আমার আটপৌঢ়ে জীবন শুরু হইলো। প্রত্যুষে উঠিয়া পাউরুটি সহযোগে এক পেয়ালা চৈনিক পানীয় খাইয়া আপিসে প্রবিষ্ট হই, বিপণন ফর্দ তৈয়ার করি, আন্তর্জালে সম্ভাব্য খরিদ্দার নিশানা করি, অতঃপর তাহার উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া যাই। বাহন হিসেবে কখনও কখনও স্বীয় পদ যুগল অথবা নাগরিক শকট। বাদুরের ন্যায় ঝুলিয়া ঝুলিয়া আপিস পাড়ায় যাই, বহুজাতিক বণিক প্রতিষ্ঠানের ঝা-চকচকে আপিস দেখিয়া ঢুকিয়া পড়ি। প্রহরীর প্রশ্নবাণের পরীক্ষায় উৎরাইয়া কোন রকমে প্রাণ সহযোগে কর্মকর্তার সাক্ষাৎ বাগাইয়া লই। তাহার সামনে পণ্যের গুণাগুণ বর্ণনা করি, কী হেতু উক্ত পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে আমার আপিস শ্রেষ্ঠ, তাহা বুঝাইবার চেষ্টা করি, সর্বোপরি, পণ্যের মুল্য লইয়া দর কষাকষি করি। বড় আপিসের মধ্যম সারির কর্মকর্তাদ্বিগের ন্যায় চালুনি অন্য কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। তাহারা সুক্ষ্ণ দৃষ্টি হানিয়া উপুর্যুপরি প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করিয়া ফেলিতেন। আগ্রহ দেখিয়া যেই মুহূর্তে হালে পানি পাইতাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই তাহারা বলিয়া বসিতেন এই পণ্য তাহাদিগের প্রয়োজন নাই। হায়! বিপণন কর্মকর্তার রাগ করিতে মানা। হাসিমুখে তাহার সহিত একমত পোষণ করিয়া বলিতাম, বাস্তবিকই তো আপনার ইহা প্রয়োজন নাই। অতঃপর তাহার মুল্যবান সময় অপচয় করিবার দায় স্বীকার করিয়া চলিয়া আসিতাম। ফর্দ হইতে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা বাহির করিয়া সেই উদ্দেশ্যে ছুটিতাম।
মধ্যাহ্ন ভোজনে বেশিরভাগ দিবসে জুটিত ঝাঁকাইয়া বিক্রিত ঝাল মিশ্রিত মুড়ি অথবা চৈনিক পানীয় সহযোগে পাউরুটি। দুই একদিন বিলাসিতা করিয়া ফুটপাতস্থ খাবারের দোকানে বসিয়া লাউ মিশ্রিত চিংড়ি/ইলিশ মাছ দিয়া ভাত খাইতাম। তেঁজগাও সাতরাস্তাস্থ কারিগরি শিক্ষা মহাবিদ্যালয় এবং বস্ত্র প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) এর মধ্যবর্তী রাস্তায় একখানা ত্রিচক্রযানে গোচর্বি মিশ্রিত খিচুড়ি বিক্রয় হইত। এক থালা ছয় টাকা। খাইতে বেশ! একবার খাইলে গভীর রাত্রি পর্যন্ত উদরে থাকিত। কোন কোন দিন আপিস পাড়া হইতে হাঁটিয়া সেইখানে যাইতাম। খিচুড়ি খাইয়া পুনরায় স্বীয় আপিসের (মোহাম্মদপুর) উদ্দেশ্যে পা বাড়াইতাম। অতঃপর হন্টন।
ইতোমধ্যে একখানা নূতন উপদ্রব আসিয়া জুটিল। চাকুরি মাস অতিক্রম করে নাই তখনও। একদিন সাঁঝিকাবেলায় ছাত্রাবাসে ফিরিয়া শুনিলাম বাড়ি ছাড়িয়া দিতে হইবে। চিন্তিত হইয়া ছাত্রাবাসের ব্যবস্থাপককে জিজ্ঞাসা করিলাম, পূর্ব বিজ্ঞপ্তি ব্যাতিরেকে বাড়ি ছাড়িবার আদেশ প্রদান নিশ্চিতভাবে আইন ও শর্তের লংঘন। অমানবিকও বটে! আপনারা মালিকপক্ষের সহিত আলোচনায় উপবিষ্ট হউন। ব্যবস্থাপক তাহার কর্ণ চুলকাইতে চুলকাইতে কহিলো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দুই মাস পূর্বেই মালিকপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়াছে। চলমান মাসে তাহার মৃত্যুরেখা শেষ হইবে। আমি কহিলাম, তবে তাহা কী হেতু আমার নিকট লুকাইয়াছেন! পূর্বে জানিলে আমি এই ছাত্রাবাসে উঠিতাম না। তিনি কহিলেন, আমাকে এইখানে না উঠাইলে তাহাদিগের জনপ্রতি মাসিক ভাড়ার হার বাড়িয়া যাইতো। সেই হেতু সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইহা আমার নিকট গোপন করা হইয়াছে। আমি শুধাইলাম, তবে কী আমরা সকলে মিলিয়া নূতন ছাত্রাবাসে উঠিতেছি? তিনি বলিলেন, ‘আমরা সকলে স্বীয় ব্যবস্থাপনায় ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রাবাস ঠিক করিয়া লইয়াছি। আমি মরিয়া হইয়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, তবে আমি কোথায় যাইব?
তিনি নিরাসক্তের ন্যায় কান চুলকাইতে চুলকাইতে উদাস হইয়া দার্শনিকের ন্যায় বলিলেন, এই বৃহৎ শহরের কোন না কোন স্থানে নিশ্চয়ই আপনার আশ্রয় হইবে।
বুঝিলাম তাহারা একজোট। তাহাদিগের সহিত বিবাদে আমি টিকিতে পারিব না। বিনা বাক্যব্যয়ে সেইখান হইতে উঠিয়া আসিলাম। স্বীয় কামরায় ফিরিয়া চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি লইয়া বিচলিতের ন্যায় সমক্ষের সম্ভাব্য অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া রহিলাম।
(চলিবে...)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:২৩