বিকেল পাঁচটার পর কিংবা ছুটির দিনে সে সময় শাবিপ্রবি ক্যাম্পাস মরুভূমি হয়ে যেতো। সে সময় আমরা গুটিকয়েক বখে যাওয়া বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো (পড়ুন, ডিপার্টমেন্টের হেড খেদানো, সিজিপিএ তাড়ানো) প্রজাতি ছাড়া সবাই ছিলো বাস-নির্ভর জনগোষ্ঠি। সুতরাং মরুভূমিটা মাথায় ভেঙ্গে পড়তো আমাদেরই। ক্যাম্পাসের সবেধন নীলমণি 'স্টুডেন্টস ক্যান্টিন' (সে সময় গোলচত্ত্বরের দক্ষিণ পাশে একটা টিনের চৌচালা ঘরে গাদাগাদি করে ব্যাংক, পোস্ট অফিস ও স্টুডেন্টস ক্যান্টিন নামে তিনটা উদ্ভট বস্তু ছিলো) বিকেল পাঁচটার পর 'আউট অব অর্ডার' হয়ে যেতো। এবং ঠিক তখনই সিগারেটের তেষ্টাটা সবার একসঙ্গে চাগিয়ে উঠতো-মরুভূমিতে যেমন পায়। ভরসা তখন ক্যাম্পাস গেট কিংবা নিউ মার্কেট (পড়ুন নয়া বাজার)। সুতরাং ছুটির দিনের অবস্থা এর থেকেই আঁচ করা যায়! মাসের পর মাস চা ছাড়া শুকনো মুখে রিহার্সাল করতে করতে আমাদের শিল্পচর্চা তখন হুমকি'র সম্মুখীন। সিগারেট তবু পকেটে করে আনা যেতো এবং নিমাই স্টাইলে সবাই মিলে খাওয়া যেতো-কিন্তু চা? বিরস বদনে যেতাম গেটে। চায়ের দাম ৩ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াতো-৭ টাকায় (চা-৩ টাকা+রিক্সাভাড়া ২+২=৪ টাকা)। বোধ করি দূর্মূল্যের বাজারও এর চেয়ে সস্তা ছিলো!
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।
সেদিন সকালে রিহার্সালের ব্রেকটাইমে পকেট চাপড়ে আবিষ্কার করলাম পকেটে সিগারেট নেই! টেবুলেশন শিটে নিজের রোলনাম্বার খুঁজে না পেয়েও এতোটা বজ্রাহত হইনি! নাদিম ভাই ব্যাপারটা জানার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন 'তুই তো মানুষের পর্যায়েই পরস না। আমরাও একসময় জুনিয়র ছিলাম'। এই কথা বলে তিনি উদাস হয়ে গেলেন। যাইহোক, ভাইকে ম্যানেজ করে বললাম, চলেন এই মিষ্টি রোদে নয়াবাজার ঘুরে আসি। কটমট করে তাকিয়ে কোন কথা না বলে ভাই আমার নিরবে হাঁটা শুরু করলেন। 'টিচার্স ক্যান্টিন' ছাড়িয়ে সি-বিল্ডিং এর কোণায় গেলাম-সেখানে তখন ই-বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য শর্টকাট মারবো। হঠাৎ একটা ঝুপড়ি ঘরের দিকে নজর গেলো। দেখলাম সেখান থেকে একটা বড় থার্মোফ্লাস্কের মাথা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আমাদের চোখে তখন আবিষ্কারের নেশা আর মরিচিকার বেদিশা! মরুযাত্রীর মতো দুজনেই এগিয়ে গেলাম। দেখি ছোট্ট ৬ বাই ৪ ফুট ঘরে কয়েকজন লেবার বসে চা খাচ্ছে। ইউরেকা বলে আমাদের ধেই ধেই করে নাচার পালা! (বিদ্রঃ আমাদের পরনে কাপড় ছিলো)। চা থাকলে সিগারেট থাকবে এটা ধ্রুব সত্য। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সিগারেট চাইলাম, দোকানের মালিক (মামার নামটা মনে নেই, তবে তিনি সি বিল্ডিং আর এ বিল্ডিং এর সুইপার ছিলেন)- লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন ৫৫ ব্র্যান্ড ছাড়া আর কিছু নেই। (জ্বি ঠিকই পড়েছেন ৫৫ ব্র্যান্ড-সিলেটের লোকাল 'বিগারেট' মানে বিড়ি আর সিগারেটের শংকর)। মামাকে উদাস গলায় বললাম, তাই দিন!
পরের ঘটনার ব্যাপ্তি দীর্ঘ কিন্তু বর্ণনা সংক্ষিপ্ত।
আমাদের উদ্যোগে সেদিন থেকে মামার ছাপড়া ঘরে কিছু ভদ্র ব্র্যান্ডের সিগারেট উঠলো, কিছু বিস্কিট-পাউরুটি উঠলো। রিহার্সাল রুমে নিয়ম করে ফ্লাস্ক ভর্তি চা-বিস্কিট-সিগারেট আসতে লাগলো। ক্যাম্পাস গেটের অপরিহার্য আড্ডাটা রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসেই স্থানান্তরিত হলো। তারও কিছুদিন পর বর্তমান ক্যাফেটেরিয়া যেখানে-তার সামনে বঠাল গাছের (কাঁঠাল গাছের মত কান্ড+ বট গাছের মত পাতা) সামনে একটা চৌচাকা গাড়িতে চা-সিগারেট-বিস্কিট-পাউরুটি বিক্রি শুরু হলো। বঠাল গাছের কান্ডে আমাদের সবার ক্লাসরুটিন লেমিনেটিং করে পিন দিয়ে লাগানো হলো। কাপের সংখ্যা ৬ থেকে বেড়ে ৩০ হলো। টং এর সংখ্যা ১-২-৩ করে বাড়তে লাগলো... পুরো মরুভূমিটাই একসময় মরে গিয়ে মরূদ্যান হয়ে গেলো।
বাকী ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যত সবাই জানে।
ছবিসূত্রঃ আন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৯:২৩