somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার আপন আধারে এই সব যাপিত জীবনেরা!!

২৯ শে জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুখবন্ধ: নিম্ন বা মধ্যবিত্ত জীবনের টানা-পোড়েন, হাসি-কান্না অনুভূতিগুলো অনেক বেশি স্পর্শকাতর, স্মৃতিজাগানিয়া। তবে যাদের সেই যাপিত জীবনের স্মৃতিকাতরতা বড় বেশি ভোগায়, চলমান সময়ে তারা খুব বেশি সুখে থেকেও সেই দিনগুলোকে ভুলতে পারেন না, ভুলতে পারেন না সেই অসময়ের টুকিটাকি না পাওয়া গুলোকে। হয়ত আজ সময় তাদেরকে সেগুলো দ্বিগুন পরিমাণে ফিরিয়ে দিয়েছে, তবে নিষ্ঠুর সময় নিজে কখনো ফিরে আসেনি। আবারো বোরিং একটা লেখা প্রকাশের জন্য আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থণা।




গল্পকথা:
যাচ্ছে চলে, যাক না সময়! :
খুব বেশি বড়ও হইনি। আমি তখন মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ি, ছোট ভাইয়া সেভেনে আর বড় ভাইয়া ইন্টারমিডিয়েটে পড়ত। বড় আপু পড়াশোনা করার অবসরই পেত না। সংসার সামলেই আপুর বেলা কাটত। বাকি দুই বোন ছোট হলেও পিঠাপিঠি ছিল।

বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে আমরা কলোনীতে থাকতাম। আমাদের কলোনীটা অনেক বড় আর ফাঁকা ছিল। অনেক বড় একটা মাঠকে ঘিরে অনেকগুলো কোয়ার্টার। প্রতি শুক্রবার বিকেলটা ছিল মনে রাখার মত। কারন ঐ দিন বিকেলে মিষ্টিওয়ালা হাতে-টানা গাড়িতে করে হরেক রকম মিষ্টি নিয়ে হাঁক-ডাক শুরু করত। আমাদের শিশু মনের চাঞ্চল্যের কারন ছিল ওটাই। কারন মিষ্টি আমাদের অনেক প্রিয় ছিল। অভাবের সংসারে যেখানে অংক কষে কষে কেবল তিনবেলা খাবারের যোগাড় ছিল বাবার একমাত্র সাধনা সেখানে মিষ্টান্ন কেনার ব্যাপারটা তো একটা বড় রকমের বিলাসিতা। তাই মিষ্টিওয়ালা যখন কলোনীতে পা রেখে বেল বাজিয়ে হাঁকতো “কদমা বাতাসা মিষ্টি” তখন ভেতর থেকে পড়িমরি করে আমরা বড় ৪ ভাইবোন বারান্দায় এসে রেলিং এ অনেকটা ঝুলে ঝুলে মিষ্টিগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। সেখানে লাল, সাদা, কালো অনেক রকম মিষ্টি ও মিষ্টান্ন থাকত। মিষ্টিওয়ালা যখন ফেরি করতে করতে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে চলে যেত তখন এক, দুই, তিন , চার...... এভাবে মিষ্টি গুলো গুনতাম। হঠাত করে হয়ত বা বড় ভাইয়া লোভ দেখানোর জন্য কোন এক বিশেষ প্রকারের মিষ্টির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলত “রাশু, আমি বড় হয়ে চাকরি করে ও-ইই মিষ্টিটা কিনব।” তখন ছোট ভাইয়া প্রগলভ হয়ে দুই হাতে বড় ভাইয়ার হাত ধরে বলত “ভাইয়া ভাইয়া বড় হয়ে আমাকেও কিনে দিবে?” ভাইয়া উপরের দিকে তাকিয়ে আনমনা হবার ভান করে বেশ জোর দিয়েই বলত “আচ্ছা যাহ্‌ তোদের সব্বাইকে পছন্দ মত মিষ্টি কিনে দেয়া হবে!” এভাবে আমরা ভবিষ্যত মিষ্টির স্বাদ কেমন হবে তা ভেবে জিভে আসা জলটুকু একটানে সুড়ুৎ করে গিলে ফেলতাম। আর না কিনেও দেখে দেখেই আমাদের মিষ্টি খাওয়া হয়ে যেত। তারপর মিষ্টিওয়ালা যখন পুরো মাঠটা একবার ঘোরা শেষ করে কলোনী ছেড়ে বের হয়ে যেতে উদ্যত হত তখন আমাদের সেকি চিৎকার... ইশ। মিষ্টিওয়ালা একটু আস্তে আস্তে যাও না। সবগুলো মিষ্টি তো ঠিকমত দেখা হয়নি। আরেকবার ঘুরে আসোনা! সত্যি বলতে এই চিৎকার কখনো ভাষা খুঁজে পেত না। মনের কথা মনের কোন গহীনেই হারিয়ে যেত।

অভাবে কখনো স্বভাব নষ্ট:
আমাদের স্কুলে সবাই অনেক বড়লোক ছিল না এটা সত্যি তবে টিফিনের ফাঁকে কিংবা স্কুলে বেল বাজার আগে অনেকেই অনেক কিছু কিনে খেত। ছোট্ট আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম। আমারো লোভ হত। সব সময় না, তবে মাঝে মাঝে। বিশেষ করে দুধের মালাই আইসক্রিম আর তিলের খাঁজা খেতে অনেক মজা লাগত। একদিন আমি কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই একটা কাজ করে ফেলি। শেপু আমাদের সাথেই পড়ত। সেদিন আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা আইসক্রিম খাচ্ছিল।প্রচুর উৎসাহে আইসক্রিমে কামড় বসাচ্ছিল তখন বেখেয়ালে ওর হাত গলে একটা এক টাকার কয়েন পড়ে যায়। আমি কেন যেন কিছু না ভেবেই ডান পা দিয়ে কয়েনটার উপর দাঁড়িয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর শেপু তার কয়েন খুঁজতে শুরু করল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে রাশু আমার কয়েন টা এখানে কোথাও পড়েছে। দেখেছিস?” আমি কয়েনের ওপর দাঁড়িয়েই এদিক সেদিক ঘুরে-ফিরে কয়েন খোঁজার ভান করে দিব্যি ওকে মিথ্যে করে বলে দিয়েছি, “কই নাতো!” তারপর ক্লাসের ঘন্টা বাজলে শেপু তার কয়েন ভুলে চলে গেল। আমি পায়ের নিচের লুকানো জায়গা থেকে কয়েন বের করে নিয়ে দুটো দুধের মালাই আইসক্রিম ডান আর বাম হাতে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাপুস হুপুস করে খেতে খেতে ক্লাসের দিকে গেলাম। বাবা সব সময় বলেন মিথ্যে বলা মহা পাপ। আমি সেদিন অকারনে মিথ্যে বলেছি। বাবা আরো বলেন লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আমি সেদিন লোভও করেছি। কিন্তু অভাবের কারনে আমার শিশু মনে আইসক্রিম খাওয়ার চেয়ে সেই পাপানুভূতিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে খুব বেশি প্রবল হয়ে ওঠেনি হয়ত।



আমার আপন আধার:

আমার পরিচয় না দিয়েই স্মৃতিচারণে চলে গেলাম। আমি রাশু। মা, বাবা, দাদা, দাদু, দুই ভাই আর চার বোনকে নিয়ে ছিল আমাদের ছা-পোষা সংসার। বাবা সরকারি চাকুরে। বাবা একজন সৎ মানুষ ছিলেন তো তাই আমরা অভাবের মধ্যে দিয়েই বেড়ে উঠি। আমাদের শৈশব কেটেছে অনেক কষ্টে। দোলনায় দোল খেয়ে আমি, আমরা বড় হতে পারিনি। এমনকি মায়ের আদরও খুব একটা পাইনি। কারন আমার মা ছিলেন কিছুটা বিকারগ্রস্থ। যাকে সোজা বাংলায় কেউ কেউ পাগল বলে। তবে সব সময় না সেটা মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। সবাই বলত মা নাকি অভাবে পাগল হয়ে গেছেন। যখন মায়ের পাগলামি উঠত তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। আমাদের চিনতে পারতেন না। চিৎকার দিয়ে পাড়া মাতাতেন। আমি তখন পর্দার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। মাঝে মাঝে মা কাউকে না জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে কোথায় কোথায় যেন চলে যেতেন। তখন কখনো বড় ভাইয়া, কখনো আব্বু কিংবা আত্মীয়রা মাকে খুঁজতে যেতেন। একবার মা বারো দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম মা আর কখনো ফিরে আসবে না। আমরা আমাদের মাকে আর কখনো দেখবো না। আমাদের প্রিয় মায়ের অপ্রিয় পাগলামিও সহ্য করতে হবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে মা ফিরে এলেন। এভাবে মায়ের প্রতিটি ফিরে আসা যেন অনেকগুলো নক্ষত্রের মাঝে একফালি চাঁদের রেখা টেনে দিত।

কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে? কভু আশীবিষে দংশেনি যারে??:

জীবনের এসকল টানা পোড়েন থেকে আমি আজ অনেক দূরে নিশ্চিন্ত মনে বিবাহিত জীবন যাপন করছি। আজ আমিও একজন মা। আমার আছে দুটি চাঁদমুখ, আমার সন্তান। আমার সন্তানেরা আজ পায় অফুরন্ত ভালোবাসা। মাঝে মাঝে আমার ভালোবাসায়, আমার মাতৃত্বের চরম উৎপাতে তারা বলে "মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?" হয়ত বা আমার ভালোবাসা ওদের কাছে মূল্যহীন না হলেও পাগলামি ঠেকে!! সত্যিকারের পাগল মায়ের ভালোবাসাহীন জীবন যাপনের যাতনা ওরা কি বুঝবে?

তবুও হাহাকারে বৃত্তবন্দি:
আমার বড় ভাইয়া তার কথা রেখেছে। মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হবার পর থেকে বাড়িতে নিয়মিত মিষ্টি আসা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে সেগুলো কোন একনিষ্ঠ ভক্তের অভাবে পঁচে গলে গিয়ে স্থান খুঁজে নেয় গাঁটারে। আমার বিশাল ফ্রিজটা ভর্তি হয়ে থাকে রকমারি নামী-দামী আইসক্রিম আর মিষ্টান্নে। আইসক্রিম কিংবা মিষ্টান্নের আবেদনে আমার জিভে জল আসে না, তবে চোখে মাঝে মাঝে জলীয় কিছু একটার অস্তিত্ব অনুভব করি। এই সমৃদ্ধ বর্তমানে এত সব সুখের ভিড়ে শৈশবের বেরসিক দু:খ জাগানিয়া স্মৃতিগুলো মাঝে মাঝে এসে ভিড় করে, হাহাকার সুরে মনের অলিগলিতে গুমরে মরে।



উৎসর্গ:
গল্প লেখাটি একজন সত্যিকারের রাশু আমার জেসমিন আপুকে উৎসর্গ করলাম। আপুর মত মানুষেরা অদ্ভুতুড়ে জীবনের কাছে অনেক চেয়েও কিছুই পায় না। আবার না চাইতেই অনেক বেশি কিছুই পেয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৮:৪৬
৫০টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×