আমাদের শ্যামবাজারের বাসা বাড়িটা আমার শৈশবের স্মৃতি নিয়ে আজও মাথা তুলে দঁড়িয়ে আছে । জানিনা কোনদিন হয়তো ওটা আধুনিক কোন বহুতল বাড়ি হয়ে যাবে।
কিন্তু আমার শৈশব ঐ বাসাবাড়িতেই ফেলে এসেছি । তাই তাকে বারেবারেই খুঁজতে যাই ওখানে। আমার ছোটভাই গৌর ছিল সত্যিই দুরন্ত। মাঝে মাঝেই বেশ দুষ্টুমি করতো।কিন্তু মা দেখতাম খুব সহ্য করতেন।একদিন মা রান্না বান্না সেরে রেখেছেন ও কোথ্থেকে এসে তার ওপর ময়লা ছড়িয়ে দিল। ঠাকুমা রেগেমেগে বলতে লাগলেন ওকে বেশ করে মারো। মা দেখলাম কিছুই করলেন না। শুধু ঐ রান্না ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে রাঁধতে বসলেন। মা বলতে লাগলেন দুষ্টুমির জন্য তো ওকে সবাই বকে আবার আমরাও যদি বকি তবে ও দাঁড়াবে কোথায় ।যাবে আমার গতর আর ওর বাবার পয়সা। সত্যি বাবাও দেখতাম এ ব্যাপারে মার সাথে একমত ছিলেন। গৌর একদিন আলুকাবলিওয়ালার ঝুড়িতে ময়লা ফেলেছিল, আলুকাবলিওয়ালা তো আর মা না, সে বাড়িতে এসে খুব চেঁচামেচি করতে লাগলো।বাবা তাকে সমস্ত আলু আর মশলার দাম দিয়ে দিলেন কিন্তু গৌরকে কিছু বললেন না।
ছোটবেলায় গৌর কথা শিখেছিল অনেক দেরি করে।বাবা ওকে বলতেন একটা করে কথা বললে একটা করে টাকা দেব।বাবা মা ওকে খুব ভালোবাসতেন।কিন্তু ওর দুষ্টুমির জন্য মা বাবা ছাড়া অন্যদের কাছে ভালই মারধোর খেত। একদিন হয়েছে কি, ও কি একটা অন্যায় করেছে এখন আমার ঠিক মনে নেই ।ছোটকাকা দেখি ভীষণ রেগে গেছে।ছোটকাকা যে কি রাগী তা আমরা সবাই জানতাম। এবার তো জানি ছোটকাকা ওকে খুব মারবে।কিন্তু ছোটকাকা ওকে মারধোর না করে একটা বড় ট্রাঙ্কে ভরে তালা দিয়ে দিলেন। আমি আর মা কাঁচুমাচু মুখ করে ট্রাঙ্কের দিকে তাকিয়ে রইলাম।বুঝতে পারছিলাম ছোটকাকা রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছেন।কিন্তু কিছু বলার সাহস নেই। এসময় ঠাকুমা এসে ছোটকাকাকে বকতে লাগলেন ও যদি মরে যায় তবে তো তোর ফাঁসি হয়ে যাবে। ঠাকুামার বকা অথবা ফাঁসি হওয়ার ভয় যে কারণেই হোক ছোটকাকার চৈতণ্য হল। ছোটকাকা ট্রাঙ্কের তালা খুলে দিলেন। মা আর আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আমার আর এক ভাই ছিল কেষ্ট।আমার থেকে প্রায় পনেরো বছরের ছোট।ওরও জন্ম শ্যামবাজারের ঐ বাড়িতেই।ওরজন্মের পরেই মা অসুস্হ হয়ে পড়েছিলেন।তাই আমিই ওকে তুলোয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে ছিলাম। কেষ্ট আমায় ডাকত দিদি বলে কিন্তু মায়ের মত ভালোবাসত। আমার প্রথম সন্তানের ভালোবাসা বোধায় ওকেই দিয়েছিলাম। মাত্র তেরো বছর বয়সে ও ক্যান্সারে মারা যায়। কেষ্টর স্মৃতি আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা। ও পড়ত সেন্ট পলস্ বোর্ডিং স্কুলে। ছুটিতে বাড়ি আসত আর কিছুতেই ফিরে যেতে চাইত না। মনে আছে আমার বিয়ের সময়, তখন ও বছর ছয়েকের। বিয়ের পর বরের গাড়ি কিছুতেই ছাড়তে দেবেনা। আমার দিদিকে কোথাও নিয়ে যেতে দেব না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল, কারুর বারন শোনেনা। শেষে আমার শ্বশুরমশাই মিষ্টি খেও বলে ওর হাতে টাকা গুঁজে দিতেই সব ভুলে গিয়ে আমাকে ছেড়ে দিল। শেষ বার ভাইফোঁটা নিতে এলো যে বছর, আমার বাড়ি এসেছিল প্রায় পাঁচবার। প্রথমবার অন্য ভাইদের সাথে তারপর, একাই চারবার। আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল বাড়ি থেকে একটা মাত্র স্টেশন। ও যতোবারই আসে প্রতি বারই শ্বশুরমশাই ওকে মিষ্টি টিষ্টি খাইয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসেন। ও ঘন্টাখানেক পরেই এসে উপস্থিত হয়। শেষে আমিই অকে আলাদা করে বুঝিয়ে বললাম, ভাই কুটুমবাড়ি কি একদিনে এতোবার আসতে আছে, লোকে কি বলবে? ও কি বুঝল কে জানে, আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, দিদি আসতে নেই না, আর আসবনা। তারপর আর ও আসেনি। জানুয়ারী মাস নাগাদ ওর গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। গায়ে প্রচন্ড জ্বর থাকায় কিছুতেই ray দেওয়া গেল না। আট মাস ভুগে শেষে ১২ই সেপ্টেম্বর পূজোর ঠিক আগে আগেই ও চলে গেল।
সেই থেকে আমি আর ভাইফোঁটা দিইনা।