ছোটকাকিমা কে দেখতাম ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি করে নিজেদের বিছানা পাততেন, হাত দিয়ে ফুলিয়ে ফুলিয়ে বালিশগুলো বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতেন । আমি খুব মন দিয়ে কাকিমার বিছানা পাতা দেখতাম। আমাদের বাড়িতে চা খাওয়ার চল ছিলনা কিন্তু ছোটককিমার ছিল চায়ের নেশা । কাকিমার বোধহয় খুব অসুবিধা হত। দু পয়সা করে লিপটন চায়ের প্যাকেট কাকিমা আমাকে দিয়ে দোকান থেকে কিনে আনাতেন। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে চা বানিয়ে খেতেন , ঝি-কেও একটু দিতেন।
মাঝে মাঝে আমাকেও একটু দিতেন। কাকিমা বলতেন ,খেয়ে দেখ , খেতে খুব ভালো। বুঝতাম কাকিমা ঘুষ দিচ্ছেন । কেননা ছোটকাকিমা বেশ ভালো ভাবেই জানতেন যে ছোটকাকার কানে চায়ের খবর পৌঁছলে তুলকালাম কান্ড হয়ে যাবে । চা খেয়ে দেখতাম সত্যিই জিনিষটা খেতে বেশ ভালো। তখন রেশনে যে চিনি পাওয়া যেত তা আমাদের ধরাই থাকতো । হাঁড়ি হাঁড়ি চিনি রাখা থাকতো খাটের তলায় । কাকিমা সেই চিনি দিয়ে রস বানিয়ে সকালে জলখাবারে রুটির সাথে আমাদের খেতে দিতেন। এর আগে আমরা শুকনো রুটি খেতাম গুড় দিয়ে তারচেয়ে এটা অনেক বেশি ভালো লাগতো । বাবার এক দূর সম্পর্কের মামা নাগরাকাটা চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন । তিনি মাঝেমাঝে বৌ ছেলে নিয়ে আসতেন আমাদের বাড়িতে । যখনই আসতেন বেশ বহাল তবিয়তে কয়েকটা দিন কাটয়ে যেতেন । সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন কাঠের চায়ের পেটি । সে চায়ের কি গন্ধ ! আমাদের বাড়িতে যেহেতু চায়ের চল ছিলনা , তাই চেনা জানা লোকেদের ঐ চা বিলিয়ে দেওয়া হত । আর কাকিমা খেতেন কেনা চা।
কাকিমা সংসারের রান্নাবান্না কিছুই করতেন না। ঠাকুমা কাকিমাকে বলে দিলেন আমাদের দু বোনের চুলের যত্ন করতে। যথারীতি চুলের যত্ন শুরু হয়ে গেল । রোজ সন্ধ্যে বেলায় কাকিমা একবাটি নারকেল তেল নিয়ে বিলি কেটে কেটে আমার আর দিদির মাথায় মাখিয়ে দিতেন । চুলে তেল মাখানো হয়ে গেলে ঠাকুমা আমাদের এক একদিন এক একরকম খোঁপা বেঁধে দিতেন । সেই সব খোঁপারও কত রকম নাম, এখনও আমার নাম গুলো মনে আছে । ঠাকুমা কোনদিন বেঁধে দিতেন "কলেজ খোঁপা"
, আবার কোনদিন "পতি ভোলানো প্রেম" কোনদিন আবার "টেক্কা খোঁপা" । ঠাকুমা চুল বাঁধতে বাঁধতে গল্প করতেন তোদের ঠাকুর্দার কাছে যখন শুতে যেতাম তখন নীলাম্বরী শাড়ি পরে এক একদিন এক এক রকমের খোঁপা বেঁধেঁ যেতাম, তোদেরও এরকম ভাবে সাজতে হবে। ঠাকুমার এসব আদিখ্যেতার কথা আমার ভালো লাগতো না ।
ছোটকাকিমা কাজ করতেন কম কিন্তু যেটুকু করতেন খুব পরিপাটি । মনে আছে কাকিমা খুব যত্ন করে বড় বড় ইলিশ মাছ কুটতেন । ছোটকাকাকে খুব যত্ন করতেন । সকালে কাঁসার রেকাবিতে করে এক একদিন একেক রকমের জলখাবার সাজিয়ে নিয়ে যেতেন ।
সন্ধ্যাবেলায় কাকিমা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন । আর আমরা চারপাশে গোল হয়ে বসে গান শুনতাম । একদিন সন্ধ্যাবেলায় কাকিমা গানে বসেছেন । ছোটকাকা পা টিপে টিপে এসে হাজির হলেন । আমরা বুঝতেই পারিনি যে ছোটকাকা এসেছেন । গান শেষ হলে ছোটকাকা আলমারি খুলে কতগুলো পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি আর পাঞ্জাবী এনে কাকিমার সামনে রেখে বলতে লাগলেন, এতক্ষণ ধরে যে ভিকিরির গান শুনলাম তাকে পুরষ্কার দেওয়া হল। কাকিমা চুপ করে বসে থাকলেন কিন্তু আমাদের ছোটোকাকার উপর ভীষণ রাগ হল । কাকিমা ভালই গাইতেন তবু ছোটকাকা এরকম করতেন । এখন বুঝতে পারি এটা ছিল ছোটকাকার রসিকতা ।
দাদা একবার আমাকে আর দিদিকে নিয়ে গিয়ে ছিল সিনেমা দেখতে । লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কারণ সিনেমা দেখা আমাদের বারণ ছিল । যে সিনেমাটা দেখতে গিয়ে ছিলাম তার নাম "দৃষ্টিদান"। বিখ্যাত গায়ক কানা কেষ্ট এই সিনেমায় অভিনয় করে ছিলেন।
সিনেমা দেখে ফিরে এসে দেখি ছোটকাকার কাছে ঘটনাটা ফাঁস হয়ে গেছে । দাদার কপালে জুটলো বেধড়ক ঠ্যাঙানি, আমি আর দিদিও বাদ গেলাম না । ছোটককিমা এলেন তাড়াতাড়ি তেল গরম করে মালিশ করতে । ছোটকাকিমার উপর মনে মনে খুব রাগ হল । বুঝতে পারলাম খবরটা ছোটকাকিমাই ছোটকাকার কানে দিয়ে আমাদের মার খাইয়ে এখন আবার ভালো মানুষ সাজতে এসেছেন ।