকেই। সেসময়ে আমাদের জীবনানন্দ পড়া শুরু, শচীন দেব এবং ভূপেনের গান শোনার শুরু। আমরা নচিকেতার যে কয়েকজন চূরভক্ত ছিলাম, তারা নিজেদের অনির্বাণ ভেবে গ্রামের রাস্তা ধরে মাইলের পর মাইল চষে বেড়াতাম, চা খেতে থামতাম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত কোন চায়ের দোকানে। খুঁজে ফিরতাম, হয়তো কোন এক চুরি যাওয়া আলোয় কোন একজন বিখ্যাত লোক গাড়ি থামিয়ে জিগ্যেস করবে, ‘অনির্বাণ, কি করছিস এখন?’ সে সময়ে লোকে আমাদের দলছুট বলতো, কারণ, অন্যদের ভাবনার সাথে কোথায় যেনো আমাদের মিলতো না। মনে মনে খুঁজতাম নিজের প্রেমিকাকে নয়, নীলাঞ্জনাকে। লোকটার শব্দ চয়ন আর গানের ভেতর প্রবচনের নির্ভুল প্রয়োগ আমাদের অবাক করতো। নিজেরা সংগীত বিদ্যালয়ে যাতায়াতের দরূণ তার শাস্ত্রীয় সংগীতে অগাধ জ্ঞান আবিষ্কারের পর চমকে উঠে ভেবেছিলাম, এই মানুষটা প্রথা ভাঙতে জানেন। এবং তিনি ভেঙ্গেছেন। সেই সাতটা সুরে, সেই বাংলা বর্ণমালাতেই তিনি লিখে চলেছেন, অথচ গানগুলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। উঠে এসেছে নীলাঞ্জনা, অনির্বাণ, রাজশ্রী, পৌলমী, শতাব্দী, সলোমন সহ আরো অনেক চরিত্ররা-যারা আমাদের আশেপাশের চেয়ে আলাদা কেউ নন।
নচিকেতা এমন একজন মানুষ-যিনি কয়েকটি কিশোরের ভাবনা, রুচি এবং শিল্পবোধ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। নিজেদের সীমার বাইরে নিজেদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন। 'হাজার লোকের ভীড়ে তবুও তবুও একা' হতে শিখিয়েছিলেন। তারুণ্য যে বিশেষণ নয়, শক্তি-তা শিখিয়েছিলেন তিনি।
আরেকটা বিষয়ে অবাক হতাম, নচি’র প্রথম এ্যালবাম থেকে নিয়ে ‘এই আগুনে হাত রাখো’ এ্যালবাম পর্যন্ত সবক’টি গানই একসময় আমার মুখস্ত ছিলো এবং এসব এ্যালবামের কোনটিতেই তিনি ‘কষ্ট’ শব্দটা ব্যবহার করেন নি। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের এই একটি মাত্র বহুল প্রচলিত শব্দের প্রতি তাঁর অনীহাটা কেন-তা জানতে ইচ্ছে করে খুব।
নচিকেতাঃ গানের ফেরিওয়ালা, আমি এবং কয়েকটি কিশোর
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩৬টি মন্তব্য ৩৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
মিশন: কাঁসার থালা–বাটি
বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।