শনিবার, সকাল ৮টা । একটানা একঘেয়ে ছন্দে শব্দ করে যাচ্ছে তিথীর মোবাইল। বরাবরের মতই তিথীর মনে হচ্ছে, ঘুমের মধ্য স্বপ্নে বিশ্রী যান্ত্রিক শব্দ শুনছে সে। এক মিনিট পরেই পাশে থেকে তিথীর বোনের মেয়ে চার বছরের পিচ্চি আইনা, তিথীর কাধে জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিয়ে বলে-"খালামনি উঠে পড়, উঠে পড় সোনা"। ধড়মড় করে উঠে বসে তিথী। হাত বাড়িয়ে বালিশের উপরের দিকে রাখা মোবাইলের রেড বাটনে চাপ দেয়। আইনা হিহি করে হেসে বলে- "খালামনি আজকে ও তুমি অ্যালা'মের শব্দে উঠতে পারলে না, আজকেও আমি উঠলাম তোমার আগে"। তিথী আইনার কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে বলে- "এইজন্যই তো তুমি আমার লক্ষী আম্মু"।
শুক্র, শনি তিথীর ছুটির দিন। ঘুম কাতুরে তিথীর ক'মজীবনের ব্যাপ্তি মাত্র দুই মাসের। এরিমধ্যিই তিথী বিরক্ত অফিস জীবনের উপর- কারন ঘুম এবং সিরিয়াল মিস করা সপ্তাহের পাঁচ দিনে। শুক্র, শনিতে তাই তিথীর ঘুম চলে সকাল দশটা-এগারটা প'যন্ত কখনো তা দুপুর বারটা প'যন্ত ছুয়ে যায়।
দাঁত ব্রাশ করতে করতে তিথী ভাবে, আটটা পনের মত বেজে গিয়েছে, নয়টার মধ্য আসাদ গেইট বাস স্টেশনে দাঁড়াতে হবে এবং দশটার মধ্য ক্যাম্পাসে পৌছতে হবে। দশটা পনের মধ্য মতিন স্যারের সাথে দেখা করতে হবে, স্যারের আজ দুপুরের আগে দশটা পয়তাল্লিশে ক্লাশে আছে একটা এবং দুপুরের পরে আরেকটা। সুতরাং দেখা করতে হলে সকালেই করতে হবে।স্যারের সাথে দেখা শেষ করে আজ সারাদিন ক্যাম্পাসে কাটাবে, জুনিয়র মেয়েদের সাথে হলে গিয়ে আড্ডা দিবে, তিথী মনে মনে ভাবে। চাকরি শুরু করার পর ক্যাম্পাসে যাওয়া হয় নাই। তিথীর পাঁচ বছরের শিক্ষা জীবনে সব থেকে বেশি পছন্দের স্যার ছিল মতিন স্যার এবং তিথীর নিজের মনে হত মতিন স্যার তিথীকে একটু বেশি স্নেহ করে। মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে উচ্চস্বরে বুয়াকে টেবিলে নাস্তা দিতে বলে।
নয়টা পঞ্চাশ ক্যাম্পাস গেট। সূ'য ইতিমধ্যেই গণগণে তাপ বিকীরণ শুরু করেছে। হাতঘড়ির দিকে এক-দুই বার তাকিয়ে এবং দৃস্টির কিছুদূরের মধ্য যখন কোন রিক্সার দেখা নেই, তিথী তখন হাটা শুরু করল পনের মিনিটের হাটাপথ দূরত্ব ডিপা’টমেন্টের দিকে। দুই মিনিট হাঁটার পর এক খালি রিক্সায় পেয়ে যায় এবং সেই রিক্সা দিয়ে দশটার মধ্য ডিপা'টমেন্টে পৌছে যায়।
কিছুক্ষণ পরেই ডিপা'টমেন্টের প্রভাবশালি অধ্যাপক ডঃ আবদূর রহমান মতিন স্যারের রুমের সামনে দাঁড়ায় তিথী । স্যারের রুমের দরজার একটি পা'ট খোলা অন্য পাশ বন্ধ। দরজার খোলা অংশে সাদার উপরে ফুলের ছাপযুক্ত প'দা দিয়ে ঢাকা। বন্ধ দরজার অংশে ত'জনী এবং মধম্য আংগুল দিয়ে আলত শব্দ করে এবং হালকা স্বরে বলে-স্যার আসতে পারি। ভিতর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে- হ্যা আস।
রুমে ঢুকেই হালকা স্বরে তিথী একটা সালাম ঠুকে দেয়- স্লামালেকুম স্যার। টেবিলের দিকে মাথা ঝুকিয়ে রাখা মতিন স্যার মাথা উপরে তুলে এবং তিথীকে দেখে হালকা হাসি দিয়ে বলে- "আরে সানিয়া আহমেদ তিথী, বস সামনের চেয়ারে বস"।
তিথীঃ কেমন আছেন স্যার?
মতিন স্যারঃ ঐতো মা আছি ভাল। তারপরেও বয়স হয়েছে। তবে ক্যাম্পাস এরিয়াতে আছি বলে ঢাকা শহরের পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পেয়েছি। তাই এখনো স্বাস্থ্য অনেক মজবুত।
তিথীঃ আপনার বাসার সবাই ভাল আছে?
স্যারঃ ভাল আছে সবাই। তুমি কি কোথায় জয়েন করেছ?
তিথীঃ জ্বি স্যার।
তারপর ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিটের নীরবতা, তিথী ভাবতে পারছে না কথাটা কিভাবে তুলবে।
তিথীঃ স্যার শুনলাম, আমাদের ডিপা'টমেন্টে সামনের বছরের জানুয়ারিতে ২/৩ জন নতুন টিচার নিয়োগ দেয়া হবে?
স্যারঃ ও হ্যাঁ, সাধারণত প্রতি ইয়ারে আমরা টিচার নেই লেকচারার হিসেবে, এ বছর নেয়া হয় নাই। কিছু টিচার বাহিরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু স্কলারশিপের ডিলে হওয়ার কারণে তারা রয়ে গিয়েছে তাই এ বছরে আর নেওয়া হয় নাই। তোমাদের আগের ব্যাচ থেকে এখন ও যেহেতু নেওয়া হয় নাই, আর তোমাদের ব্যাচ ও আছে তাই নেক্সট বছরে একটু বেশি নিব, চারজনের মত নেওয়া হতে পারে। তুমি কি এই ব্যাপারে খোজ নিতে ক্যাম্পাসে এসেছ আজ?
তিথীঃ স্যার কস্ট করে পড়াশুনা করলাম। অনা'স এবং মাস্টা'স দুইটাতেই ফা'স্ট হলাম, একটা সুপ্ত ইচ্ছাতো আছেই।আমার হায়ার স্টাডিজের ইচ্ছা আছে।আমি ফ্যামিলির ছোট মেয়ে, তাই আম্মু চায় না আমি পারমানেন্ট বাহিরে থাকি। টিচার হলে আমার অনেক কিছু সুবিধা হয়। হায়ার স্টাডিজের জন্য স্কলারশিপ পাওয়া ইজি হবে এবং দেশে একটা সন্মানজনক চাকরি ও হবে।
স্যারঃ হুমম। আমাদের ভা'সিটিতো আর বুয়েটের মত না যে পরীক্ষায় প্রথম হলেই টিচার হতে পারবে। এখানে তোমার স্ট্রং লবিং লাগবে।তোমাকে হতে হবে কোন প্রতাপশালি টিচার ফ্যামিলির নিকটাত্নীয়। যদি তা না থাকে তবে লাগবে টিচার লবির স্টং রেকমন্ডেশন। টিচার লবির রেকমন্ডেশন পেতে হলে তোমাকে তাদের গ্রুপের হতে হবে। তুমি তো জান, আমি কোন পা'টি করি। তুমি স্টুডেন্ট লাইফে কোন স্টুডেন্ট পা'টি করতে না। তাই আমাদের সাপো'ট পেতে হলে তোমাকে এখন থেকে এনগেজ হতে হবে আমাদের গ্রুপে। তাহলে তুমি শুধু আমার না আমাদের ডিপা'টমেন্টের অনেকে টিচারের সাপো'ট পাবে, সাথে সাথে তুমি ভা'সিটির অন্য ডিপা’টমেন্টের আরো অনেক সিনিয়র টিচারের সমথ'ন পাবে, যা তোমাকে টিচার জীবনে অনেক অ্যাডভান্টেজ এনে দিবে। আর নেক্সট ন্যাশনাল ইলেকশনে আমাদের পা'টি পাওয়ারে আসবে। সো ভা'সিটি এবং ডিপা'টমেন্টে আমাদের পাওয়ার অনেক বেড়ে যাবে। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ।
তিথীঃ জ্বি স্যার। আমি তাহলে আজ উঠি। পরে অন্যদিন আসব।স্লামালেকুম।
স্যারের রুম থেকে বাহির হয়ে বারান্দা দাড়াঁয় তিথী। সূ'যের তীব্রতা মনে হয় আধাঘন্টার মধ্য কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। বারান্দার করিডোরে ওপাশ থেকে শিপলু হেঁটে আসছে। কাছে এসে শিপলু তিথীকে প্রশ্ন করেঃ"তিথী, তুমি ডিপা'টমেন্টে? কেমন আছ তুমি?"
লঘুস্বরে তিথী উত্তর দেয়- "এইতো আছি ভাল, এমনি আসলাম"। শিপলু বলেঃ "আমার একটু পরে একটা ক্লাশ আসে, তাই এখন আসি, পরে কথা হবে"। শিপলু তিথীদের দুই ব্যাচ সিনিয়র, থা'ড ছিল ঐ ব্যাচে, ভা'সিটির সহকারি প্রক্টরের ছেলে। তিথীরা ফা'স্ট ইয়ার থেকে দেখে এসেছে শিপলু তার অন্য ডিপা'টমেন্টে অ্যাফায়ার থাকা সত্ত্বেও নিজের ডিপা’টমেন্টের জুনিয়র ব্যাচের মেয়েদের সাথে টাংকি মারার চেস্টা করত, হয়তবা টিচার হয়ে ও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে।
শিপলু চলে যাওয়ার পর তিথী মনে মনে বলে উঠে- এই যদি হয় ডিপা'টমেন্টের টিচারের চরিত্র তবে ভা'সিটির যৌন কেলেংকারির সুনাম কমবে না বরং বাড়বে। তিথীর মন কেমন যেন বিষিয়ে উঠেছে। ডিপা'টমেন্টের করিডোর ছেড়ে ঘাসে ঢাকা পথ দিয়ে রাস্তার দিকে চলে তিথী। ক্যাম্পাসে আর এক মুহু'তের জন্য থাকতে ইচ্ছে করছে না। ক্যাম্পাসের রাস্তায় এসে একটা রিক্সা নেয়, গন্তব্য মেইন গেট, তারপর বাসে করে বাসা- এই ক্যাম্পাস তিথীর জন্য না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:৫৩