somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নচিকেতাঃ গানের ফেরিওয়ালা, আমি এবং কয়েকটি কিশোর

২৭ শে জুলাই, ২০১২ রাত ৯:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ধ্যাত! নচিকেতা কারো নাম হয় নাকি? এই ব্যাটা নিশ্চয়ই নিজের নাম নিজে রেখেছে!’
আমার অবিশ্বাসে আরো ঘি ঢেলে দিলেন টুট্টু মামা। ‘নচিকেতা’ উল্টালে কি হয় দেখছো ভাইগনা? ‘তাকেচিন’।
এরপর আমার আর সন্দেহ রইলো না যে লোকটা নিজের নাম পাল্টেছে। মনে মনে বললাম, ‘ফাউল!’

ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৯৩:
ভুট্টুমামার এক বন্ধু কোলকাতা থেকে কিছু গানের ক্যাসেট পাঠিয়েছে। ক্যাসেটগুলোর নাম এবং শিল্পীরা সবাই উদ্ভট।
১. এই বেশ ভালো আছি-নচিকেতা (অনুভূতিঃ আপনে ভালো থাকলে আমার কি? রাস্ট্র কইরা বেড়ান!)
২. তোমাকে চাই-সুমন (অনুভূতিঃ বুইড়া ধামড়া ব্যাটা, নাম আবার সুমন; আবার হেতেরে চায়। ভীমরতি!)
৩. ঝরা সময়ের গান-মহীনের ঘোড়াগুলি (অনুভূতিঃ এইটা নাকি আবার ব্যাণ্ড! ঘোড়ার ডিমের ব্যাণ্ড! এরা কি সোলস, মাইলস চিনে? আইয়ুব বাচ্চুর নাম জানে?)
যাইহোক, নচিব্যাটার ক্যাসেটের প্রচ্ছদটা পছন্দ হলো খুব। ডাস্টবিনের পাশে বসে দাঁত কেলিয়ে বসে আছে। শার্টের বুক খোলা, রাফ এণ্ড টাফ! প্রচ্ছদের উল্টো পিঠে শিল্পী পরিচিতির যায়গায় লিখা, ‘এই সময়ে একগাল দাঁড়ি, মুখে একরাশ হাসি, আর বুক ভরা জ্বালা নিয়ে কোথা থেকে এসেই সে চিৎকার করে গাইতে শুরু করলেন-‘এই বেশ ভালো আছি’। এই বলে তিনি বোঝাতে চাইছেন-আসলে আমরা কেউ ভালো নেই।‘
ব্যাপারটা পছন্দ হলো। গান গুলো শুনতে শুরু করলাম। তখন ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝিনি যে পরের দেড়যুগ আমার কেটে যাবে অসম্ভব প্রতিভাবান এই শিল্পীর গান শুনে শুনে।


শুনতে শুনতে গানগুলো মুখস্ত হয়ে গেলো। সেই সদ্য শৈশব পেরুনো বয়সে প্রিয় গানের তালিকায় ছিলো ‘এই বেশ ভালো আছি, বুড়ো ভাম, মন দিয়ে লেখাপড়া, শুনবোনা গান। আড্ডায় আসরে খুব জমে উঠলো গানগুলো, কারণ মফস্বলে তখনো প্রতিবাদ ভিত্তিক গান খুব একটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। আর গানের কথাও যে এমন আটপৌঢ়ে হতে পারে-সে সম্পর্কেও ধারণা ছিলো না তেমন। আমার কাছ থেকে ক্যাসেট নিয়ে দোকান থেকে কপি করে নেয়ার হিড়িক পড়ে গেলো। মনে আছে, বহুবার রাস্তায় যেতে যেতে দেখেছি, দোকানে ভীড় করে লোকজন শুনছে ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’, ‘নীলাঞ্জনা’। ততদিনে নচি’র গানের শব্দ চয়নের ভক্ত হয়ে গেছি।
মফস্বলে নচি’র এ্যালবাম পাওয়া কঠিন হয়ে যেতো। দু’একটা যাও পাওয়া যেতো, রেকর্ডিং এর অবস্থা এতো বাজে, যে শোনা যেতো না। সে সময় একদিন স্কুল পালিয়ে ঢাকায় এলাম একা একা। পকেটে অনেক দিন ধরে জমানো ছয়’শো টাকা। মালিবাগে এক আত্মীয় থাকাতে তখন ঢাকার মার্কেট বলতে চিনি একটাই-মৌচাক মার্কেট। স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে রাস্তা মনে করে মৌচাক মার্কেটে চলে এলাম। তখন মার্কেটের পেছনে আরেকটা মার্কেট ছিলো, নামটা সম্ভবত আনারকলি মার্কেট। সেখানে পেলাম বহু আকাঙ্খিত নচি’র পরবর্তী দু’টি এ্যালবাম ‘কে যায়’ ও ‘কি হবে’ এর মাস্টার প্রিন্ট। সেই যুগে ঢাকা টাংগাইলের গাড়ি ভাড়া ছিলো ৩০ টাকা, আর ক্যাসেটের দাম ১২০ টাকা। যাই হোক, পকেটে পর্যাপ্ত টাকা থাকায় ক্যাসেট দুটো কিনে ফেললাম। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বলে কপালে কি দুর্গতি হয়েছিলো, তা আর নাইবা বললাম। আমি আর আমার বন্ধু অনুপম বসে বসে গান শুনতামঃ ‘অনির্বাণ, একদিন ঝড় থেমে যাবে, বারো টাকা, স্বাধীনতা, সকাল থেকে লুকোচুরি, কালো মেয়ে, নীলাঞ্জনা-২, ৩, দুনিয়ার প্রেমিক এক হও, একা একা পথচলা...আরো কতো গান!
মফস্বলে নচিকেতা জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে ‘চল যাব তোকে নিয়ে’ রিলিজ হবার পর। তারপর ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার কল্যাণে নচি’র জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি হয়ে ওঠে। এলাকার প্রথম শ্রোতা হিসেবে তখন খুব গর্ব হতো। এমনকি, পত্রিকায় নচি’কে নিয়ে কোন লেখা বের হলে বন্ধুরা নিজ দায়িত্বে তার কপি দিয়ে যেতো বাসায়।


সদ্য কৈশোর পেরুনো বয়সের যে ভাংচুর মনোভাব, সেখানে নচিকেতার গান মনের ভেতর একটা পরিবর্তন এনে দিয়েছিলো। একই সাথে বিদ্রোহ আর প্রেম কিংবা বিনয় আর স্পষ্টবাদিতা যে সহাবস্থান করতে পারে-তা শিখেছি নচি’র গান থেকেই। সেসময়ে আমাদের জীবনানন্দ পড়া শুরু, শচীন দেব এবং ভূপেনের গান শোনার শুরু। আমরা নচিকেতার যে কয়েকজন চূরভক্ত ছিলাম, তারা নিজেদের অনির্বাণ ভেবে গ্রামের রাস্তা ধরে মাইলের পর মাইল চষে বেড়াতাম, চা খেতে থামতাম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত কোন চায়ের দোকানে। খুঁজে ফিরতাম, হয়তো কোন এক চুরি যাওয়া আলোয় কোন একজন বিখ্যাত লোক গাড়ি থামিয়ে জিগ্যেস করবে, ‘অনির্বাণ, কি করছিস এখন?’ সে সময়ে লোকে আমাদের দলছুট বলতো, কারণ, অন্যদের ভাবনার সাথে কোথায় যেনো আমাদের মিলতো না। মনে মনে খুঁজতাম নিজের প্রেমিকাকে নয়, নীলাঞ্জনাকে। লোকটার শব্দ চয়ন আর গানের ভেতর প্রবচনের নির্ভুল প্রয়োগ আমাদের অবাক করতো। নিজেরা সংগীত বিদ্যালয়ে যাতায়াতের দরূণ তার শাস্ত্রীয় সংগীতে অগাধ জ্ঞান আবিষ্কারের পর চমকে উঠে ভেবেছিলাম, এই মানুষটা প্রথা ভাঙতে জানেন। এবং তিনি ভেঙ্গেছেন। সেই সাতটা সুরে, সেই বাংলা বর্ণমালাতেই তিনি লিখে চলেছেন, অথচ গানগুলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। উঠে এসেছে নীলাঞ্জনা, অনির্বাণ, রাজশ্রী, পৌলমী, শতাব্দী, সলোমন সহ আরো অনেক চরিত্ররা-যারা আমাদের আশেপাশের চেয়ে আলাদা কেউ নন।
নচিকেতা এমন একজন মানুষ-যিনি কয়েকটি কিশোরের ভাবনা, রুচি এবং শিল্পবোধ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। নিজেদের সীমার বাইরে নিজেদের ভাবতে শিখিয়েছিলেন। 'হাজার লোকের ভীড়ে তবুও তবুও একা' হতে শিখিয়েছিলেন। তারুণ্য যে বিশেষণ নয়, শক্তি-তা শিখিয়েছিলেন তিনি।
আরেকটা বিষয়ে অবাক হতাম, নচি’র প্রথম এ্যালবাম থেকে নিয়ে ‘এই আগুনে হাত রাখো’ এ্যালবাম পর্যন্ত সবক’টি গানই একসময় আমার মুখস্ত ছিলো এবং এসব এ্যালবামের কোনটিতেই তিনি ‘কষ্ট’ শব্দটা ব্যবহার করেন নি। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারের এই একটি মাত্র বহুল প্রচলিত শব্দের প্রতি তাঁর অনীহাটা কেন-তা জানতে ইচ্ছে করে খুব।
৩৬টি মন্তব্য ৩৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×