somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হেমন্তে নবান্ন উৎসব

০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হেমন্তকে বলা হয় অনুভবের ঋতু। ম্লান, ধূসর, অস্পষ্ট। তাকে যেভাবে অনুভব করা যায়, সেভাবে দেখা যায় না। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার মতো হেমন্ত তীব্র, প্রখর অথবা উন্মোচিত নয়। বসন্তের মতো তার বর্ণ, গন্ধ, গরিমা নেই। হেমন্ত মৌন, শীতল, বলা যায় অন্তর্মুখী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নৈবদ্যে স্তব্ধতা’ কবিতায় লিখেছেন-
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’

হেমন্তে দেখা যায় অখণ্ড নীল আকাশ। মিষ্টি সোনারোদ বলতে যা বোঝায় তা দেখা যায় এই হেমন্তেই।
হেমন্ত কোথা থেকে শুরু, কোথায় শেষ তা নিরূপণ করা দুরূহ। শরৎ থেকে সে খুব পৃথক নয়; শীত থেকেও তেমন বিচ্ছিন্ন নয় তার প্রকৃতি। শীত-শরতের মাখামাখি এই হেমন্ত, একটি সম্পূর্ণ নিজস্ব বাংলা ঋতু। হেমন্তের রঙ ধূসর। বর্ষার মতো রুদ্র-রুক্ষ নয় তার রূপ। শীতের দুঃসহ শৈত্যপ্রবাহও তার পরিচয় নয়। হেমন্ত উদাসীন, মগ্ন, নিভৃত, একগুচ্ছ প্রিয় ঝরাপাতা।

হেমন্তের শিশিরভেজা ঘাসের ডগায় মুক্তর মেলা। প্রকৃতি এ রহস্যময় উপাদানটি পানিরই বিন্দুবৎ রূপ।
বাংলা সাহিত্যের একটা অংশজুড়েও আছে শিশিরের নরম স্পর্শ। এটার জন্ম ও অন্তর্ধান দুটোই রহস্যে ঘেরা। কখন কোথা থেকে ঝরে পড়ে ঘাসে ঘাসে, গাছের পাতায় মুক্তোর মালা পরায়, কেউ জানে না। আর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিকে কাঁদিয়ে কোন সুদূরে মিলিয়ে যায়, তাও মানুষের দৃষ্টির বাইরে।

ভোরের কাঁচা কোমল রোদ, মৃদু হিমস্পর্শ প্রাণে শিহরণ জাগায়। হেমন্তেই দেখা যায় সোনারোদের ঝিলিক। হেমন্তের শিশির ভেজা সকাল, দুপুরের রোদের স্নিগ্ধতা, সন্ধ্যায় বাঁশঝাড়ে পাখির কলকাকলি ভিন্নমাত্রার দ্যোতনা সৃষ্টি করে। হেমন্তের রাতে মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্নার আলো যেন অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি। এ সময় গাছি খেজুর গাছের মাথার নরম অংশ কেটে প্রস্তুত করে রস সংগ্রহের জন্য।

বাংলাদেশে হেমন্ত আসে ধীর পদক্ষেপে, শীতের পরশ আলতো করে গায়ে মেখে। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন উৎসবের কোন নির্দিষ্ট তারিখ নেই। এটি ঋতুনির্ভর। সাধারণত অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। এ সময় কাটা হয় ধান। ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকে না। মনের উল্লাসে তার গান গায়।
‘কচ্-কচা-কচ্ কচ্-কচা-কচ্ ধান কাটি রে
(ও ভাই) ঝিঙ্গা শাইলের হুডুম ভালা
বাঁশ ফুলেরি ভাত্
লাহি ধানের খই রে
দইয়ে তেলেস্মাত্। ...
কস্তর গন্ধীর চাউলের আলো
সেই চাউলেরই পিঠা ভালো
সেই পিঠায় সাজিয়ে থালা
দাও কুটুমের হাতে রে।
...................ঐ’

কবি সুফিয়া কামাল তার কবিতায় হেমন্তে ফসল তোলার চিত্রটি এঁকেছেন এভাবে-
‘এই তো হেমন্ত দিন, দিল নব ফসল সম্ভার
অঙ্গনে অঙ্গনে ভরি, এই রূপ আমার বাংলার
রিক্তের অঞ্চল ভরি, হাসি ভরি, ক্ষুধার্তের মুখে
ভবিষ্যৎ সুখের আশা ভরি দিল কৃষকের বুকে
শিশির সিঞ্চনে সিক্ত দ্বারা বুকে তৃণাঞ্চল জাগে,
সোনালী ধানের ক্ষেতে ঈষৎ শীতার্ত হাওয়া লাগে
...
,মাতা হেরিতেছে নবান্ন আসন্ন উৎসবে,
বিমুগ্ধ নয়নে হেরে পরিপূর্ণ ফসলের ভার,
অঙ্গ ভরিয়া আছে- আমার বাংলার।’

কবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন-
‘সবুজে হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে ধান ক্ষেত,
পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সঙ্কেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখিগুলি শুয়েছে মাঠের পরে।
কৃষাণ কনের বিয়ে হবে হবে তার হলদি কোটার শাড়ি,
হলুদে ছোপায় হেমন্ত রোজ কচি রোদ রেখা-নাড়ি।’

নদীমাতৃক এ দেশের প্রধান কৃষি ফসল ধান। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমান-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে তাতে পাক ধরে। কার্তিকের শেষ দিকে তাই গ্রামের মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। চারিদিকে পাকা ধানের গন্ধে ম ম গন্ধ ছড়ি পড়ে।
বাংলার হেমন্তের এই অপূর্ব দৃশ্যটি ধরা পড়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’ কবিতায়-
‘চারিদিকে ন্যুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল,
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে..........
.........
আহলাদে অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর
চারদিকে ছায়া-রোদ-খুদ কুঁড়ো-কার্তিকের ভিড়
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি ধানভরা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ।’

বাংলা সনের হেমন্ত ঋতুর দুটি মাস, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আর্দ্রা’ এ দুটি তারার নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের।
‘মরা’ কার্তিকের পর বাংলাদেশের সকল মানুষ প্রবেশ করে এক সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্নে। ‘অগ্র’ ও ‘হায়ণ’ এ দু’অংশের অর্থ যথাক্রমে ‘ধান’ ও ‘কাটার মওসুম’।
হেমন্তে গ্রামবাংলার ফসল ঘরে তোলার পরে মাঠের দৃশ্যটিও কবি জীবনানন্দ দাশের দৃষ্টিতে অত্যন্ত চমৎকার হয়ে ফুটে উঠেছে।
‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে-
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে
শুধু শিশির জল;
অগ্রহায়ণের নদীটির শ্বাস
হিম হয়ে হয়ে আসে
বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা;
বরফের মতো চাঁদ ঢলিয়াছে ফোয়ারা;
ধানক্ষেতে-মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা;
ঘরে গেছে চাষা;
ঝিমাইছে এ পৃথিবী।’
বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় নবান্নের চিত্রটি বেশ উপভোগ্য। তিনি লিখেছেন :
‘ঋতু খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত?
নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।
‘গিন্নি পাগল’ চালের ফিরনী
তশ্তরী বরে নবীনা গিন্নি
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত
শিরনি রাঁধেন বড়বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।
মিঞা ও বিবিতে বড় ভাব আজি খামারে ধরে না ধান
বিছানা করিতে ছোট বিবি রাতে চাপা সুরে গাহে গান;
শাশবিবি কন্, আহা, আসে নাই
কতদিন হলো মেজলা জামাই।’

সাধারণত কার্তিক ও অগ্রহায়ণে ধান কাটা ও মাড়াই করে ধান থেকে আতপ চাল তৈরি করা হয়। ওই চাল থেকে তৈরি গুঁড়া দিয়ে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। নতুন চালে রান্না করা হয় সুঘ্রাণ ও সুস্বাদু পায়েশ। এ সময় গ্রাম বাংলার গৃহবধূরা বানাতে বসে নানা রকম পিঠা। দেশের অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামের এ পিঠা তৈরি হয়। তৈরি করা হয় মুড়ি-মুড়কি নানা আর রকম সুস্বাদু খাবার। যেগুলো গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৫৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×