somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

দেবদাস বাবু
* বই মনের চোখ খুলে দেয়। বই পড়ি জ্ঞানী হই। সনদধারী উচ্চশিক্ষিত লোকের চেয়ে জ্ঞানী মানুষ অনেক বেশী সম্মানিত |কার কত বেশী সার্টিফিকেট আছে বা নেই, এর চেয়েও বড় প্রশ্ন কে কতটা জ্ঞানী।

শাহ আব্দুল করিম- অবিশ্বাস্য যার জীবনের গল্প! কতটা সহজ, সরল হলে মানুষের জীবন এমন অবিশ্বাস্য হয়!

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল। বছরের একটা বড় অংশ এই অঞ্চলের চারধার ডুবে থাকে জলের মধ্যে। মানুষগুলো একটা বড় সময় জলের মধ্যে আবদ্ধ থাকে বলে এখানকার অনেকেই গান টান করে নিজেদের অলস সময়গুলো কাটান। গানগুলো জলে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার মধ্যে দারুণ কার্যকর। মনকে একটা শান্তির আবহ এনে দেয়। আর আবহমান কাল ধরেই এই জলের ভূমিতে মানুষগুলোর রক্তে মিশে যায় মাটি থেকে নিংড়ানো অনুভূতির গানগুলো। এই ভাটি অঞ্চলের গানের ধারাকে যিনি সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছেন, যার গানের ভাষা এই মাটির, যার গানের কথায় আছে আধ্যাত্মিকতা, যার গানের সহজিয়া সুরে ভাটির মানুষেরা মুগ্ধ হয়েছে দিনের পর দিন, তিনি আর কেউ নন বাউল শাহ আবদুল করিম। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের এক দরিদ্র কুটিরে জন্মেছিলেন শাহ আবদুল করিম। কৃষক ইব্রাহিম আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিলেন শাহ আব্দুল করিম। সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীর ঘেঁষে যে শৈশব কাটিয়েছেন সেটা কখনোই সেই অর্থে সুখকর ছিল না করিমের।

রাখাল বালকের জীবন:-

“ভাবিয়া দেখ মনে
মাটির সারিন্দা রে বাজায় কোন জনে..”

গানটা গাইতেন নসিবউল্লাহ। মানুষটা সংসারবিবাগী। তিনি সম্পর্কে আব্দুল করিমের দাদা হন। দাদার কাছে এমন আরো গান আছে, গানগুলো শুনে আব্দুল করিমের মনে গান সম্পর্কে একটা গভীর ভাব উদয় হয়। কিন্তু, শাহ আব্দুল করিমকে শৈশবেই কাজের সন্ধানে নেমে পড়তে হয়। যখন বয়স মাত্র ১১ কিংবা ১২, শাহ আব্দুল করিম গ্রামের মোড়লের বাড়িতে রাখালবালকের কাজ নেন। বেতন মাত্র দুই টাকা! সারাদিন তার কাজ গরুর দেখভাল করা। গরু চড়ানোর মাঝে মাঝে উদাস মনে গান ধরতেন ভবের বাউল। বর্ষা মৌসুমে রাখালের কাজটা থাকতো না। সেই সব দিনগুলোতে বেঁচে থাকার চাহিদায় মুদি দোকানে কাজ করেছেন। করেছেন কৃষিকাজও। এসবের মধ্যে গান ছিল তার কাছে অক্সিজেনের মতো।

৮ দিনের স্কুল:-

রাখাল বালকের জীবনে পড়ালেখা এসেছিল একবার। বৃটিশ আমলে ভাটি অঞ্চলে একটা নাইট স্কুল হলো। অনেকের মতো শাহ আব্দুল করিম ভর্তি হলেন সেই স্কুলে। কিন্তু, হঠাৎ করেই লোকের ধারণা জন্মালো যে, নাইট স্কুলে পড়লে বৃটিশ সৈন্যদের সাথে গিয়ে জার্মানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। তখন ছাত্ররা পালাতে লাগল নাইট স্কুল ছেড়ে। ফলে নাইট স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। আট দিন এই স্কুলে ক্লাস করে শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটলেও শাহ আব্দুল করিম নিজ উদ্যোগে কিছু কিছু শিখেছেন, তবে তিনি সবচেয়ে বেশি শিখেছেন জীবন থেকে, মাটি থেকে, মানুষ থেকে।

গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া:-

করিম নিজের গ্রামের মানুষের কাছে কাফের উপাধি পেয়েছিলেন শুধু মিথ্যা না বলতে না চাওয়ায়। শাহ আব্দুল করিমকে নিজ গ্রাম ছাড়া হতে হয়েছিল শুধু তিনি গান গেয়ে থাকেন এ কারণে। এক ঈদের দিনে যুবক শাহ আব্দুল করিমকে দেখা গেল ঈদের জামাতে। ইতিপূর্বেই তিনি গান বাজনা করেন এই প্রচারটি গ্রামে বেশ চাউড় হয়ে আছে। ফলে, অনেকেই তাকে যেমন পছন্দ করত, তেমনি অনেকেই এই গান বাজনার অভ্যাসকে ভীষণ অপছন্দ করত। ঈদের দিনের জামাতে তাই করিমকে বাধা দেয়া হলো। তাকে বলা হলো, গান গাওয়া বেশরা-বেদাতি কাম। করিম যেন সকলের সামনে তওবা করে।

শাহ আব্দুল করিম অবাক হলেন। নিজ গ্রামেই এই কথা শুনবেন ভাবেননি। তিনি শান্ত এবং দ্বিধাহীনভাবে বললেন,

“পরে করিব যাহা এখন যদি বলি করব না,
সভাতে এই মিথ্যা কথা বলতে পারব না।”

করিম বলতে চেয়েছিলেন, তওবার খাতিরে এখন যদি বলেন তিনি আর গান গাইবেন না, সেটা তো সত্য না। গান ছাড়া তিনি তো থাকতে পারবেন না। এই দরিদ্র, নিস্তরঙ্গ জীবনে আছে কি শুধু, গানটা ছাড়া! কিন্তু, আব্দুল করিমের উত্তরে গ্রামবাসী হতাশ হলো। আর তখনই শাহ আব্দুল করিমকে কাফের আখ্যা করে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সত্যি সত্যিই তাকে নিজ গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল সেই সময়।

গন্ধা গ্রামের দিনগুলো:-

গ্রাম ছাড়বার পর শাহ আব্দুল করিম গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। বলতে গেলে তখন তিনি এক ছন্নছাড়া যুবক। এই সময় তিনি অস্থায়ী বসত গেড়েছিলেন গন্ধা গ্রামে। গন্ধাগ্রাম পড়ালেখায় পশ্চাদপদ হলেও এ গ্রামে গান-বাজনার ঐতিহ্য বেশ পুরনো। প্রতিদিনই কারো না কারো উঠানে গানের আসর বসতোই। আব্দুল করিমের এই গ্রামে একটা অবস্থান তৈরি হলো তার গায়কীর জন্য।
গ্রামে তিনি এক রুপসী বিধবার বাড়িতে থাকতেন। যাকে লোকে আলতার মা বলে ডাকতো। এখানে জীবনের উত্থানপর্বের বেশ কিছু দিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন শাহ আব্দুল করিম। যদিও, তার খ্যাতি ছড়িয়ে যাবার পর রহস্যজনকভাবে এই গ্রামের সাথে তার সম্পর্ক একেবারে হুট করেই শেষ হয়ে যায়। এই গ্রামের কথা তার কোনো স্মৃতিচারণেও সেভাবে পাওয়া যায় না।

প্রথম বিয়ে- প্রথম প্রেম:-
শাহ আব্দুল করিম বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম কাচামালা। কিন্তু, সেসময় তিনি চুটিয়ে প্রেম করছেন, তার প্রথম প্রেম সম্ভবত একমাত্র- গানের সাথে। গান লিখছেন, গান বাঁধছেন, গান গাচ্ছেন। নানান জায়গায় গানের আসর বসে। মজমার মধ্যে থেকে থেকে রাত ভোর হয়। মনেই থাকে না, ঘরে তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী। এই অবস্থায় প্রথম বিয়ে বেশি দিন টিকলো না, প্রথম প্রেমের কাছে। শ্বশুরবাড়িতে শাহ আব্দুল করিমকে ডাকা হলো। তাকে শর্ত দিয়ে বলা হলো, যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে। হয় বউ নয়ত গান। বউ চাইলে গান চাইতে পারবে না। শাহ আব্দুল করিম বউকে ছেড়ে দিলেন৷ হয়ত তিনিও জানেন, জোর করে সংসার করে মেয়েটার উপর অবিচার করা হবে, তাকে সময় দিতে পারবেন না। তিনি তো সাময়িক সুখ, স্বস্তি পেতে মিথ্যার আশ্রয় নেন না। এটা তো আগেও দেখিয়েছেন ঈদের দিনে, আরো একবার সেটাই করলেন। তার গানের মতোই তার জীবন-

গান গাই আমার মনরে বুঝাই, মন থাকে পাগলপারা
আর কিছু চাই না মনে গান ছাড়া..

ভবের মূর্ছনায় ছুঁয়ে যাওয়া দিন:-
আব্দুল করিম এখন দিনরাত গান করেন। দিগ্বিদিক থেকে তার গানের বায়না আসে। দূর-দূরান্তের প্রান্ত থেকে অনেক গান শুনতে আসে। তারা আব্দুল করিমের সহজ কথার গান শুনে ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়। আব্দুল করিমের গান শুনে আপ্লুত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। বঙ্গবন্ধু একবার সুনামগঞ্জে এসেছিলেন। শাহ আব্দুল করিমের সাথে তার সাক্ষাত হলো। আব্দুল করিম বঙ্গবন্ধুকে গান শোনালেন। বঙ্গবন্ধু চিরকালই একটু আবেগী, শিল্পের প্রতি খানিকটা দূর্বলতা তার চিরায়ত। শাহ আব্দুল করিমের গান শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে। এই মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বেঁচে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
বঙ্গবন্ধু আব্দুল করিমের গানের কথা জানিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীকে। মাওলানা সাহেব কাগমারি সম্মেলনে আব্দুল করিমের গান শ্রবণ করেন, তিনি আব্দুল করিমকে আশীর্বাদ দিয়ে বলেন, আব্দুল করিম অনেক বড় শিল্পী হলেন। কিন্তু, যতটা বড় তিনি কর্মে, ততটা হয়নি তাকে মূল্যায়ন। বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ অসময়ে না হলে হয়ত সত্যিই আব্দুল করিমের কদর আরো বেশি হতো। যতটুকু প্রাপ্য তার, ততটুকু তিনি তো কখনোই পান নি সে অর্থে। যা কিছু প্রাপ্তি তা হলো, জনমানুষের অগাধ ভালবাসা। যেখানে যাকে গান শুনিয়েছেন, সেই সহজ গানের গভীর কথার ভেতর হারিয়েছে। তিনি বাউল কি না এই নিয়ে একবার কি হাউকাউ তৈরি হলো। তিনি নাস্তিক কিনা সেই নিয়েও কত আলোচনা। আসলে, তিনি গানটাকে মনের ভাব প্রকাশের ভাষা হিসেবে নিয়েছিলেন। তার গানে আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি যেমন ছিল, তেমনি ভাটি অঞ্চলের নিপীড়িত মানুষের দুর্দশাও তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন গানের কথায়। তিনি বিশ্বাস করতেন স্রষ্টা আছেন, মানুষের মাঝেই আছেন। এই মানবদেহের রহস্য তাকে দিনমান ভাবিয়ে যেতো।



সংবর্ধনা:-
মানুষটা বড্ড সরল ছিলেন। তাকে ঘিরে আলোচনা, উৎসাহ বা বিতর্ক যা কিছুই থাকুক, তিনি থাকতেন এসবের বাইরে। নিজের জগতে। সে জগতে তার চাওয়া পাওয়ার সীমারেখা বড্ড ছোট। একবার সুনামগঞ্জে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার কথা। প্রোগ্রামের শেষের দিকে মাইকে ঘোষণা আসলো, এবারে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার সম্মাননা চেক। আব্দুল করিম বার্ধক্যে উপনীত। তিনি বোধহয় কানে ভুল শুনলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি পাশে বসে থাকা তার একমাত্র সন্তান জালালকে বললেন, জালাল ইতা কিতা কয়! তিন হাজার টাকা! এ তো অনেক টাকা! এত টাকা দিয়ে আমি কি করতাম! আব্দুল করিমকে আস্তে করে জানানো হলো, তিন হাজার নয়, টাকার অংকটা তিন লাখ! শাহ আব্দুল করিম অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হতভম্ব। তিনি বললেন, তিন লাখ? সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল। বলেই তিনি বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন। এই ঘটনার পর এই মানুষটিকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? একজন মানুষ কতটা আর নির্লোভ হতে পারেন!

সরলার প্রেমে মন মজাইয়া:-
প্রথম বিয়েটা ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল শুধু গান ছাড়তে চাননি বলে। সেই আব্দুল করিম দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আফতাবুন্নেসা নামক এক সরল নারীকে। যে নারী তার জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল শুধু সহচর হয়ে থাকার জন্যে। মানুষটিকে আব্দুল করিম ডাকতেন সরলা বলে। সরলা কখনো আব্দুল করিমের কাছে কিছু চাননি। উলটা বরং আব্দুল করিমের গান নিয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন জনমভর। দিনের পর দিন আব্দুল করিম থাকতেন বাইরে বাইরে৷ গ্রামে গঞ্জে আব্দুল করিম থাকতেন গানের বায়না নিয়ে, সরলা কখনো অভিমান করে থাকেননি। এই কারণে সরলার কথা মনে উঠলেই শেষ বয়সে কেঁদে কেটে বিষণ্ণ হয়ে যেতেন আব্দুল করিম। তিনি নিজের স্ত্রীকে মুর্শিদ বলে মানতেন। নিজের স্ত্রীকে মুর্শিদ বলে সম্মানিত করা সহজ কথা নয়। সরলার সাথে আব্দুল করিমের প্রেমের মাহাত্ম্য লিখে বোঝানো কার সাধ্য। আব্দুল করিম এমনিতে আর্থিক ভাবে কখনোই তেমনটা স্বচ্ছল ছিলেন না। তিনি যখন ঘরবিবাগী হয়ে গানে গানে মানুষের মন মাতাতেন, তখন সরলা অনাহারের সাথে যুদ্ধ করতেন। এমনও সময় গেছে যখন সরলা একটু খাবার যোগাড়ের তাড়নায় মানুষের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কাজ করে ভাতের পয়শা উপার্জন করতেন। তবুও এসব কখনো আব্দুল করিমকে বুঝতে দিতেন না। সংসারের সমস্যা নিয়েই যদি আব্দুল করিমকে মাথা ঘামাতে হয় তিনি গান বাঁধবেন কখন, সংসার নিয়ে ভাবতে গিয়ে আব্দুল করিমের মনের খাদ্য গানের উপর প্রভাব পড়ুক এমনটা কখনো চাইতেন না সরলা। মানুষটাকে আব্দুল করিম কখনো কিছু দিতে পারেননি, উলটা সরলাই তাকে বলতেন, “আমি যদি আপনাকে আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে বেঁধে রাখি, আপনি বাইরে যাবেন কেমনে? আর আপনি যদি বাইরের মানুষের সঙ্গে না মেশেন, তবে জগৎ চিনবেন কেমনে আর গান বানাইবেন কেমনে?” একজন নির্লোভ মানুষ কতটা ভাগ্যবান হলে এমন নির্লিপ্ত স্বার্থহীন এমন প্রেয়সীর দেখা পান! এই প্রেমের গল্প হয়ত ইতিহাসে অমর হবে না, কিন্তু, এই প্রেমটা ভীষণ রকমের সত্যি। ভীষণ রকমের অদ্ভুত।

সরলার মরণ:-

সরলা যেদিন মারা গেলেন সেদিনও কাছে কিনারে ছিলেন না শাহ আব্দুল করিম। তিনি তখন পড়ে আছেন, কোনো গানের আসরে। যখন জানলেন তখন কেমন অনুভূতি হয়েছিল তার! কে জানে। যদিও এক জীবনে তিনি সরলার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ব্যাপারটা ভুলতে পারেননি কখনো আর। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন যখন দেখলেন তিনি গান বাজনা করেন দেখে সরলার লাশ জানাজার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, বাউলের স্ত্রীর আবার কিসের জানাজা, বাউলার স্ত্রীর জানাজা পড়ানোর দরকার নেই। আব্দুল করিম নিজেই নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় নিজের স্ত্রীর জানাজা পড়ালেন। সম্রাট শাহাজাহান সূদূর ইতালি থেকে সাদা মার্বেল এনেছেন, ইশা আফিন্দিকে দিয়ে বানিয়েছেন প্রিয়তমার জন্য এক বিশাল মহল, তাজমহল। শাহ আব্দুল করিম ধন দৌলতে সেই বাদশার ধারে কাছেও না, কিন্তু মনের মধ্যে পুষে রাখা যে প্রেম সেটা যে সত্য। করিম নিজ হাতে বানিয়েছেন সরলামহল, যে ঘরে শুয়ে আছেন প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা। এখানে হয়ত কোনো কোনো দিন নিজেই আপন মনে গান গেয়ে উঠতেন, কেনো পিরীতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি..

কিংবা গাইতেন,

“দুঃখে আমার জীবন গড়া, সইলাম দুঃখ জনমভরা
হইলাম আমি সর্বহারা এখন যে আর নাই বেলা
আর জ্বালা, আর জ্বালা সয়না গো সরলা..”

ধর্মবিশ্বাস:-

আব্দুল করিম গান করেন বলে বার বার মৌলবাদের লক্ষ্যের বস্তু হয়েছিলেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে গভীর বেদনা নিয়ে তিনি বলেন,
“সবার উপরে মানুষ সত্য এটাই আমার ধর্মবিশ্বাস। কতিপয় কাঠমোল্লা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আমার এলাকায় প্রতিবছর শীতের রাতে ওয়াজ মাহফিল হয়। দূর দূরান্ত থেকে বিশিষ্ট ওয়াজিরা ওয়াজ করতে আসেন। তারা সারারাত ধরে আল্লাহ-রসুলের কথা তো নয়, আমার নাম ধরে অকথ্য গালিগালাজ করতেন। কি আমার অপরাধ? গান গাইলেই কি কেউ নর্দমার কীট হয়ে যায়?
এই মোল্লারা ইংরেজ আমলে ইংরেজি পড়তে বারণ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানের পক্ষে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, আজো তারা সমানতালে তাদের দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে মনে হয় একাই আবার যুদ্ধ করি। একাই লড়াইয়ের ময়দানে নামি। জীবনের ভয় করি না আর।” তার সাথে গান করত, এক শিষ্য, যার নাম আকবর। অকালে মারা গেল সে। আকবরের মৃত্যুর খবরটা মাইকে ঘোষণা দেয়ার জন্য আব্দুল করিম অনুরোধ করলেন ইমামকে। ইমাম তাকে জানালো, করিম যদি তাকে হাত ধরে তওবা করে তাহলে জানাজা পড়ানো হবে, নয়ত না। গান গায় কাফিররা। করিমের সাথে থাকতে থাকতে আকবরও বেদাতি কাজকর্ম করে। সেও কাফির। তার জানাজা পড়ানো সম্ভব নয়। করিমের মনে আঘাত লাগলো সেদিন খুব। আতরাফের সবাই ইমামকে রাখার জন্য যে বার্ষিক চাঁদা দেয়, সেই চাঁদার একটা ভাগতো করিম নিজেও দেন। তবুও কেনো এই ব্যবহার? করিম অতঃপর ক্লান্ত যন্ত্রণাকাতর মনে নিজেই আকবরের জানাজা দেন।

গানের জাদুকরের সাথে শব্দের জাদুকর:-
একবার হুমায়ূন আহমেদের একটা প্যাকেজ প্রোগ্রামে ডাক পান শাহ আব্দুল করিম। তার সাক্ষাৎকার নেয়া হলো। কিন্তু ফিরবার সময় হুমায়ূন আহমেদের সাথে সৌজন্য দেখা হলো না তার। এই নিয়ে হয়ত মনের কোথাও আক্ষেপ জমেছিল আব্দুল করিমের। এই ঘটনা প্রসঙ্গে আব্দুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালাল বলেন,

“বিদায়ের সময় ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা দিয়েছিলেন, তিনি নিজে একবার বাবার সঙ্গে দেখাও করলেন না।”
অবশ্য হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে শাহ আব্দুল করিমের গান বেশ পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, “এই লোকটি প্রাচীন ও বর্তমান এই দুইয়ের মিশ্রণ। তাঁর গানে সুরের যে ব্যবহার, তা খুবই বৈচিত্র্যময়।” তাছাড়া, বাংলাদেশ টেলিভিশনে শাহ আব্দুল করিমের গীতিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পেছনে হুমায়ূন আহমেদের অবদান ছিল। কারণ যে প্রোগ্রামটি তিনি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে, সেটি জমা দেয়ার পর জানতে পারেন যেহেতু শাহ আব্দুল করিম বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার নন, তাই বিটিভি প্রোগ্রামটি প্রচার করতে চাচ্ছে না। হুমায়ূন আহমেদ তাই এই শিল্পীকে বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার করে নেয়ার পরামর্শ দেন।

আত্মমর্যাদা মিশে ছিল তার আত্মায়:-
আব্দুল করিম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক পেয়েছেন। তাকে ঘিরে কমার্শিয়াল আয়োজন করে অনেকে নিজের নাম প্রচার করেছেন বিভিন্ন সময়। সরল মনের শাহ আব্দুল করিম সেইসব বুঝতেন কদাচিৎ। তাই পদক টদক নিয়ে তার উচ্ছ্বাসও ছিল কম। পদক দিয়ে কি আর জীবন চলে! তিনি বলেন, “পদক আনতে শহরে গেছি, আইবার সময় পকেটে টাকা নাই। এই পদক-টদকের কোন দাম নাই। সংবর্ধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না।” আজন্ম তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন মানুষের ভিতরকার নিগূঢ় সত্য। নিজের দিকে তিনি কখনো নজর দেননি সেভাবে। মানবিক আত্মমর্যাদাবোধই তার কাছে বড় কথা। কিন্তু, এজন্যে তাকে বিভিন্ন সময় অপদস্থও হতে হয়েছে।
একবার তিনি রেডিও’র একটা চেক ভাঙ্গাতে গেলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। আব্দুল করিমের পরনে ছেঁড়া পাঞ্জাবি। তাকে দেখে ব্যাংকের কেউ কি ভেবেছে কে জানে! কিন্তু আব্দুল করিম ভীষণ অপমানিত বোধ করেছেন। তিনি বিলাতে গান গাইতে গিয়েছেন। সেখানে দেখেছেন, মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু নিজের দেশে দেখলেন এখানে মানুষের মর্যাদা পদ পদবিতে, পোষাকে, চেহারায়।

সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন,
আমার পাঞ্জাবি ছেঁড়া তো কি হয়েছে, আমি কি এই দেশের নাগরিক না? আমার লুঙ্গিতে নাহয় তিনটা তালি বসানো, কিন্তু আমি তো ট্যাক্স ফাঁকি দেই নাই কখনো। তাহলে এত ব্যবধান, এত বৈষম্য কেন? মানুষ তো মানুষের কাছে যায়। আমি তো কোনো বন্যপশু যাইনি। বন্যপশুরও অনেক দাম আছে, এদেশে মানুষের কোনো দাম নেই, ইজ্জত নেই। আব্দুল করিমের গানের কথা অনেকে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন সময়। রিমিক্স করেছেন, নিজের মতো গেয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। অথচ, কেউ কখনো আব্দুল করিমের কাছে অনুমতি নিতে আসেননি। কমার্শিয়াল প্রয়োজনে ব্যবহার করা আব্দুল করিমের গানের জন্য তিনি নিজে কতটুকু সম্মানিত হয়েছেন? এমন অনেক গান আছে, মানুষ শুনেছে, মুগ্ধ হয়েছে, কিন্তু জানেও না সেসব শাহ আব্দুল করিমের গান।
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো

২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ভাটি অঞ্চলের মানুষেরা জানতে পারলো, তাদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় বাউল শাহ আব্দুল করিম আর নেই। চিরনিদ্রায় ডুবে গেছেন খানিক আগে। শোকের ছায়া নেমে আসলো চারধারে। চোখের জলে ভাটি অঞ্চলের মাটিতে আজ রচিত হচ্ছে শোকগাঁথা।

আব্দুল করিমের লাশ রাখা হয়েছিল শহীদ মিনারে। সেখানে অগণিত মানুষ এসেছেন মানুষটাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি গানের মানুষ। তাই তার শেষ শ্রদ্ধায় তাকে তার রচিত গান দিয়েই অশ্রুজলে বিদায় দেয়া হলো।

শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম প্রিয় দুই শিষ্য আবদুর রহমান ও রণেশ ঠাকুরের নেতৃত্বে বাউলেরা শহিদ বেদিতে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে খালি গলায় গাইতে শুরু করলেন, কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু ছেড়ে যাইবায় যদি…

এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, এমন বিদায় কে দেখেছে কবে আর!

কিন্তু শাহ আব্দুল করিমের জন্য যে অপেক্ষায় তার ভাটি অঞ্চলের মানুষরাও। তাকে নিয়ে যাওয়া হবে তার নিজভূমিতে।

বেলা দেড়টা। ধলগ্রামের উদ্দেশ্যে একসাথে বেড়িয়েছে অনেকগুলো নৌকার বহর। একটি নৌকা অবশ্য বেশ বড়। আলাদা করে চোখে পড়ছে। সেই নাওয়ের ছাদের অনেক ফুলের মালা। যেন একটা ফুলের কুঞ্জ। এই নৌকায় সওয়ারি হয়েছেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। নৌকা যাচ্ছে উজানধল গ্রামের দিকে। নৌকার বহরের যাত্রা গ্রামের মসজিদের দিকে। কথা আছে সেখানে হবে, এই বাউলের তৃতীয় জানাজা।

ভাগ্যের কি ফের। যে মসজিদে ঈদের জামাত পড়তে চেয়ে তিনি হয়েছিলেন অপরাধী, আজ সেই মসজিদেই হচ্ছে তার লাশের জানাজা। যেখান থেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তিনি গ্রাম ছেড়েছিলেন যৌবনে, জীবন সায়াহ্নে নিয়তি তাকে সেখানেই এনে থামিয়েছে আবার।

যে মানুষটাকে নিজের মুর্শিদ জ্ঞান করতেন, যাকে জীবদ্দশায় সময় দিতে পারেননি, স্বস্তি দিতে পারেননি, মরণকালে সেই প্রিয়তমা সরলার পাশেই তাকে শায়িত করা হলো।

* জীবন নিয়ে মানুষটার বিবিধ রকমের ভাবনা ছিল। নিজের শরীরকে নৌকার সঙ্গে তুলনা করতেন। গান লিখেছিলেন,

“তুমি সুজন কান্ডারি নৌকা সাবধানে চালাও,
মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খি নাও..”

চিরকালের যে গন্তব্য, সেই গন্তব্যের আর কতটা পথ বাকি? ময়ূরপঙ্খি নাওয়ের মাঝি আপনি যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন। আমরা শুধু ভেবে যাই, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:২১
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×