somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শূণ্য পূর্ণ অনুভূতি

২২ শে জুন, ২০১০ দুপুর ১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বয়স বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে।আকুতি মিনতি করেও থামানো যাচ্ছেনা ঘড়ির কাঁটাটাকে। এই অনুভূতিটা কেমন হতে পারে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তবে মাঝে মাঝে যখন স্মৃতি নিজের সাথে প্রতারণা করে তখন অজানা আশংকায় কেঁপে উঠি। তবে কি আসলেই বয়স বাড়ছে? সময় গুলো সত্যি সত্যিই কি তবে হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে? যায় দিন সবসময়ই নাকি ভালো। ভালো দিনের স্মৃতিগুলো যদি এভাবে ভুলে যাই তাহলে কি চলে? কত কত খারাপ সময় অনায়াসে কাটিয়েছি এই ভালো ভালো একটি দুটি ছোট বড় স্মৃতি মনে করে। অতি ব্যস্ত জীবনে, নতুন নতুন চাপে পিষ্ঠ হয়ে, অপ্রয়োজনীয় তথ্যে ভারী হয়ে যাচ্ছে ডাটাবেজ। সময়ের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে আসছে প্রসেসর। আর আগের মতন গভীরে যেতে পারে না। তাই এই নতুন সিরিজ লেখার অপপ্রয়াস। যখন যা মনে আসবে তাই লিখে ফেলব। এই লেখার কোথাও এতটুকুও সাহিত্য খুঁজতে যাবেন না প্লীজ।এটা হলো শূণ্য পূর্ণ অনুভূতির সংকলন। আর আজকের পর্বের নাম ‘বিদায়’।

বিদায় শব্দটা জুড়েই আছে বিষন্নতা। মন খারাপের বার্তা বাহক যেন।খেয়াল করে দেখবেন, আপনি চিনেন না জানেন না, এমন কেউ বিদায় নিয়ে যাচ্ছে, শুনলেও কোথায় যেন একটা হাল্কা অনুভূতি হয়।জানিনা সবার হয় কিনা,আমার হয়।আমার স্বভাবটা হলো অনেকটা শেকড় গজানো টাইপ। যেখানেই বসি একটা শেকড় গজিয়ে যায়। হুট হাট বদলানো ব্যাপারটা আমার একেবারেই অপছন্দ।ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলেও ব্যবহারের জিনিষগুলো ফেলে দিতে কেমন যেন মায়া লাগে। সেদিন ড্রয়ার খুলে দেখি একগাদা কলম জমে গেছে, যার একটা দিয়েও লেখা যায় না।একগোছা কলম একসাথে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। এই জড় বস্তগুলোকে বিদায় বলতেও বেশ কষ্ট লাগলো। এই কারনেই হয়তো এই ছোট্ট জীবনেও অনেক অনেক কষ্টদায়ক বিদায়ের স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াই প্রতিদিন এই শহরের রাস্তা ঘাটে।

একটাই স্কুল ছিল আমার। বুঝতেই পারছেন,হাফপ্যান্ট থেকে শুরু করে হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পড়া, আর একটু একটু করে বেড়ে উঠার সেই দুর্দান্ত সময়ের পুরোটাই আমি কাটিয়েছি একি স্কুলে। জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর দারুন সেই সময় শেষ হয়ে যখন স্কুল ছেড়ে যাবার সময় হলো, মনে হচ্ছিল আমি যেন ঠিক তখনো প্রস্তুত ছিলাম না। বিদায় অনুষ্ঠানটা অনেক কষ্টে শক্ত থেকে পার করে দিয়েছিলাম। বয়সের সাথে সাথে কষ্ঠ চেপে রাখাটাও যেন শিখে গিয়েছিলাম একটু একটু করে। বিদায়ের পরে আমাদের একটা ট্রেডিশন ছিল, পরীক্ষার আগে যেকোন একদিন স্কুলে গিয়ে সব টীচারদের কে সালাম করে আসা। আমরা সবাই দল বেধে গেলাম সেদিন। আর যাবার আগে সবাই সবাইকে হুমকি দিলাম। কেউ যেন কান্না কাটি করার চেষ্টা না করে। তারপর একে একে ক্লাসে গিয়ে স্যার ম্যাডামদের সালাম করে আসছিলাম। আমাদের খুব সিনিয়র একজন ম্যাডাম ছিলেন। রাশভারী, ইংরেজির শিক্ষিকা। ওনাকে সবাই খুব সমীহ করে চলত। ছাত্র ছাত্রীদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক টাইপ কোনো ব্যাপার ছিল না তার। বরং সবাই ওনাকে খুব ভয় পেত। স্কুল বিল্ডিং এর একতলার কর্নারের রুমে ক্লাস নিচ্ছিলেন ম্যাডাম। আমি সবার আগে ভেতরে গিয়ে ওনার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। হঠাৎ উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। জানি না কি অদ্ভুত একটা আবেগ ছিল সেই স্পর্শে, ভেতর থেকে টেনে হিচড়ে কষ্টটাকে বের করে নিয়ে আসল। আমি ছুটে পালিয়ে গেলাম। পেছন থেকে জনি দৌড়ে আসছিল আমার পেছনে পেছনে। "কিরে তুই কাদছিস কেন? তুই না বলেছিলি আমরা কাদব না?" তাকিয়ে দেখি জনিও কাদছে। শুধু জনি না। বাবু, রুমন, কিবরিয়া, রিকু, রাশেদ, মুক্তা, তানিয়া, শারমিন, মানিক কেউ বাদ নেই। কান্না একটা সংক্রামক ব্যাধি। সেদিন প্রথম টের পেয়েছিয়াম।

একি কলোনীতে থাকার কারনে স্কুল ছেড়ে গেলেও স্কুলের বন্ধুদের সাথে দুরত্ব বাড়ার অনুভূতি টের পাইনি সেভাবে। বন্ধুদের বিদায় বলার প্রথম ঘটনাটা মনে আছে এখনো আমার। ট্রেনের ভেতরে লাগেজ রেখে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, ফুয়াদ আর দেবু। একটা হাত ফুয়াদ ধরে রেখেছিল। অন্য হাতে ওদের দেয়া বিভূতিভূষনের উপন্যাস সমগ্র। হঠাৎ করেই ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। ফুয়াদের হাত ছেড়ে আমি লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। ঝিক ঝিক শন্দ করে ট্রেন এগিয়ে যায়। ফুয়াদ আর দেবুও আগাতে থাকে। আমি আমার সাধ্যমতন শরীর বাকা করে ট্রেনের হাতল ধরে মাথা বের করে রাখলাম। একসময় ওরা হাপিয়ে উঠে থেমে যায়। আমার শরীরও আর বাকা হয় না। এবার তবে বিদায় বন্ধু, আবার হবে দেখা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য বিদায়ের একটা মজার ব্যাপার ছিল। প্রতিবার কোনো একটা ছুটি হলেই সবাই দল বেধে রেল স্টেশনে। একদল চট্টগ্রামের ট্রেন ধরত, অন্যদল ঢাকার ট্রেন। ঢাকার ট্রেন আগে ছাড়ত। তাই ওদেরকে বিদায় দিয়ে আমরা ট্রেনে উঠতাম। এই বিদায়ে দুঃখবোধ ছিলনা তেমন একটা। বরং একটা মজা ছিল। আস্তে আস্তে মজার সময়টা শেষ হয়ে আসছিল। অসাধারন সময়টাকে বিদায় দিতে হবে। বিদায় দিতে হবে অফুরন্ত প্রাণোচ্ছল একটা জীবন। অসাধারন বন্ধুগুলোকে। এর পর কে কোথায় চলে যায় কিছু ঠিক নেই। বন্ধন ছিন্ন হবার অজানা ভয়। খুব বেশি মন খারাপ থাকতো শেষ সময় গুলোতে। আমার কি মনে হলো জানি না। ঠিক করলাম সবাইকে বিদায় দিয়ে তবেই সিলেট ছাড়ব। খুব বোকার মতন সিদ্ধান্ত ছিল। টের পেলাম হাড়ে হাড়ে। দুপুরে গেল সুমন আর আরাফাত। বাক্স পেটরা গুছিয়ে রুম খালি করে রিক্সায় উঠার আগে শেষ বার সবাইকে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে এলো ওরা। সেদিন আমার মনে হচ্ছিল কান্না চেপে রাখার মতন ভয়াবহ কাজ পৃথিবিতে খুব কম আছে। ভয়াবহতম কাজটা করার কোনো ইচ্ছাই হলো না। হাল্কা হবার জন্য আর চেপে রাখলাম না নিজেকে। ওদেরকে এক প্রকার তাড়িয়ে দিলাম যাতে করে বেশি সময় বিদায় দেখতে না হয়। সামান্য সময় পর সুমনের ফোন আসল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলাম। কোনো কথা নেই। একটা কথাই বললো শুধু। কষ্ট, অনেক কষ্ট। কেমন, তা ঠিক জানা নেই। এর পর একে একে প্রসূন, সজীব, হারুন। তারপর একসময় আমি একা একা ফিরতি পথ ধরি। মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভেসে ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দে একাকী আমার যেই যাত্রার শুরু, একি বৃত্তে বন্দী আমার সেই যাত্রার সেইখানেতেই শেষ।

বয়স বাড়ছে। সাথে সাথে আবেগ অনুভূতি কমছে। আজকাল কোনো কিছুই গায়ে লাগে না আগের মতন। কয়দিন পর পর একজন একজন করে কাছের বন্ধুরা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। হাই হ্যালো, ভালো থাকিস, এইডস বাধিয়ে আসিস না, যোগাযোগ রাখিস টাইপ কথাতেই বিদায় শেষ। চরম ব্যস্ততায় হয়তো সবাইকে সেভাবে বিদায় জানানোর সময়ও পাওয়া যায় না। তবে এই ব্যস্ততার মাঝেও আরো একটা বিদায় চলে এল। নিজের বলেই হয়তো একটু কেমন জানি লাগছে। জীবনে একটা প্রথম ছেড়ে আরো একটা প্রথম অনুভূতির আলিঙ্গনের কাছাকাছি। তবে এই বিষয় নিয়ে অনেক কিছু বলার ইচ্ছা নাই। শুধু এটুকু বলি। প্রফেশনাল জীবনের প্রথম চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা চাকরীতে জয়েন করছি। খারাপ লাগছে চাকরীটা ছেড়ে যেতে। তবে ছেড়ে যেতেই হয়। কলিগদেরকে অনেক অনেক বেশি মিস করবো। কাল এই অফিসে আমার শেষ দিন। আমি ঠিক জানি না কিভাবে সবার কাছ থেকে বিদায় নেব। বিদায় নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরার সময় আমার কতটা কষ্ট লাগবে আমি জানি না। কষ্ট সামলে পরের দিন থেকে আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করার সময়টাতে ওদের কথা অনেক অনেক বেশি মনে পড়বে। ওরা শুধুই আমার কলিগ ছিল না। ওরা হয়তো কলিগের চেয়ে একটু বেশি কিছুই ছিল। এতদিন সেভাবে বুঝে উঠতে পারিনি।

অনেকদিন পর সেদিন জেমস এর কনসার্ট শুনলাম।

যেদিন বন্ধু চলে যাব,
ও চলে যাব বহুদূরে,
ক্ষমা করে দিও আমায়,
ক্ষমা করে দিও।
আর মনে রেখ কেবল একজন ছিল,
ভালবাসত শুধুই তোমাদের।




সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১০ দুপুর ১:২৫
৪৮টি মন্তব্য ৪৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাঘ আর কুকুরের গল্প......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩২

বাঘ আর কুকুর দুটোই হিংস্র এবং সাহসী প্রাণী। বাঘ, কুকুর যতই হিস্র হোক মানুষের কাছে ওরা নেহায়েতই পোষ মেনে যায়। আমাদের সমাজে, রাজনীতিতে অনেক নেতাদের 'বাঘের বাচ্চা' বলে বিরাটত্ব জাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমরা উকিলরা কেউ চিন্ময়ের পক্ষে দাঁড়াবো না , না এবং না

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২




সাবাস বাংলাদেশের উকিল । ...বাকিটুকু পড়ুন

আগরতলায় হাইকমিশনে হামলা কাকতালীয় না কি পরিকল্পিত?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩২

গতকাল (২ ডিসেম্বর) ভোরে আগরতলার হিন্দু সংগ্রাম সমিতির বিক্ষোভকারীদের দ্বারা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের প্রাঙ্গণে হিংসাত্মক বিক্ষোভের পর ন্যাক্কারজনকভাবে আক্রমণ করে। বিভিন্ন তথ্যে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত যে বিক্ষোভকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের সাথে যুদ্ধ করে ভারত লাভবান হবে বলে মনে করি না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০



আমাদের দেশে অনেক মুসলিম থাকে আর ভারতে থাকে অনেক হিন্দু। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধে মুসলিমদের সাফল্য হতাশা জনক নয়। সেজন্য মুসলিমরা ভারতীয় উপমহাদেশ সাড়ে সাতশত বছর শাসন করেছে।মুসলিমরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনূস গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড - শেখ হাসিনা।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৩৬


৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পলায়নের পর বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করা নতুন সরকার কে বিপদে ফেলতে একের পর এক রেকর্ড ফোন কল ফাঁস করতে থাকেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×