জেনিদের বাড়িতে শোকের মাতম। দুই দিন ধরে কেউ কিছু মুখে তুলছে না। জেনির মা হাসিনা খানম বুক চাপড়ে কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন, ‘আমার মাইয়্যারে অরা বাঁচতে দিল না। অর ডরে মাইয়্যার ল্যাহাপড়া বন্ধ করছি, অল্প বয়সে বিয়া ঠিক করছি। হ্যার পরও মাইয়্যাডারে অরা বাঁচতে দিল না।’
বরগুনার বামনা উপজেলার ডৌয়াতলা ইউনিয়নের ছোট ভাইজোড়া গ্রামের কিশোরী জেনি আক্তারের (১৫) লাশ গত মঙ্গলবার সকালে পাওয়া যায় বাড়ির পেছনে একটি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায়। তার পরিবারের অভিযোগ, প্রতিবেশী বখাটে যুবক জিসান হায়দার মৃধা ওরফে তাপু (২২) ও তার সহযোগীরা ঘরে ঢুকে ধর্ষণের পর জেনিকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখে। তাপু বামনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গোলাম হায়দার হেমায়েত মৃধার ছেলে।
নিহত জেনি ছোট ভাইজোড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মোতালেব হাওলাদারের মেয়ে। সে স্থানীয় চলাভাঙ্গা দারুস সালাম রশিদিয়া দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। বাবা মোতালেব হাওলাদার ঢাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন।
পুলিশ গত মঙ্গলবার দুপুরে লাশ উদ্ধার করে। গতকাল বুধবার দুপুরে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
মামলা ও গ্রেপ্তার: এ ঘটনায় নিহত জেনির মা হাসিনা খানম গত মঙ্গলবার রাতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বামনা থানায় মামলা করেছেন। এতে বখাটে তাপু, তার বাবা গোলাম হায়দার হেমায়েত, মা মাকসুদা বেগম, ফুপা মো. সেলিমসহ অজ্ঞাত আরও দুজনকে আসামি করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে গোলাম হায়দার হেমায়েত, মাকসুদা বেগম ও সেলিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ বখাটে তাপুকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মাহবুব হাকিম গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি নিহত জেনির বাবা-মা ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাঁরা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
বামনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজম ফারুকী গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, মূল আসামি তাপু ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
জেনির হাতে ও গোপনাঙ্গে পোড়া দাগ: লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন বামনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বরকত হোসেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, লাশের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না, তবে গোপনাঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
এ ছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ময়নাতদন্তের কাজে নিয়োজিত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনির হাতে ও গোপনাঙ্গে সিগারেটের অনেকগুলো পোড়া ক্ষত রয়েছে।
যেভাবে ঘটনা ঘটে: নিহত জেনির মা হাসিনা খানম অভিযোগ করেন, জেনি স্থানীয় হোগলপাতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা প্রতিবেশী গোলাম হায়দার হেমায়েতের বখাটে ছেলে তাপু দুই বছর ধরে জেনিকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত। বিষয়টি তাঁরা বহুবার তাপুর পরিবারকে জানিয়েছেন। কিন্তু এতে তাপু আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে মাস ছয়েক আগে জেনির বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন তাঁরা।
হাসিনা খানম বলেন, মাস দুয়েক আগে জেনিকে আবার চলাভাঙ্গা মাদ্রাসায় নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। আবার মাদ্রাসায় যাওয়া-আসার পথে তাকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে তাপু। এতে জেনির মাদ্রাসায় যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না পেয়ে তাপুর হাত থেকে বাঁচাতে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। আগামীকাল ২২ জুলাই বরপক্ষ জেনিকে আংটি পরাতে আসার কথা ছিল। বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর পাওয়ার পর তাপু ক্ষিপ্ত হয়ে কয়েক দিন ধরে তাঁদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিল।
জেনির মা হাসিনা খানম বলেন, সোমবার রাতের খাবার খেয়ে জেনি দোতলায় নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। তিনি ছোট ছেলে সুমনকে (৯) নিয়ে নিচের ঘরে ঘুমান। রাত সাড়ে তিনটার দিকে দোতলার ঘর থেকে গোঙানি ও ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে তিনি টর্চলাইট নিয়ে ওপরে যান। দোতলার ঘরে ঢুকে দেখেন বখাটে তাপু তাঁর মেয়ের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে এবং জেনি তাপুকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। হাসিনা মেয়েকে রক্ষার জন্য এগিয়ে গেলে তাপু তাঁকে টর্চলাইট দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। এ সময় ঘরের বাইরে আরও কয়েকজন যুবককে তিনি মুখোশ পরা অবস্থায় দেখতে পান। মেয়েকে রক্ষা করতে না পেরে হাসিনা তাপুদের বাড়িতে ছুটে গিয়ে তার বাবা গোলাম হায়দারকে বিষয়টি জানান। কিন্তু তাপুর বাবা ও পরিবারের লোকজন হাসিনাকে একটি ঘরে আটকে রাখেন। দেড়-দুই ঘণ্টা আটকে রাখার পর ভোর পাঁচটার দিকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি দৌড়ে বাড়িতে এসে দেখেন জেনি তার ঘরে নেই। খোঁজাখুঁজি করে বাড়ির পেছনে একটি বাতাবি লেবুগাছে গলায় ওড়না প্যাঁচানো জেনির লাশ ঝুলতে দেখেন।
জেনির বাবা মোতালেব হাওলাদার মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছেন। শোকে স্তব্দ মোতালেব হাওলাদার বলেন, ‘মেয়ের এমন পরিণতি দেখার আগে আমাদের মৃত্যু হলো না কেন?’
তটস্থ গ্রামবাসী: ভাইজোড়া গ্রামের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বখাটে তাপু ও তার পরিবার এলাকায় খুব প্রভাবশালী। তাপুর বাবা ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এক চাচা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
তাপু চলাভাঙ্গা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করলেও দাখিল পাস করতে পারেনি। এলাকায় প্রতিদিন দু-তিনজনকে মারধর করা, মাস্তানি ও মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাই তার কাজ।
Source: Prothom Alo

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




