somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বানরের থাবা (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)

০৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





তিন

মাত্র দুই মাইল দূরের পুরনো একটি কবরস্থানে ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে এসে দুজন বৃদ্ধ অসহায় পিতামাতা ফিরে এলেন নিজেদের বাড়িতে, যেখানে এখন শুধু ছায়া আর দমবন্ধ নিস্তব্ধতা ফিসফিস করে চলেছে নিজেদের মধ্যে।

সবকিছু এত দ্রুতই ঘটে গেল যে, তারা যেন তখনও বুঝতে পারছেন না কী হারিয়ে গেল তাদের জীবন থেকে। তারা এখনো বিষয়টার সাথে একাত্ম হতে পারেননি। কিছু নিষ্ফল প্রতীক্ষার পরে দিনে দিনে একসময় অবশেষে তারা উপলব্ধি করলেন... যে গেছে সে আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না। সে চিরতরে হারিয়ে গেছে তাদের জীবন থেকে। রেখে গেছে কিছু দুরূহ দীর্ঘশ্বাস যা বৃদ্ধ দুটি হৃদয়ের জন্য আজীবন বয়ে চলা ভীষণ কঠিন।
তবু সত্যকে কে কখন খণ্ডাতে পেরেছে? বুকে পাথর চাপা দিয়ে এই সত্যকেও তারা মেনে নিতে প্রস্তুত হলেন। নিষ্ঠুর নির্মম সত্যের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। সবকিছুই বদলে গেল জীবনের। আগের সেই হাসি আনন্দ উচ্ছ্বাস... চিরতরে বিদায় নিলো তাদের জীবন থেকে।
তারা খুব কদাচিৎ নিজেদের সাথে কথা বলতেন। কলরব আর কথকতারাও মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গেছে জীবন থেকে। সুদীর্ঘ ক্লান্তিকর দিনগুলো বড্ড একঘেয়ে মনে হতে লাগল তাদের কাছে।


প্রায় এক সপ্তাহ পরে গভীর রাতে একদিন মৃদু একটা আওয়াজ শুনে মিস্টার হোয়াইটের ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় তার স্ত্রী ছিলেন না। শব্দ হাতড়ে হাতড়ে তিনি দেখতে পেলেন, অন্ধকার ঘরটিতে তার স্ত্রী জানালার পাশে বসে কাঁদছেন। গভীর মমতায় তিনি বললেন, ‘ওখান থেকে উঠে এসো। তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে!’

‘আমার ছেলের তো আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগছে এখন! ও তো বাইরে ঘুমাচ্ছে!’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস হোয়াইট।

মিস্টার হোয়াইটের চোখে তখনও ঘুম জড়িয়ে আছে। স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল তারই কাছে। অসহায় কান্নাগুলো কানের পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। একসময় নিজের অজান্তেই তিনি আবার গভীর ঘুমে এলিয়ে পড়লেন। আচমকা তীব্র একটা চিৎকারে তার ঘুম একেবারে পুরোপুরি ভেঙে গেল। মিসেস হোয়াইট চিৎকার করে বলে উঠেছেন, ‘থাবা! সেই বানরের থাবা!’

চোখ থেকে ঘুমের চিহ্নমাত্র মুছে গেল মিস্টার হোয়াইটের। তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে সেই অলুক্ষূণে জিনিসটার? কেন ওটার কথা বলছ তুমি...যেটা আমাদের ছেলেকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে?’

দ্রুত স্বামীর কাছে ছুটে আসতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন বৃদ্ধা। কাছে এসে ফিস ফিস করে স্বামীকে বললেন, ‘ওটা চাই আমার! ঐ বানরের পা আমার চাই! তুমি ফেলে দাওনি তো ওটাকে?’

‘ও…ওটা ড্রয়িং রুমে আছে। ফায়ারপ্লেসের ওপরের শেল্ফে। কিন্তু ... কিন্তু তুমি কী করবে ওটা দিয়ে?’

উন্মাদিনীর মতো একবার কান্না আর আরেকবার হাসিতে ভেঙে পড়লেন মিসেস হোয়াইট। ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে স্বামীর গালে একটা চুমু দিলেন বৃদ্ধা। হঠাৎ কেন যেন তার মনে অনেকগুলো আশার প্রদীপ একসাথে জ্বলে উঠেছে। আনন্দের আতিশয্য তিনি যেন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারছেন না। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি ভাবছিলাম ওটার কথা। আচ্ছা... কেন এতদিন ওটার কথা ভাবিনি বলো তো?’

‘ওটার কথা কেন ভাববে? কী বলছ এসব তুমি?’

‘আমাদের আরও দুটি ইচ্ছাপূরণ বাকী আছে! সবে তো একটিমাত্র ইচ্ছা পূরণ করেছি আমরা। আরও দুটি ইচ্ছা পূরণ করতে পারব তো!’

‘ঐ একটাই কি যথেষ্ট হয়নি?’ মিস্টার হোয়াইটের কণ্ঠ উন্মাদের মতো শোনালো।

‘না! আমার আরও একটি ইচ্ছা পূরণ করতে হবে! নিচে যাও আর এক্ষুণি ওটাকে নিয়ে এসো! আমি আমার ছেলেকে জীবিত ফেরত পেতে চাই!’

এই কথা শুনে মিস্টার হোয়াইট এক লাফে বিছানায় উঠে বসলেন। গা থেকে এক ঝটকায় কম্বল সরাতে সরাতে বললেন, ‘হায় ঈশ্বর! মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে তোমার? তুমি জানো তুমি কী বলছ?’

‘ওটাকে খুঁজে আনো! প্লিজ ওটাকে খুঁজে আনো! আমি আমার ছেলেকে চাই! আমি এক্ষুণি আমার ছেলেকে চাই!’ বৃদ্ধা রীতিমত কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বললেন।

কোনোমতে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা ম্যাচ দিয়ে মোমবাতি জ্বালালেন তার স্বামী। মমতামাখানো আদেশের সুরে বললেন, ‘শুয়ে পড়ো! তুমি বুঝতে পারছ না তুমি কী বলছ! আমাদের ছেলে হারবার্ট আর বেঁচে নেই। আমরা আর কিছুতেই ওকে ফেরত পাবো না!’

‘আমাদের প্রথম ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তাহলে কেন আমরা আমাদের পরের ইচ্ছা পূরণ করব না? আমাদের তো সুযোগ আছে!’ মিসেস হোয়াইটের মুখে সেই একই কথার প্রতিধ্বনি বাজতে লাগল। স্বামীর কথা তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হচ্ছে না।

‘একটা যোগাযোগ! ওটা ছিল একটা যোগাযোগ মাত্র! তবু কী অদ্ভুতভাবে মিলে গেল আমাদের ইচ্ছের সাথে! কিন্তু কে বলেছিল এমন যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে?’ মিস্টার হোয়াইট স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন।

‘প্লিজ যাও তুমি! আমাদের ছেলেকে ফেরত চাও!’ বৃদ্ধার পুরো শরীর তখন কাঁপছে। আগ্রহ আর উত্তেজনায় বুঝি এক্ষুণি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন!

বৃদ্ধ এবারে পরম ধৈর্য আর মমতা দিয়ে তার স্ত্রীর হাত ধরে নরম গলায় বললেন, ‘হারবার্ট মারা গেছে আজ দশদিন হতে চলল। আমি ওর লাশ তোমাকে দেখতে দেইনি। কারণ তুমি সহ্য করতে পারতে না। এতদিন...এতদিন আমি এই কথাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম তোমার কাছ থেকে। মেশিনের নিচে পড়ে হারবার্ট একেবারে থেঁতলে গিয়েছিল। আমি ওকে শুধু কাপড় দেখে চিনেছিলাম। যাকে দশ দিন আগে সহ্য করতে পারতে না, তাকে আজ কীভাবে সহ্য করবে তুমি?’

‘ফিরিয়ে আনো ওকে! ফিরিয়ে আনো! যাকে নিজের হাতে বড় করেছি, আমি তাকে ভয় পাব? কেমন করে ভাবতে পারলে তুমি?’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন মিসেস হোয়াইট। স্বামীর কোনো ব্যাখ্যা কোনো প্রবোধেই আজ তিনি পিছু হঠবেন না!


অগত্যা স্ত্রীর কাতর আবেদনের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন মিস্টার হোয়াইট। নিজের অজান্তেই পায়ে পায়ে অন্ধকারে এগিয়ে চললেন নিচের তলায়, ড্রইংরুমে। কে বা কী তাকে টেনে টেনে সেখানে নিয়ে চলল তিনি বুঝতে পারলেন না। কারণ নিজের শরীরে কোনোরকম অনুভূতিই যেন আর অবশিষ্ট নেই তার। কখন যেন পৌঁছে গেলেন ফায়ারপ্লেসের কাছে। ওপরের শেলফের র‍্যাকে হাত দিতেই জিনিসটা হাতে ঠেকল। হ্যাঁ, সেটা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। সেই অশুভ জিনিসটা!

আচমকা একটা শীতল ভয় এসে তাকে আপদমস্তক নাড়িয়ে দিয়ে গেল। হয়ত তার অব্যক্ত ইচ্ছা দলিতমথিত অবস্থায় তার ছেলেকে তাদের সামনে এনে হাজির করে দিবে। পারবেন কি সেটা সহ্য করতে? এই ঘর থেকে কি তখন ছুটে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করবে না? তার নিঃশ্বাস আটকে গেল। মনে হলো, দরজাটা কোনদিকে তিনি সেটা হারিয়ে ফেলেছেন। ঘর দেওয়াল আর টেবিলের মাঝখানেই তিনি ঘুরপাক খেতে লাগলেন। তীব্র শীতেও তার কপাল ঘেমে উঠল। একসময় বুঝতে পারলেন তিনি সিঁড়ির কাছে চলে এসেছেন আর হাতে ধরে রেখেছেন সেই...সেই থাবা... বানরের থাবা!


ওপরের ঘরে যখন ঢুকলেন, তখন তাকে দেখে তার স্ত্রীর মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। এতক্ষণ যে তিনিই ঐ বানরের থাবাটিকে আনার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, সেটা তার চেহারা দেখে মনেই হচ্ছে না এখন। অস্বাভাবিক এক ভয়ে তিনি যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। মিস্টার হোয়াইটের ভয় হতে লাগল তার দিকে তাকিয়ে। তবু কোথা থেকে কী এক দুর্বোধ্য তাগিদে তার স্ত্রী বলে উঠলেন, ‘ইচ্ছা! ইচ্ছার কথা বলো!’

‘খুব বোকার মতো কথা বলছ তুমি!’ দুর্বলভাবে বললেন মিস্টার হোয়াইট।

‘ইচ্ছা!’ তার স্ত্রী পুনরায় বললেন।

মিস্টার হোয়াইট ডান হাতে বানরের থাবাটিকে উঁচু করে ধরে স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে জীবিত ফেরত চাই!’


জিনিসটি হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল, ঠিক সেই সেদিনের মতো। অবিশ্বাস মাখানো ভয়ার্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার হোয়াইট। তারপর ধপ করে বসে পড়লেন পাশে রাখা একটি চেয়ারে। তার স্ত্রী ততক্ষণে ছুটে গিয়েছেন জানালার কাছে। জানালার পর্দা সরিয়ে আকুল চোখে তিনি চেয়ে রইলেন বাইরে। ঐ বুঝি তার সন্তান তার বুকে ফিরে এলো!

একটানা কতক্ষণ সেই চেয়ারটিতে ওভাবে বসে ছিলেন সেটা তিনি নিজেও জানেন না। একসময় মিস্টার হোয়াইটের কাছে মনে হলো তিনি আর কোনো শীত অনুভব করছেন না। মাঝে মাঝে জানালার পাশে বসে উদ্বিগ্নমুখে বাইরে চেয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে চোখ পড়ে যাচ্ছিল তার। মোমবাতিটি জ্বলতে জ্বলতে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দপ দপ করতে লাগল সেই মোমবাতির শিখাটি। সেই অস্থির শিখার সাথে একইবেগে ধেয়ে চলল কিছু কম্পমান ছায়া। সেগুলো বাস্তব নাকি চোখের ভুল, কে বলতে পারে?

একসময় যখন মোমবাতিটি পুরোপুরি নিভে গেল, বৃদ্ধ মিস্টার হোয়াইটের মন আশ্চর্য এক প্রশান্তিতে ভরে গেল। বানরের থাবাটি এবারে ব্যর্থ হয়েছে তার ইচ্ছা পূরণ করতে! আহ শান্তি! তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন বিছানার দিকে। নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিলেন বিছানায়। কিছুক্ষণ পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার স্ত্রীও এসে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লেন তার পাশে।


দুজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইলেন। কারও চোখেই ঘুম নেই, তবু কেউ কোনো কথা বলছেন না। বাইরে নিস্তব্ধ রাত্রির খুব স্বাভাবিক কিছু শব্দ ভেসে আসছে। কোথাও কোনো অন্যরকম কিছুর অস্তিত্ব নেই। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরে কিছুটা শক্তি ফিরে এলো শরীরে। নিকষ নিচ্ছিদ্র অন্ধকার যখন অসহ্য মনে হতে লাগল, তখন একসময় মিস্টার হোয়াইট উঠে পড়লেন বিছানা থেকে। ম্যাচের বাক্স থেকে একটা ম্যাচ ধরিয়ে আরেকটি মোমবাতি জ্বালাতে তিনি নিচতলায় নেমে এলেন।

সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে নামতেই ম্যাচটি নিভে গেল। তিনি আরেকটি ম্যাচ ধরাতে গেলেন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই খুব মৃদু একটা শব্দ তার কানে ভেসে এলো। কে যেন দরজার কড়া নাড়ছে। এতটাই ধীর সেই আওয়াজ যে, মনে হচ্ছে ওপাশ থেকে কেউ যেন নিজের আগমন বার্তা কাউকে জানাতে চায় না। নিতান্ত অনিচ্ছাতেই যেন সে দরজায় করাঘাত করছে।

মিস্টার হোয়াইটের হাত থেকে ম্যাচের কাঠিটি পড়ে গেল। তিনি বিমূঢ় মূর্তির মতো সেখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না আরেকবার সেই কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। আর মুহূর্তকাল দাঁড়ালেন না সেখানে। এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনি শোয়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঠিক তখনই তৃতীয়বার কড়া নাড়ার আওয়াজ ভেসে এলো!

‘ক...কী ওটা! কীসের আওয়াজ ওটা?’ মিসেস হোয়াইট প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসেছেন। তার চোখমুখ বিস্ফোরিত। আওয়াজটা তার কানেও এসেছে।

‘কি...কিছু না! একটা ইঁদুর সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। আমার সাথে ধাক্কা লেগেছে ওটার।’ নিজের গলার কাঁপুনিটা লুকাতে পারলেন না মিস্টার হোয়াইট।

কিন্তু তার স্ত্রীর কানে সেই কথা ঢুকেছে বলে মনে হলো না। তিনি তখন কান খাড়া করে বসে আছেন বিছানায়। ঠিক সেই সময় একেবারে প্রচণ্ড জোরে শোনা গেল দরজার করাঘাত। সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পুরো বাড়িটাতে।

‘হারবার্ট! আমার হারবার্ট এসেছে! শুনতে পাচ্ছ? আমার হারবার্ট এসেছে!’ আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলেন মিসেস হোয়াইট।



তিনি ছুটে চলে গেলেন দরজার কাছে। সেখানে তখনো দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বামী। স্ত্রীর বাহু শক্ত করে ধরে মিস্টার হোয়াইট নিচু ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘কী করছ তুমি? কেউ নেই ওখানে! কেউ নেই, বিশ্বাস করো আমার কথা!’

‘আমাদের ছেলে হারবার্ট এসেছে! তুমি বুঝতে পারছ না? আমাকে আটকে ধরে আছ কেন? দরজা খুলতে দাও আমাকে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ও তো মাত্র দুই মাইল দূরেই থাকে! ওর আসতে সময় লাগবে না!’ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তিনি রীতিমত ধস্তাধস্তি শুরু করে দিলেন স্বামীর সাথে।

‘ঈশ্বরের দোহাই লাগে ওটাকে ভেতরে আসতে দিও না!’ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মিস্টার হোয়াইট বললেন।

‘তুমি নিজের ছেলেকে ভয় পাচ্ছ? কেমন বাবা তুমি? আমাকে যেতে দাও! আমি দরজা খুলব! হারবার্ট বাবা! আমি এক্ষুণি আসছি!’



দরজায় ক্রমাগত করাঘাত হয়ে যেতে লাগল। একটা ... তারপর আরেকটা! ক্রমাগত! একের পরে এক!

হঠাৎ একটা ঝটকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারলেন মিসেস হোয়াইট। আর তারপরই ছুটে চলে গেলেন নিচে। তার পায়ে যেন আজ বিদ্যুতের গতি ধরা দিয়েছে। এক ছুটে দরজার কাছে পৌঁছে তিনি টান দিয়ে দরজার চেন খুলে ফেললেন। নিচের তালা খুলে গেল। সেই সময় অধীর বেপরোয়া গলায় মিসেস হোয়াইট বললেন, ‘একটু নিচে নেমে এসো প্লিজ। আমি ওপরের তালার নাগাল পাচ্ছি না! তুমি একটু খুলে দিয়ে যাও প্লিজ! হারবার্ট দাঁড়িয়ে আছে। আমার ছেলেটা এই ঠাণ্ডার মধ্যে একা একা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে!’

কিন্তু তার স্বামী তখন নিজের দুই হাত আর হাঁটুতে হামাগুড়ি দিয়ে পুরো মেঝে খুঁজে চলেছেন। আরেকবার... শুধু আরেকবার ঐ বানরের থাবাটি তার চাই। যে করেই হোক বাইরের ঐ বস্তুটিকে তার থামাতে হবে। কিছুতেই ওটিকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না! হ্যাঁ, বস্তু! ওটা এখন এক খণ্ড মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই না! ওটা আর তাদের ছেলে হারবার্ট নয়!

দরজার করাঘাতের শব্দ এখন আরও ঘন হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পুরো বাড়িতে। নিচে তার স্ত্রী তখন একটি চেয়ার ধরে টানাটানি করছেন। তিনি সেটাকে দরজার গায়ে লাগিয়ে ওপরের তালাটির নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছেন। একটা খুট করে আওয়াজ কানে ভেসে এলো মিস্টার হোয়াইটের। ওপরের তালাটা কি তার স্ত্রী খুলে ফেলেছে? নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দে তার নিজের কানেই তালা লেগে যাওয়ার দশা হলো। ঠিক সেই সময়ই তিনি ঐ জিনিসটা খুঁজে পেলেন... বানরের থাবাটিকে।

দ্রুত হাতে থাবাটিকে ধরে তিনি স্পষ্ট ভাষায় চিৎকার করে তার সর্বশেষ এবং তিন নাম্বার ইচ্ছাটি বললেন, ‘ওটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও! ঢুকতে দিও না ভেতরে!’


যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনি আচমকাই সবকিছু আবার শুনশান হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল দরজার করাঘাত। যদিও একটু আগের শব্দ তখনো প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল পুরো বাড়ি জুড়ে।

চেয়ার টেনে পেছানোর শব্দ ভেসে এলো। সেই সাথে খুলে গেল দরজা। একটা শীতল বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল পুরো ঘরটা। সিঁড়ির মুখে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার হোয়াইটকেও স্পর্শ করে গেল সেই হিমকাতর শীতলতা।
আশাহতের যন্ত্রণামাখানো স্ত্রীর তীব্র চিৎকার কানে যেতেই তিনি দুই পায়ে যেন শক্তি ফিরে পেলেন। করেছে! বানরের থাবা তার শেষ কাজটিও ঠিকঠাকমত করতে পেরেছে!


দ্রুত পায়ে নিচে নেমে স্ত্রীর পাশে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন মিস্টার হোয়াইট।

রাস্তার ওপরপাশের স্ট্রিটলাইটের আলো তখন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেক ঘটনার নির্বাক সাক্ষী ... একাকী ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তাটিকে।




(ব্রিটিশ সাহিত্যিক উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জেকবস বা সংক্ষেপে ডাব্লিউ ডাব্লিউ জেকবস এর সবচেয়ে স্মরণীয় সাহিত্যকর্ম হচ্ছে ‘দ্যা মাংকি’জ প’। ‘বানরের থাবা’ গল্পটি ‘দ্য মাংকি’জ প’ থেকেই ভাবানুবাদ করা হয়েছে। সহজবোধ্যতার জন্য কিছু জায়গায় শব্দ এবং ভাষাগত কিছু রদবদল করা হয়েছে। কিছু জায়গায় গল্পটিকে সামান্য পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করা হয়েছে। অবশ্যই সেসব পরিমার্জনার কারণে কালজয়ী এই গল্পটির মৌলিকত্ব যাতে কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ না হয়, সেই দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। --- ফাহ্‌মিদা বারী)

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৩৪
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×