একটি দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলাম, শিরোনামটা ছিল “মধ্যযুগীয় বর্বরতার ন্যায় গৃহবধূকে নির্যাতন” শিরোনামটা পড়ে একটি প্রশ্ন তৈরী হয়েছিল যে, মধ্যযুগীয় বর্বরতা কি? এটি কি ইউরোপীয় মধ্যযুগীয় নির্যাতন, না ভারতীয় মধ্যযুগে মুসলমান শাসকদের শাসন আমল , না খোদ বাংলার মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসকদের কোন নির্যাতনের খন্ডচিত্র। কিন্তু এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা ছিল না। তখন আমি ১ম বর্ষের ছাত্র, না জানাটা স্বাভাবিক , এই প্রশ্নটার উত্তর পাওয়ার চেষ্টা আমার কম ছিল বলে মনে হয় না।
যাই হোক, এখন বক্ষ্যমাণ আলোচনায় আসি যদি সহজে মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাস এর সারমর্ম করি তাহলে বলা যায় যে , ঐ সময়ে পোপরাই ছিল দুনিয়াবী ক্ষমতার অধিকারী। ধর্মীয় ক্ষমতার চর্চার আড়ালে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। আর ইউরোপে চালু হয়েছে বাইবেলীয় শাসন, মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের যে নির্যাতন করা হত তার অনেক প্রমাণ রয়েছে।
যদি আমি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আসি তাহলে বলতে পারি মুসলিম সুলতানগণ শাসন করেছে, করেছে মুঘল সম্রাটগণ । তারা ছিলেন মুসলিম. তারা ইসলামী শাসন করেছে কিন্তু নির্যাতনের কোন প্রমাণ আজও পাওয়া যায় নি, তারা উদারতার পরিচয় দিয়েছেন, তারা হিন্দু মুসলিম সর্ম্পক অটুট রেখেছেন, সুলতানগণ ধর্মীয় ব্যাপারে ছিলেন উদার। মুসলিম- হিন্দু দাঙ্গা সৃষ্টি হয়নি তৎকালীন সময়ে।
কিন্তু যে সা¤প্রদায়িকতার বাণী তুলে গালি দেওয়া হয় সেটা মোটেও সত্য নয়। কারণ, বৃটিশ আমলে শুরু হয় সা¤প্রদায়িকতার যুদ্ধ, এর পিছনে যুক্তিও ছিল। বৃটিশরা এদেশে বাণিজ্য করার জন্য এসেছিল। মোঘল সম্রাটদের বিভিন্ন ইউরোপীয় ফলমূল, উপহার সামগ্রী, ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দানের মাধ্যমে শুল্ক মুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন। কিন্তু তাদের প্রতি যে জনসমর্থন ছিল না তার চিহ্ন পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মাধ্যমে ।
দীর্ঘ দিন মুসলিম শাসনের অধীনে থাকা হিন্দুগণকে তাদের আয়ত্ত্বে আনার জন্য বিভিন্ন কথিত সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন। তারা হিন্দুদেরকে বড় বড় পদে আসীন করেছিলেন যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যে, তাদের প্রতি হিন্দুদের জনসমর্থন আদায়। অপরপক্ষে, মুসলিম সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়ে, সরকারী ক্ষমতার অধীন থেকে মুক্ত হয়ে জঙ্গলে বনবাসী জীবনকে -কেউ কেউ বেশী ভালবাসতে থাকে। যার ফলে মুসলমানগণ সামাজিক অবস্থান থেকে পিছু হটতে থাকে, আর এই অবস্থানটা গ্রহণ করে বৃটিশদের সাহায্যকারী হিন্দু স¤প্রদায়। বৃটিশরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুই স¤প্রদায়কে মাতিয়ে তোলে, তারা এই মহাদেশের ক্ষমতার মসনদে দীর্ঘদিন থাকার জন্য দুই স¤প্রদায়ের ধর্মীয় সা¤প্রদায়িকতাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেগবান করে তোলে। যার ফলে ভারতে শুরু হয় এই ধর্মীয় সা¤প্রদায়িকতা, যার বীজ বপন করে খোদ বৃটিশ রাজনীতি।
বাংলার মধ্যযুগে লক্ষণসেনকে পরাজিত করে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন ইখাতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। কিন্তু এই সহজ কথাটা যত সহজে বলা যায় তত সহজ নয়। লক্ষণসেন আগেই জানতেন যে, বিশালদেহী এক যোদ্ধা আসবে যার হাত হবে লম্বা, এমনকি নিজ হাটুর নিচ পযর্ন্ত ঝুলে থাকবে এই চিন্তা লক্ষণসেনের মাথায় ছিল এবং বখতিয়ারের বিহার জয়ের সংবাদও লক্ষণসেনের জানা হয়ে যায়।
যাইহোক, এক দুপুরে ঘোড়া বিক্রেতার বেশে বখতিয়ার খিলজি ১৭ জন সৈন্য নিয়ে ঝাড়খন্ডের ভিতর দিয়ে এসে নদীয়া আক্রমণ করেন। এ সংবাদ শুনে বয়স্ক লক্ষণসেন পিছনের দরজা দিয়ে নদী পথে পলায়ন করে। আর বখতিয়ারের বিশাল সৈন্য বাহিনী এর মধ্যে নদীয়াতে এসে উপস্থিত হয়। যার ফলে বাংলার শাসন ক্ষমতা চলে আসে মুসলমানদের হাতে। শুরু হয় বাংলায় মুসলিম শাসন। সুলতানগণ তখনও স্বাধীন ছিলেন আবার কখনও দিল্লির সুলতানদের আনুগত্য করেছেন। সুলতানগণ বাংলার মুসলিম সমাজকে বিকাশের দিকেও নজর দিয়েছেন সত্য কিন্তু হিন্দু সহ অন্যান্য স¤প্রদায়ের উপর কখনোও নির্যাতন করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া খুবই কষ্টকর। বরং তারা হিন্দুদেরকে সরকারী বড় বড় পদে আসীন করে মর্যাদা দিয়েছেন। কখনো সুলতানী শাসন ব্যবস্থার সেনাবাহিনীর প্রধান (পাইকবাহিনী নামে পরিচিত) আবার কখনো সুলতানদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ দান করেছেন।
হিন্দুরা বড় বড় পদ পাওয়ার জন্য আরবী ও ফারসী ভাষা শিক্ষা করতেন, শ্রীচৈতন্যের ২ শিষ্য রূপ ও সনাতন হোসেনশাহের সময়ে উচ্চ পদস্থ অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাহলে সহজেই বুঝা যায় যে , মুসলিম শাসকগণ হিন্দু সহ অন্যান্য স¤প্রদায়ের লোকদের নির্যাতন করেনি বরং মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন।
বাংলার মুসলমানগণ ১২ শতকের প্রথম ভাগের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করলেও অনেক পূর্বে তারা এদেশে আগমন করেন। বাংলার ইতিহাসে তিনটি ধারায় মুসলমানদের আগমনের নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রথম ধারায় আগমন ঘটে আরব বণিকদের। তারা সপ্তম শতকের শুরুর দিকে প্রথম নৌপথে বানিজ্য করতে ভিড় জমায় বাংলার দ্বার হিসাবে পরিচিত বন্দর শহর চট্টগ্রামে, যার প্রমাণ এখনও লক্ষণীয়।
বণিকরা এখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্থানীয় মুসলিম বসতি গড়ে তুলেন। দ্বিতীয় ধারায় বাংলায় আগমন করেন মুসলিম সুফিগণ। ধর্মীয় আধ্যাত্বিকতার অধিকারী মুসলিম সুফিগণ বাংলার মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার ও বিকাশের জন্য খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ভূমিহীন মানুষের কল্যাণে বসতি স্থাপন করার সুযোগ দারিদ্র্যতার জালে আবদ্ধ জনগণকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন ও পথিকদের ৩ বেলা খাবারের ব্যাবস্থার মাধ্যমে সাধারন নিম্ন বর্ণের মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হন। তারা ভালবাসা দিয়ে, উদারতা দিয়ে, মুহাব্বাত দিয়ে মানুষকে সোনালী ইসলামী পতাকা তলে আনতে সক্ষম হন। দীর্ঘদিন হিন্দু বৌদ্ধ শাসকদের অত্যাচারের অতিষ্ট জনগণ শান্তির বাণী শুনে আর বসে থাকতে পারেনি। তারা মুসলমান হয়ে আল্লাহর কাছে আত্বসর্মপণ করে সুফিদের হাতকে শক্তিশালী করেছেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, যে সুফিদের হাত দিয়ে এদেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হল, মুসলিম সমাজ বিস্তার লাভ করেছিল সেই সুফিগণ আজ দুনিয়ার ক্ষুদ্র স্বার্থে ইসলামকে পুঁজি করে ব্যাবসার জগতে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। মাজার-ব্যবসাকে রমরমা করার জন্য তারা বার্ষিক, মসিক ও সাপ্তাহিক হালখাতা আয়োজন করে। নৈতিকতা বর্জিত কাজ করতে তাদের বুকখানি একটুও কাঁপেনা। তারা শিরকের গুনাহের সাথে যুক্ত হচ্ছে দেদারছে, নামাজ,রোযা, পর্দাকে ত্যাগ করা তাদের কাছে আধ্যাত্বিকতার পরিচয় হয়ে উঠেছে তাহেেল আজ এই মুসলিম সমাজের কান্ডারী কে? কে হবে মুসলিম জাতির পাঞ্জেরী?
আর সর্বশেষ ধারার আগমন ঘটে মুসলমান শাসকদের যারা সামরিক শক্তির মাধ্যমে এদেশে শাসন ক্ষমতার ভিত্তি প্রতিষ্টা করেছে ১২ শতকের দিকে। এর পথ-প্রর্দশক হলেন বখতিয়ার খিলজি, পূর্বে যা আলোচনা করা হয়েছে মুসলমান সুলতানগণ যে উদারতার ধারক ও বাহক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক ঘটনার মাধ্যমে। কখনো সুলতান নিজে এর প্রমাণ পেশ করতেন আবার কখনো কাজের মাধ্যমে বা সুলতানদের কার্যপরিচালনার মাধ্যমে উদারতার পরিচয় ফুটে ওঠে।
সুলতানী আমলে কয়েকটি ঘটনার বিশ্লেষণ করলে আমরা এর প্রমাণ লক্ষ্য করতে পারি। তখনো নারী সমাজ পিছিয়ে ছিল না। মধ্যযুগে তারা সামাজিক কার্যকালাপে অংশগ্রহণ করেছেন। ইংলিশ বাজার শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, বিবি মালতি নামে একজন মহিলা সমাজের পানির সমস্যা সমাধানের জন্য জলাধার নির্মাণ করেছিলেন। আবার বিবি শব্দটি মুসলমানরা ব্যবহার করে কিন্তু মালতি শব্দটি দেশজ, যা হিন্দু স¤প্রদায়ের মধ্যে বেশী ব্যবহত হয়। তাহলে বুঝা যায় যে বিবি মালতি নব মুসলিম, তিনি মুসলমান হয়ে বিবি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। পূর্বের মালতি নামও ত্যাগ করেন নি। সেই নামে পরিচিত হয়েছেন উদার মুসলিম সমাজে। তৎকালীন মুসলিম সমাজ যে কতটা উদার ছিল এটাই তার প্রমাণ বহন করে।
তারপরও আজ মধ্যযুগীয় সমাজ নিয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। মধ্যযুগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, মধ্যযুগের শাসন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আবার বর্বর নির্যাতনের অভিযোগও তুলেছেন, যা কোনমতে গ্রহণযোগ্য নয়। মুসলিম সমাজের ভিতরে বসবাসরত হিন্দু স¤প্রদায়ের সাথে যে মধুর সর্ম্পক ছিল তার প্রমাণ হিসেবে সা¤প্রতিককালে আবিষ্কৃত গৌড়ের মাধাইপুরে অবস্থিত গুণবন্ত মসজিদের কথা বলা যায়। গুণবন্ত নামে এক হিন্দু ব্রাহ্মণের যে মন্দির ছিল সেই মন্দিরের উপরই মসজিদ নির্মিত হয়েছে কিন্তু সেই পরিত্যক্ত মন্দিরের নামেই মসজিদটির নামকরণ করেছে উদার মুসলিম সমাজ । এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে তৎকালীন সমাজে হিন্দু মুসলিমের সর্ম্পক ছিল মধুময়। কোন সা¤প্রদায়িকতার দাঙ্গা ছিল না, ছিলনা কোন বর্বর নির্যাতন।
তাহলে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ কোন তথ্যর ভিত্তিতে বলে থাকেন মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা ! এটা তাদের মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করেন বর্তমানকালের গবেষকগণ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



