প্রথম ডাক ধরতে হবে এমনটা ভাবতে ভাবতে পুলক পোস্ট অফিস যায়। এত সকালে এসেছে বলে ভিড় কম। অফিসের লোকজনও তেমন একটা আসেনি। দিনের আলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে বারান্দায় জ্বলা লাইটগুলো এখনো জ্বলছে।
কাউন্টার থেকে ইনভেলপ নিয়ে ঠিকানা লেখার জন্য পকেটে হাত দিতেই বুঝে গেল তাড়াহুড়োর কারণে পেনটা ছেড়ে এসেছে। এদিক ওদিক তাতেই চোখে পড়লো একজন ভদ্রলোক। দেখে মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষায় আছেন।
পুলক ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে ছালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, চাচা আপনার কাছে কি পেন হবে?
ভদ্রলোক ছালামের জবাব দিয়ে বললেন হ্যাঁ বাবা, দিচ্ছি।
“হ্যাঁ বাবা দিচ্ছি” কথাটা এমন আবেশ ছড়ালো পুলকের মনে, যেন কেউ আদর করে দিল। ঠিকানা লেখা শেষে পেনটা ফিরিয়ে দিতেই চাচা বললেন, বাবা যদি কিছু মনে না করো আর যদি একটু সময় হয় তাহলে আমার একটা ঠিকানা লিখে দিবে ? আমি চশমাটা ভুলে ছেড়ে এসেছি।
পুলক বলে ছি..ছি.. এমনভাবে বলছেন কেন, এ আর এমন কি কাজ দিন লিখে দিচ্ছি। ঠিকানা লিখতে লিখতেই দু’জনের কথা শুরু হলো, চিঠি বক্সে ড্রপ করার পরও কথা চললো ১ ঘন্টা ২৫ মিঃ পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে তাদের অনেক কথা হলো।
চাচার অমায়িক ব্যবহার আর স্নেহশীলতা পুলককে রীতিমত অভিভুত করেছে। ভদ্রলোকের নাম তানভির রহমান।
বিদায় বেলায় পুলক মানি ব্যাগ থেকে একটি কয়েন বের করে তানভির সাহেবের দিকে হাত বাড়াতেই ভদ্রলোক বলেন, পেন ধার দিয়ে পয়সা নিতে হয়, এমন তো শুনিনি কখনো!
পুলক কাচুমাচু করে বলে, চাচা ব্যাপারটা তা নয়; যাকে আমার খুব পছন্দ হয় শুধু তাদেরকেই এই ধরনের কয়েন দেই, যেন আমাকে মনে রাখে। তানভির সাহেব হাসিমুখে কয়েনটি নিয়ে আগ্রহভরে উল্টেপাল্টে দেখে খুব যত্নসহকারে পকেটে রেখে দিলেন।
আজ অনেক দিন পর বাড়ী ফেরার পালা। কমলাপুর স্টেশনটাকে আজ খুব ভাল লাগছে। কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো, একটু আগে পেরিয়ে আসা গেটটা তার পরিচিত, নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা পিলারগুলো পরিচিত, স্টেশনের ফাঁকা জায়গাও পরিচিত। এখনো খুঁজলে হয়তো ১০ বছর আগে ছেড়ে যাওয়া নিঃশ্বাসটা তার শরীর স্পর্শ করবে।
সবসময় ফিটফাট থাকা পুলকের একটা স্বভাব। আধুনিকতার সবকিছুই আনন্দভরে উপভোগ করে তারপরও কিছুকিছু সময় স্মৃতির হাত ধরে হাঁটতে তার বেশ ভাল লাগে।
কপালগুনে জানালার পাশেই সিট পেল। আজ যেতে যেতে দেখবে, তার দিকে ধেয়ে আসা শহর, গ্রাম, গাছপালা আর মেঠো পথ। রাত নামলে দেখবে জোনাক পোকার মত দুরের বাতি আর মেঘের সাথে তারার লুকোচুরি। আর চিন্তা করতে পারছে না, সব চিন্তাকে মাথার সাইড পকেটে রেখে ট্রেনের দিকে এগিয়ে চললো।
নির্দিষ্ট কামরায় উঠে সিট খুঁজে বসে পড়লো, এখন অপেক্ষা শুধু ট্রেন ছাড়ার। পকেট থেকে হেডফোন কানে দিয়ে পছন্দের গান ছেড়ে দিল। গান শুরু হতেই পুলকের চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। এটা তার ছোটবেলার অভ্যেস। চোখ বন্ধ করে গানের মাঝে না ঢুকলে তার ভাল লাগে না। চতুর্থ গান শুরু হতেই চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বুঝলো তার পাশে কেউ বসেছে। মিনিটখানিক পর ট্রেনটা দোলা দিয়ে চলতে শুরু করলো। ধেয়ে আসছে বাতাস, যেন সারাদিনের ক্লান্ত শরীরের ঘামগুলো মুছে দিয়ে যাচ্ছে।
কাঁধে স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলতেই দেখলো সামনে টিটি আর পাশে বসা একটা মেয়ে। এতক্ষন ধরে একটা মেয়ের পাশে বসে যাচ্ছে খেয়ালই করেনি। টিকেট দিয়ে বসতে যাবে এমন সময় মেয়েটি বললো, ভাইয়া আমি কি জানালার পাশে বসতে পারি? কি রে বাবা, কথা নেই বার্তা নেই একেবারে ডাইরেক্ট সিট দখল! উপায় নেই সুন্দরী বলে কথা, এক কথাতেই সিট বদল।
মুখে প্রশান্তি ছড়িয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লো মেয়েটি। কি আশ্চর্য মেয়েটি বসে আকাশের দিকে তাকাতেই পুলকের হেডফোনে জেমসের ভরাট কন্ঠে শুরু হলো “সুন্দরীতমা আমার, তুমি নিলীমার দিকে তাকিয়ে বলতে পারো এই আকাশ আমার”। মেয়েটিকে এক নজর দেখে আবার চোখ বন্ধ করে গানে বুদ হয়ে রইল। গাড়ী কতক্ষণ চলেছে কে জানে। গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়েছিল। ট্রেনের গতির সাথে অভ্যস্ত হওয়া শরীর গতির ছন্দপতনে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে যায় পুলকের। হেডফোনে তখন গেয়ে যাচ্ছে আইয়ুব বাচ্চু “এখন অনেক রাত খোলা আকাশের নিচে”। আসলেই তো তাই, খোলা আকাশের নিচে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়িতে সময় রাত ১.৪৫ । কি ঘটনা ঘটলো, এমন নির্জন জায়গায় ট্রেন দাঁড়ালো কেন ? হেডফোন পকেটে রেখে লোকজনের কথা শুনে বুঝলো সামনে এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। লাইন ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই থাকতে হবে।
লোকজন ট্রেন থেকে নামতে শুরু করেছে। পুলকও নেমে পড়লো, তার ইচ্ছা আশেপাশে কোন চায়ের দোকান আছে কিনা খুঁজে বের করা। দুরে একটা দোকান দেখা যাচ্ছে। ট্রেনের যাত্রী যারা আগে নেমেছে সবাই ওদিকেই চলছে। চা খেয়ে কামরার দিকে ফিরে এসে ইচ্ছে হলো না ভিতরে বসার। বাহিরে চমৎকার পরিবেশ, আজ গুরু পূর্ণিমা ।
অস্বস্তিতে বসে আছে মেয়েটি। সে না পারছে যাত্রীদের স্রোতে ভাসতে, না পারছে একা চুপচাপ বসে থাকতে। লোকজন ওঠানামা করছে আর তার দিকে বাঁকা চোখে দেখছে। যখন দেখলো সিট ছেড়ে দেয়া ছেলেটি আসছে তখন সে একটু স্বস্তি পেল। সামনে বসা যাত্রীর চেয়ে অনেক ভাল, গায়ে পড়া স্বভাব নেই। অন্তত এখন পর্যন্ত দেখায়নি। সিদ্ধান্ত নিল যতক্ষণ গাড়ী না ছাড়ছে ততক্ষণ ওর পাশাপাশি থাকবে।
পুলক কামরার কাছাকাছি একটু দুরে একটা কাটা গাছের গুড়িতে বসতে যাবে এমন সময় দেখলো সিট দখলী মেয়েটা এগিয়ে আসছে, এবার কি গাছের গুড়িটাও ছাড়তে হবে!
মেয়েটি বললো, আমার নাম মনি। একা একা ভয় লাগছে তাই আপনার কাছে এলাম। এখানে একটু বসতে পারি ? পুলক নিজের পরিচয় দিয়ে মনিকে বসতে অনুরোধ করলো। এক কথা দুই কথাতে তাদের গল্প জমে উঠলো। ট্রেনে উঠেও তাদের গল্প চললো।
এদিকে ভোরের আলো ফুটেছে পুব আকাশে। পুলক ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মনিকে উদ্দেশ্য করে বলে আর একটু পরেই নামতে হবে, আর দেখা হবে না, তবে স্মৃতিটুকু মনে থাকবে আজীবন। কথাটা বলে মনির দিকে তাকাতেই দেখে মনি হাত বাড়িয়েছে তার দিকে। তার হাতে রয়েছে একটি কয়েন। পুলকও তার হাতটা বাড়িয়েছিল মনিকে কয়েন দেয়ার জন্য। দুজনেই হতবিহ্বল! দুজনের হাতে একই ধরণের কয়েন।
আজ থেকে ৮ বছর আগে মনি তার বাবার কাছে সুন্দর কয়েন দেখে জিজ্ঞেস করায় কয়েন পাওয়ার ঘটনাটি বলেছিলেন। এর মাস কয়েক পর তার বাবা মারা যায় এবং তার পর থেকে সুন্দর কয়েনটি সে তার সাথেই রেখে দিয়েছে। এখন দেখতে পাচ্ছে তার বাবার থেকে পাওয়া হুবহু সেই একই কয়েন পুলকের হাতে। এক মুহুর্তের জন্য দু’জনেই স্তব্ধ।
ঘোর কাটলো মনির আগে, সে বললো আপনিই কি সেই, যাকে আমি এতদিন ধরে খুঁজছি?
ছবি
{পেছনের কথাঃ ২০১৮ সালে নতুন গল্প লেখার জন্য ব্লগার মোঃ নিজাম উদ্দিন মন্ডল উৎসাহ জুগিয়েছিলেন সেই প্রেক্ষিতে গল্পটির জন্ম তবে তা প্রকাশিত হয়নি সে সময়। গল্পে পুলকের জায়গায় মোঃ নিজাম উদ্দিন মন্ডলের নাম ছিল। নতুন করে এডিট করে প্রকাশ করা হলো।}
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৪৯