somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথন- ল্যাভেণ্ডারের সুবাস

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৮:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


#পর্ব_৪
সবকিছু সংগ্রহ করার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি অফিসেও ব্যস্ততা তখন চরমে। আমার ডিভিশনে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফরমা) তৈরির কাজ চলছে তখন। অনেক বড় প্রজেক্ট। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রজেক্টটার সংশোধিত ডিপিপি জমা দিতে না পারলে কাজ আটকে যাবে। আর এর দায়ভার এসে বর্তাবে সম্পূর্ণ আমার ওপরে।
অফিস, বাসা আর নিজের এইসব ঝামেলা সামাল দিতে গিয়ে আমার তখন বেসামাল দশা। অফিসের শুভাকাঙ্ক্ষী সহকর্মীরা আমার এই লম্ফঝম্ফ দেখে সমবেদনা জানাল। কেউ কেউ রিল্যাক্স থাকার পরামর্শ দিয়ে এত ঝামেলা মাথায় নিতেও নিষেধ করলো। একে তো এখন আমাদের যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। তার ওপরে ডায়াবেটিসের সাথে বাস করি। কাজেই আমাকে ঘিরে তাদের ভালোবাসাটুকুই উদ্বেগের সুরে প্রকাশ পেল।

শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুরা অনেককিছুই বললো। কিন্তু আমার মাথায় তো ততদিনে পোকা বেশ গভীরে ঢুকে গেছে। আর জীবনটাকে একেকজন একেকভাবে গ্রহণ করে। কেউ কেউ জীবনের রঙ রূপকে আমার চেয়ে অনেক ভালোভাবে আস্বাদন করতে জানে। তারা প্রতিদিনের ভালোলাগার ক্ষণগুলোকে নির্যাসের মতো জমিয়ে রাখতে জানে। সেই নির্যাসটুকুকে তারা দুঃসময়ে কাজে লাগায়। তাদের জীবনে তাই আনন্দ আর ভালোলাগার কখনো কমতি ঘটে না।
প্রতি মুহূর্তে জীবনকে অহেতুক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে আমার মতো কিছু বোকার দল। আসলে কিছু বলার নেই। প্রতিটি মানুষই ভিন্ন, আর এই ভিন্নতাই জীবনের ধর্ম। আমার কাছে জীবন হচ্ছে একটা ওয়ান টাইম গেইম। খেলার নিয়ম অনুসারে কখনো কখনো একবারই মাত্র দান দেওয়ার সুযোগ আসে। সেই দান আমি দিব নাকি দিব না, তা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্তও খুব অল্প সময়েই আমাকে নিতে হবে। চিন্তাভাবনাতে বেশি সময় লাগানো যাবে না। আর তাছাড়া... এই ছোট ছোট সুযোগগুলো কি সব সময়ে আসবে?
যদি নিজে একা গিয়ে বাইরে থেকে পড়ে আসার বিষয় হতো, তাহলে তো এতদিনে পড়েই আসা যেত একরকম ভাবে। কিন্তু বর বাচ্চাসহ এভাবে ফ্যামিলি লাইফ কাটানোর পাশাপাশি পড়াশুনা করে আসা...এ তো অমূল্য সুযোগ! আমি এই সুযোগ কিছুতেই হারাতে পারি না!

সময় সবকিছুকেই টেনে নিয়ে যায়, পিছে পড়ে থাকে না কোনোকিছুই।
ইউকে’র তিনটি ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করলাম। ইউনিভার্সিটি অফ লীডস, লীডস বেকেট ইউনিভার্সিটি এবং কোভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি। এই তিনটার মধ্যে আমার টার্গেট অবশ্যই প্রথমটি যেটাতে আমার হাজবেণ্ড রিসার্চ ফেলো হিসেবে যাচ্ছে। তিনটার মধ্যে প্রথমটার র‍্যাংকিং ও অন্যদুটোর চেয়ে বেশ এগিয়ে। দ্বিতীয়টিতে করেছি যদি প্রথমটি কোনোকারণে মিস হয়ে যায়, তবুও যাতে লীডসের একটা ইউনিভার্সিটিতে আমার এ্যাডমিশন নিশ্চিত থাকে। আর তৃতীয়টিতে করার কারণ হচ্ছে, কোভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি নাকি চাইলেই অফার লেটার দিয়ে দেয়। কাজেই দ্রুততম সময়ে অফার লেটার ম্যানেজ করতে হলে এই ইউনিভার্সিটি সেরা। পরে ইউনিভার্সিটি বদলে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু স্কলারশীপের জন্য আবেদন করতে হলে তো আগে একটা অফার লেটার আমাকে দেখাতে হবে!

তিনটি ইউনিভার্সিটি থেকেই অফার লেটার হাতে এলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো কোভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি নিয়ে। এরা আমাকে তাদের ইউনিভার্সিটির গুণগান গেয়ে মেইলের পরে মেইল পাঠাতে লাগলো। ইউকে’র একটা ইউনিভার্সিটি যে এভাবে ত্যক্ত করতে পারে তা আমার এক প্রচণ্ড বিস্ময়েরই কারণ হলো। পরে বুঝেছি, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট মানে সোনার ডিম পাড়া মুরগি। এদের ধরতে পারা মানেই অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায় করতে পারা। আর এই অতিরিক্ত ফি কেটে নিয়েই এই ইউনিভার্সিটিগুলো তাদের রমরমা অবস্থা বজায় রাখে!

কিন্তু তাই বলে এভাবে? দেশে নানারকম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো যেভাবে কাঁঠালের আঠার মতো পিছে লেগে থাকে, এই ইউনিভার্সিটিও আমাকে একইরকম অভিজ্ঞতার স্বাদ পাইয়ে দিলো। যখন এডমিশনের সময় পুরোপুরি চলে গিয়েছে তখন তাদের সর্বশেষ করা মেইলটির ভাষা ছিল এইরকম, ‘ফাহ্‌মিদা, ইউ প্রমিজড আস ইউ উড লাভ টু স্টাডি হিয়ার...’
আমি হতবাক। আমি আবার তাদের কাছে কবে প্রমিজ করলাম!
ইউনিভার্সিটি অফ লীডসের অফার লেটারটা যেদিন হাতে পেলাম, সেদিন থেকেই আমি কল্পনায় এই ইউনিভার্সিটির একজন সদস্য হয়ে গেলাম। প্রতিদিন অনলাইনে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন একাডেমিক ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সেই ভবনের ভেতরে ঢুকি। ক্লাসরুমগুলোতে উঁকি দিই। অন্যরকম অনুভূতি! আমি সত্যিই ভাবিনি এত বছর পরে এই অনুভূতি আমাকে এভাবে আক্রান্ত করতে পারবে!

ইউনিভার্সিটির অফার লেটার হাতে পাওয়ার পাশাপাশি সার্টিফিকেটগুলো উদ্ধারের কাজও সমগতিতে চলতে লাগলো। আমার হাজবেণ্ড মাঝে মাঝে অভিযোগ করে যে, বুয়েটের এডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্টগুলো নাকি আগের অবস্থানে নেই। এখন কাজেকর্মে বেশ ঢিলামী। যেকোন কাজ করতে এখন অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়। আভ্যন্তরীণ কারণ যাই হোক না কেন, আমি সামান্য এক সার্টিফিকেট তুলতে গিয়েও এই কথার সত্যতা অনুভব করলাম।

সব প্রক্রিয়া শেষ করে যথাসময়েই স্কলারশীপের জন্য আবেদন করতে পারলাম। এসব কর্মযজ্ঞের মাঝে জীবনের অন্য সুরগুলোও সমান্তরাল লয়ে বাজতে লাগলো।
২০১৫ সালের এপ্রিলের দিকে ইউনাইটেড হাসপাতালে আমার বাবার বুকে পেসমেকার লাগানো হয়েছিল। পেসমেকার লাগানোর পরে অল্প কিছুদিন ভালো থাকলেও আব্বার শরীরটা কেন যেন তেমন ভালো যাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে আমার আব্বা কেমন যেন দুর্বল আর অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। বিশেষ করে মানসিকভাবে খুব ক্লান্ত থাকতো বেশির ভাগ সময়। আম্মার কাছে শুনতাম, প্রায় সময়েই নাকি মনমরা হয়ে বসে থাকত। কী যেন চিন্তা করত সবসময়। আমার বাবার বাড়ি জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ। ঢাকা থেকে বেশ অনেকখানি দূরত্বে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ঘন ঘন তাদের দেখতে যাওয়া সম্ভব হতো না। অথচ মনের মধ্যে সবসময় অসুস্থ, বৃদ্ধ দু’জন মানুষ বাস করত। তাদের একাকীত্বের অসহায়ত্বটাকে মন দিয়ে অনুভব করতাম। যদিও দূরে বসে বেশিকিছু করতে পারতাম না।

তাদের ছোট ছোট কষ্ট আর আমাদের ঘিরে আবর্তিত হওয়া তাদের ভাবনাগুলো আমাদেরও ঘিরে রাখত সবসময়। সন্তান আর পিতামাতার এই সম্পর্কের বন্ধনে দূরত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর মেয়ে সন্তান মাত্রই জানে, এই কষ্টের প্রকৃতি কেমন। মেয়েদের জীবনটাকে অনেকটা দ্বৈত সত্ত্বার মতো টিকিয়ে রাখতে হয়।
একটি সত্ত্বাকে ব্যস্ত থাকতে হয় নিজের স্বামী সন্তান আর নিজস্ব পরিমণ্ডল নিয়ে। অপর সত্তায় আলাদাভাবে বাবা-মাকে রাখতে হয়। দুটি সত্ত্বাকে একটি ধারায় যারা মিলিয়ে দিতে পারে, তারাই হয়ত সত্যিকারের সৌভাগ্যবতী।

আমার দেশের বাইরে পড়তে যেতে চাওয়ার কথা শুনে আব্বা খুব খুশি হয়েছিল। প্রায়ই ফোন করে জিজ্ঞেস করতো, ‘স্কলারশীপের কী হলো মা? হবে তো? তোমার একটা স্বপ্ন পূরণ হতো!’
স্কলারশীপের প্রক্রিয়াতে তখন সবে প্রবেশ করছি। সব কাগজপত্র একত্র করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবরে আবেদন করে শক্ত হয়ে বসে আছি। এখন এসব আবেদনপত্র যাচাই বাছাই করণ শেষে ‘যোগ্যতর’ আবেদনকারীদের ভাইভাতে ডাকা হবে। আমি মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজ নিই। প্রক্রিয়া কতদূর...এবার কতজন আবেদন করেছে...কতজনকে ডাকা হবে...ইত্যাদি ইত্যাদি। জানলাম, আবেদনপত্র জমা পড়েছে প্রায় দেড়শো’র ওপরে। ডাকা হবে সবাইকেই। তবে স্কলারশীপ দেওয়া হবে মাত্র পঞ্চাশ জনকে। এই পঞ্চাশ জনের মধ্যে পঁয়ত্রিশ জনই যাবে এডমিন ক্যাডার থেকে। বাকি সবগুলো ক্যাডার থেকে নেওয়া হবে অবশিষ্ট পনেরো(!!)জনকে! খুবই সুষম ন্যায়সঙ্গত বণ্টন!

ইদানীং আমাদের ডিপার্টমেন্টের অনেককেই এডমিন ক্যাডারে পরিবর্তন করতে দেখি। আমি বিষয়টাতে কেন যেন একটু দুঃখ পাই। এডমিনে যেতে চাইলে ক্যাডার নির্বাচনের সময়ে প্রথমেই তো করা যায়! এতদিন পরে কেন? আর তাছাড়া কষ্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এডমিনে কেন? তাহলে স্পেশালাইজড জ্ঞানটার গুরুত্ব কী?
উত্তরে অপরপক্ষ সাদামাটাভাবে বলেন, ‘এডমিন ছাড়া কি আর কোনো ক্যাডারকে ফিল্ডে দেখতে পাও? কই...আমরা তো পাই না!’
আমার লেখার উদ্দেশ্য অন্যকিছু। তবু প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছু কথা চলে আসছে। তবে এই বিষয়টা নিয়ে বিতর্কের স্থানটা এখন অন্য স্তরে। সেই স্তরে পৌঁছালে হয়ত এই লেখাটিই হয়ে উঠবে না আমার। কাজেই সেই প্রসঙ্গে আর নাই বা গেলাম! (ক্রমশঃ)

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৮:৫৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×