somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

▬▬▬▬▬▬ஜ স্বপ্নের শেষ ঠিকানা, জান্নাত ஜ▬▬▬▬▬▬

১৭ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আল কুরআনের আভাসে তৈরী জান্নাতের একটি কল্পচিত্র । শুধুমাত্র বিশ্বাসী পাঠকদের জন্য ।)

❑ ❑ প্রাক-ভূমিকাঃ

হাদিসে কুদসিতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন, দুনিয়ার কোন মানুষের চোখ যা দেখেনি, কান যা শুনেনি, মন যা কল্পনা করতে পারেনি এমনসব জিনিস আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য জান্নাতে রেখেছি । (বুখারি ও মুসলিম)

এই একটি ছোট্ট বাক্যেই চিরস্থায়ী ও পরম সুখের জান্নাতে প্রিয় বান্দা-বান্দিদের জন্য কেমন চোখ ধাঁধানো, প্রাণ জুড়ানো ভোগ-বিলাসের বস্তু সৃষ্টি করে রেখেছেন, তার সার্থক চিত্র এঁকে ফেলেছেন মহান আল্লাহতায়ালা ।

আল্লাহ বলেছেন,
বলো, যদি সমুদ্রের জল কালি হয়ে যায়, আর সেই কালিতে আমার রবের নেয়ামতের বর্ণনা লেখা শুরু করা হয়, সমুদ্র শুকিয়ে যাবে, কিন্তু আমার রবের নেয়ামতের বর্ণনা বাকি রয়ে যাবে । যদি আরেকটি সমুদ্রকে কালি বানিয়ে লেখা চালিয়ে যাওয়া হয়, তবুও তা যথেষ্ট হবে না ।
--সুরা আল ক্কাহাফ, আয়াত ১০৯ ।

এই কথা জানার পরও হাতেগোনা কিছু শব্দ ও বাক্যে জান্নাতের সুখ ও সৌন্দর্য্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আমার মতো নাদান কোন মানুষের ক্ষেত্রে হাস্যকর এক বালখিল্যতা ছাড়া আর কিছুই না ।

সমগ্র কুরআনে সুদীর্ঘ কোন মুভির টুকরো-টাকরা ক্লিপের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অকল্পনীয় সুখ ও সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি চিরস্থায়ী জান্নাতের সামান্য কিছু আভাস । সেই ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো ইঙ্গিতময় টুকরো দৃশ্যগুলিকে জোড়াতালি দিয়ে, কল্পনার সব রঙ মিশিয়ে, ভাষার উপর নিজের সমস্ত অধিকার খাটিয়ে, মোটামুটি বড় একটি ক্যানভাসে হৃদয়ের তুলিতে সাধ্যমতো আঁকার চেষ্টা করেছি জান্নাতের সুখ ও সৌন্দর্য্যের অতি ক্ষুদ্র এক কল্পচিত্র । নিসংকোচে বলতে পারি, এই অসম্ভব প্রচেষ্টা অন্ধের হাতি দেখার চাইতে বেশী কিছু হয়নি ।

এই আনাড়ি কিন্তু ঘামঝরানো কল্পচিত্র রচনায় আমি শুধুমাত্র কুরআনের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আয়াতের ভাবানুবাদ, যৌক্তিক কল্পনা আর বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করেছি । আমি হাদিসের তথ্যাবলী এই চিত্রে যোগ করার অসম্ভব চেষ্টা করিনি, কারন হাদিসের বিশাল ভান্ডার থেকে তথ্য যোগ করতে গেলে এই চিত্র মহাকাব্যিক ব্যাপকতা পেয়ে যাবে । মহাগ্রন্থ আল কুরআনের যে সব সুরা থেকে আমি আমার কল্পচিত্রের উপকরন সংগ্রহ করেছি তাদের নাম ও আয়াত নাম্বার আমি আগ্রহী পাঠকদের জন্য লেখার শেষে সংযুক্ত করে দিয়েছি ।

আমার এই আনাড়ি প্রচেষ্টার সমস্ত ভুল-ত্রুটিগুলিকে ক্ষমা করে দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা যেন জান্নাতের ওয়ারিশদের তালিকায় একেবারে শেষে হলেও ছোট্ট করে আমার নামটি বসিয়ে দেন । আমীন ।

❑ ❑ ভূমিকাঃ

আল কুরআনে জান্নাতের বর্ণনা পড়ার সময় প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে যে কুরআন নাজিল হয়েছিল চৌদ্দশ বছরেরও বেশী সময় আগে আরবের ধূ ধূ মরুভূমিপ্রধান মানবসমাজে । যেখানে চিরহরিৎ অরণ্য ছিল না । ছিল না নদ-নদী, ঝর্ণা, আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ তৃণভূমি ।

মূলতঃ সে সময়ে আরবের বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, ভূ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ভোগ বিলাসের উপায়-উপকরন, অবসর বিনোদনের অনুষঙ্গ, সংস্কৃতি, মানুষের রুচিবোধ ও মানসিকতা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটেই জান্নাতের সুখ স্বাচ্ছ্যন্দের উদাহরন দিয়ে অবিশ্বাসীদেরকে প্রলুদ্ধ, এবং বিশ্বাসীদেরকে উৎফুল্ল করার চেষ্টা করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা ।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ বদলে গেছে পৃথিবীর বহু কিছু । আধুনিক বিশ্বে মানুষের রুচিবোধ, মানসিকতা, চাহিদা, ভোগ-বিলাস ও বিনোদনের জগতে ঘটেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন । এই প্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করলে জান্নাতের বর্ণনাকে কিছুটা সেকেলে, অদ্ভূত ও পানসে মনে হতে পারে কারো কারো কাছে । যেমনটি মনে হবে আরও পাঁচশো বছর পরের মানুষের কাছে বর্তমান সময়ের রুচিবোধ, প্রয়োজন, সুখ, সম্ভোগ, ভোগ-বিলাস কিংবা বিনোদনের সর্বাধুনিক অনুষঙ্গগুলিকে ।

তবে যত পরিবর্তনই আসুক মানব সমাজে, মানুষের মৌলিক কিছু স্বভাব ও চাহিদা চিরন্তনই থেকে যাবে । মানবসৃষ্টির শুরু থেকেই উৎকৃষ্ট খাদ্য ও পানীয়, উন্নত পোশাক, এবং আকর্ষনীয় নারী মানব মনোরঞ্জন এবং ভোগ-বিলাসিতার মৌলিক ও অন্যতম প্রধান উপাদান ও অনুষঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছে । নতুন নতুন রুচি ও মানসিকতার প্রভাবে এইসব উপাদান ও অনুষঙ্গে ভিন্নতর স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ যুক্ত হয়েছে মাত্র । বিচিত্র ক্রীড়া-কৌতুক, শিল্প ও সৌন্দর্য্য ইত্যাদি মানুষের চিত্ত বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যম । এসবও আপেক্ষিক, স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তনশীল ।

তাই কোন সন্দেহ নেই যে, স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় জান্নাতে রুচি ও চাহিদামাফিক মানব ভোগ-বিলাসিতা, সুখ-সম্ভোগ ও চিত্ত-বিনোদনের উপাদান ও অনুষঙ্গের অঢেল ও অফুরন্ত সরবরাহ থাকবে ।

জান্নাতের ভোগ্যসামগ্রীর মধ্যে মদের পৌনঃপুনিক উল্লেখ দেখে আজীবন মদকে ঘৃনার চোখে দেখা মুসলমানরা হয়তো অস্বস্তি বোধ করতে পারেন । কিন্তু মনে রাখতে হবে, মদ বা শরাব চিরকালই বিশ্বমানবের কাছে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন পানীয় । পৃথিবীতে তৈরী মদ স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং বুদ্ধিবিভ্রম ঘটায় বলেই মদকে আল্লাহ নিষিদ্ধ পানীয় ঘোষনা করেছেন । ঈমানী ঘৃনায় মুসলমানরাও তাই মদকে পরিহার করে চলে । কিন্তু জান্নাতের মদ বা শ্যাম্পেইন হয়তো আধুনিক যুগের উৎকৃষ্ট ফ্রুট জুসের মতো হবে । সুরভিত, সুস্বাদু এবং রুচিকর । সেই শরাব দেহমনে বৈকল্য তৈরী করবে না, হবে হাইলি রিফ্রেশিং ও এনার্জাইজিং । আল্লাহই ভালো জানেন ।

আল কুরআনে জান্নাতের বর্ণনায় মুমিন পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য বারবার অসংখ্য আয়তলোচনা, লাজরাঙা ও অপরূপা হুরপরীর প্রলোভন দেখিয়ে আল্লাহ তাদের স্বাভাবিক ও মজ্জাগত বহুগামী প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । জান্নাতের উত্তরাধিকারী মুমিনা নারীরা এই প্রতিশ্রুতিটির ঘনঘটা দেখে এবং নিজেদের জন্য সুন্দরতম ও প্রেমময় পুরুষের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় ঘাটতি দেখে হয়তো বিভ্রান্তি ও গোপন হতাশায় আক্রান্ত হতে পারেন ।

নারীদের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তিতে বহুগামী ভালোবাসা ও যৌনাকাংখার চাহিদা আছে কি নেই সেই মনস্তাত্বিক গবেষনা ও বিতর্ককে একপাশে সরিয়ে শুধু একটা কথাই এ ক্ষেত্রে বলা বোধ হয় যথেষ্ট হবে যে, জান্নাতে কোন মানুষের কোন চাহিদাই কখনো অপূর্ণ থাকবে না । ব্যস্ ।

আরেকটি কথা । নারীদের বহুগামি যৌনাচারের প্রবণতা যেহেতু পৃথিবীতে সকল যুগে সকল সমাজেই ‘সোশ্যাল ট্যাবু’ অর্থ্যাৎ অস্বাভাবিক ও অনাকাংখিত বিষয় ছিল, তাই কুরআনে যদি কোন নারীর জন্য বহু সুপুরুষের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের পৌরুষত্ব, মর্দামি আর শৌর্য্যবীর্যের প্রশস্তি গাওয়া হতো, তাহলে পুরুষনিয়ন্ত্রিত এই পৃথিবীর প্রচলিত ও সভ্য রুচিতে তা স্থূল, অশ্লীল ও বিব্রতকর বলে বিবেচিত হতো ।

অনেক ভূমিকা হয়েছে । চলুন এবার ঘুরে দেখা যাক ঈমানদার নারী-পুরুষের আজীবন লালিত স্বপ্নের শেষ ঠিকানা জান্নাতের মায়াবী ভুবন ।

▓▒░ স্বপ্ন হবে সত্যি ░▒▓

শেষ বিচারের ময়দানে ডান হাতে বিচারের রায় বা আমলনামা পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে ঈমানদাররা । খুশীতে ঝলমল করতে থাকবে তাদের চেহারাগুলি । ফেরেশতাদের সবিনয় পথনির্দেশনায় দলে দলে জান্নাতের কাছে গিয়ে পৌঁছুবে তারা । পৃথিবীতে বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, সন্তানদের মধ্যে যারা জান্নাতি হবে তারাও থাকবে জান্নাতিদের সাথে । গিয়ে দেখবে তাদেরকে সাদরে বরন করার জন্য জান্নাতের দরজাগুলি খুলে জান্নাতের মহাব্যবস্থাপক সকল ফেরেশতাদেরকে নিয়ে সহাস্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে । তাদেরকে দেখে জান্নাতের মহাব্যবস্থাপক বলবেন,
--আসসালামু আলাইকুম, হে জান্নাতের উত্তরাধিকারীগন । দুনিয়াতে সংযম ও ধৈর্য্য ধারনের অনন্য পুরস্কার হিসাবে মহান আল্লাহ এই জান্নাতকে আপনাদের জন্য ঠিকানা বানিয়েছেন । ভেতরে প্রবেশ করে দেখুন, আপনাদের অনন্ত জীবনের জন্য কি অকল্পনীয় মেহমানদারির ব্যবস্থা করে রেখেছেন দয়াময় আল্লাহ! আসুন আপনারা, ভেতরে প্রবেশ করুন ।

তারপর আল্লাহর মেহমান জান্নাতবাসিদেরকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে যাবে ফেরেশতারা । পৌঁছে দেবে যার যার ঠিকানায় ।

পৃথিবী ও মহাকাশের মতো বিশাল ও সুবিস্তৃত জান্নাতে নিজ নিজ ঠিকানা বুঝে পেয়ে তাদের রবের শুকরিয়া প্রকাশ করবে ঈমানদাররা । তারপর সুবিস্তৃত বিশাল জান্নাতের যে কোন স্থানে তারা ঘর-বাড়ি পছন্দ করে বাস শুরু করবে ।

সবচেয়ে ছোট জান্নাতটিও আয়তনে হবে অন্তত পৃথিবীর দ্বিগুন ।

জান্নাতের অলৌকিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে, পরিবর্তিত শারীরিক এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে, মানুষের জীবনধারা, আচরন, রুচিবোধ, আবেগ-অনুভূতিগুলি সম্পূর্ণ ভিন্নতর হবে । জীবন হবে সম্পূর্ণ নিস্কলুষ, পাপমুক্ত, আনন্দময়, একঘেয়েমীমুক্ত, স্বাধীন ও নির্ভয় ।

নিজেদের জন্য জান্নাতে বাদশাহি শান-শওকত, আড়ম্বর, আরাম আয়েস, ভোগ বিলাসের চোখ ধাঁধানো ও অকল্পনীয় আয়োজন দেখে চোখ কপালে উঠবে জান্নাতের বাসিন্দাদের । উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠবে তারা,
--আহ, কি আনন্দ, এটি আমাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা । আর কোনদিন আমাদের মরতে হবে না । মৃত্যু একবার ঘটে গেছে আমাদের । সারাক্ষন আর পরীক্ষা কিংবা শাস্তির ভয়েও আমাদের অস্থির থাকতে হবে না । ইয়েস, আমরা সাকসেসফুল !

আল্লাহ বলবেন,
আজ আমি তোমাদেরকে দেয়া আমার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করছি । দুনিয়ার জীবনে আমার আনুগত্য করার পূর্ণ প্রতিদান দিচ্ছি আমি তোমাদেরকে । যাও সুপ্রিয় মেহমানরা, খাও, দাও, ফূর্তি কর ।

বেহেশতে থাকবে অপার শান্তি ও নিরাপত্তা । কোন ধরনের শত্রু কিংবা বিপদ-আপদের ভয় থাকবে না । আদিগন্ত বিস্তৃত গভীর অরণ্য, ফলের বাগান, পাহাড়সারি, সবুজ উপত্যকা, কাকচক্ষু টলটলে জল নিয়ে অগুনতি শাখাপ্রশাখায় ছুটে চলা চপল নদী ও ঝর্ণাধারার দিকে তাকালে দেহমন জুড়িয়ে যাবে, অানন্দে নাচতে ইচ্ছে হবে ।

এই নির্মল ও নয়নাভিরাম নিসর্গের মাঝেই হাজারো ফলদ ও বনজ বৃক্ষ, নয়ানিভারম ফুলের কেয়ারি আর লতাপাতার ছায়ায় ঘেরা, সাজানো-গোছানো অসংখ্য স্বপ্নের মতো বাগান বাড়ি এবং সুদৃশ্য মার্বেল পাথরের সুউচ্চ অট্টালিকা জান্নাতের বাসিন্দাদের বাসস্থান হবে । তাদের একক মালিকানাতেই থাকবে সীমাহীন সম্পদ ও প্রাচুর্য্য । অনন্তকাল ধরে ভোগ করেও শেষ করা যাবে না পৃথিবীর পরীক্ষায় পাশ করে আসা সফল মানুষদের জন্য আল্লাহর ওয়াদাকৃত পুরস্কার এইসব নিয়ামত ।

ডাগর চোখের লাজনম্র, আনতমস্তক, অপরূপা সুন্দরী কুমারীদের সাথে ঈমানদেরদের বিয়ে পড়িয়ে চিরসঙ্গী করে দিবেন মহান আল্লাহ । সেই বিয়ের কাজী হবেন তিনি নিজে । আর মুমিনা নারীদেরকে পরীর মতো সুন্দরী কুমারী বানিয়ে বিবাহিত সঙ্গি করা হবে রাজপুত্রের মতো সুদর্শন সব যুবকের ।

পৃথিবীতে কোন জান্নাতি পুরুষের স্ত্রী যদি জান্নাতবাসী হয়ে থাকে তাকেও সুন্দরী ও সমবয়সী কুমারী বানিয়ে স্বামী-অনুরক্তা সঙ্গী বানিয়ে দেয়া হবে । যদি তারা চায় ।

ঘুচে যাবে একাকিত্ব । মনের মতো সঙ্গীদের পেয়ে স্বর্গীয়, নিস্কলুষ ও নিখাঁদ ভালোবাসার সংসার পাতবে জান্নাতিরা । কোন কিছুর অভাব থাকবে না তাদের । কারো কোন চাহিদা বা প্রয়োজনই অপূর্ণ থাকবে না । যখন যা কামনা করবে, তাই পাবে তারা আল্লাহর ইচ্ছায় । আল্লাহর ভান্ডার অসীম ও অফুরন্ত । জান্নাতের সেই অফুরন্ত ভান্ডারের কোনকিছুতেই তাই ঘাটতি পড়বে না কোনদিন ।

মৃত্যু আর কোন দিন স্পর্শ করবে না জান্নাতের বাসিন্দাদেরকে । কোনদিন তারা বার্ধক্য, জ্বরা, রোগব্যধি কিংবা ক্লান্তির শিকার হবে না । বিচিত্র ও নতুন নতুন নেশা, ব্যস্ততা ও বিনোদনে একঘেয়েমি লাগার কোন সূযোগই থাকবে না জান্নাতে ।

▓▒░ আনন্দ নিবাস ░▒▓

বিশাল ও জমকালো অট্টালিকায় জান্নাতের বাসিন্দাদের জন্য থাকবে জাঁকজমকপূর্ণ আরাম আয়েসের অবিশ্বাস্য আয়োজন । সে আয়োজনে চুল পরিমান ঘাটতি থাকবে না কোন কিছুর ।

সুসজ্জিত শয়নকক্ষে বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য থাকবে সুউচ্চ ও সুবিশাল সব খাট-পালঙ্ক । থাকবে মখমলের মতো কোমল, তুলতুলে ও আরামদায়ক তোষক, বালিশ, সুদৃশ্য চাদর । বসার জন্য থাকবে রাজকীয় সিংহাসনের মতো অভিজাত ও আরামদায়ক উঁচু উঁচু সোফা । আলমিরা আর আলনাভর্তি থাকবে সোনা রূপার সূতোয় সূক্ষ্ম কাজ করা, ঝলমলে রেশমী পোশাক । উজ্জ্বল সবুজ রঙের সে পোশাক হবে সুচিক্কন, মসৃণ, ও আরামদায়ক ।

টেবিল ভর্তি উপাদেয় ও রকমারী খাদ্যের সমাহার থাকবে । থাকবে হরেক রকম রসালু ও সুস্বাদু ফল থরে থরে সাজানো । পছন্দমাফিক যা খুশী, যতটুকু খুশী, যতক্ষন খুশী উপভোগ করতে পারবে জান্নাতের গৌরবান্বিত বাসিন্দারা এসব কিছু । ঘরের সমস্ত হাঁড়ি-পাতিল, থালা, বাটি, পেয়ালা, চামচ, পিরিচ তথা ডিশগুলি হবে খাঁটি ও উজ্জ্বল সোনা-রূপার তৈরী ।

পৃথিবীতে বিলাসী মানুষদের বাড়িতে যেমন থাকে গরম ও ঠান্ডা পানির ধারা বয়ে আনা দু ধরনের নির্গম-নল, তেমনিভাবে জান্নাতের বসতবাড়িগুলির অসংখ্য সুরম্য ও বিলাসবহুল কক্ষের ভেতরে থাকবে কয়েক ধরনের পানীয়ের লাইন ও ট্যাপ ।

একটি লাইন বা নির্গম-নল বয়ে আনবে কর্পূরের গন্ধবিশিষ্ট সুপেয় ও স্বচ্ছতোয়া পানি । আরেকটি কল ছাড়লেই উজ্জ্বল রূপার নকশা করা ঝলমলে কাঁচের গ্লাস ভরে দেবে ‘সালসাবিল’ নামক প্রস্রবন থেকে চলে আসা আদা মিশ্রিত নির্জলা শরাব । অমৃত এই ওয়াইনের সাথে প্রয়োজন অনুপাতে পানি মিশিয়ে পান করবে ঘরের বাসিন্দারা । বিশুদ্ধ ও পরিশোধিত মধুর ধারা প্রবাহিত হবে তৃতীয় আরেকটি লাইনে । তিনটি পানীয়ের উৎসই হবে ভুগর্ভস্থ প্রস্রবণ । অনিঃশেষ ধারায় প্রবাহিত হবে এসব প্রস্রবণ ।

ধবধবে সাদা, পরম উপাদেয় ও রুচিকর দুধের উৎস থেকে টাটকা দুধ ঘরের ভেতরে বয়ে নিয়ে আসবে চতুর্থ আরেকটি নির্গম-নল । কখনোই এই দুধের অনন্য স্বাদ ও গন্ধে সামান্যতম বিকৃতি আসবে না । কখনোই তাতে পচন ধরবে না ।

জান্নাতের বাসিন্দারা তাদের সুরম্য ঘর-বাড়িগুলির যে কোন স্থানে, কিংবা বাড়ির বাইরে বিস্তীর্ণ বাগানে, পথের দু পাশে কিংবা বিশাল ভুখন্ডের যেখানে খুশী, চাইলেই এই অমৃত ওয়াইন, মধু, দুধ ও পানির লাইনের অসংখ্য শাখা প্রশাখা টেনে নিতে পারবে । যখন যেখানেই যাক না কেন তারা, হাতের কাছেই সব সময় পাওয়া যাবে পছন্দের পানীয় ।

হুকুম তামিলের জন্য সারাক্ষন কাছেই হাজির থাকবে সেবা ও মেহমানদারিতে সদাপ্রস্তুত গেলমান বা চিরসবুজ কিশোররা । মুক্তোর মতো সুন্দর ও গৌরকান্তি নধর, ঈষৎ রাঙা ও টকটকে চেহারার হাসিখুশী চিরকিশোর তারা । থাকবে ফেরেশতাদেরও মদদ । কারনপৃথিবীর মতো জান্নাতেও ফেরেশতাদেরকে মানুষের সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য আদেশ দিবেন আল্লাহ ।

বাড়ির বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যাবে অনেক নীচে সবুজ উপত্যকার বুক চিরে, বনের গাছপালার ভেতর দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে চঞ্চলা ঝর্না । কাকের চক্ষুর মতো স্বচ্ছ, নির্মল ও টলটলে তার জল । সে জলে খেলা করছে হরেক রঙের মাছ । সুনীল আকাশে মনের আনন্দে উড়ছে পাখিরা ।

জান্নাতে না থাকবে শীতের তীব্রতা, না থাকবে রোদের দাবদাহ । বন-বনানির সবুজ শ্যামলিমা, পাখির কুজন, ঝর্নার কুলকুল ধ্বনি, ভেসে আসা ফুলের সুঘ্রাণ, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাশে দাঁড়ানো প্রিয়তম মানুষের ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়া, উদ্বেগহীন পরম নিশ্চিন্ত সময়—সবকিছু মিলিয়ে মায়াবী ও অলৌকিক এক সুখের ভুবন তৈরী হবে জান্নাতে ।

সহসা দমকা বাতাস কোত্থেকে এসে দুষ্টু ছেলের মতো এলোমেলো করে দিয়ে যাবে মাথার চুল ।

▓▒░ ভোগের ভুবন ░▒▓

প্রত্যেক জান্নাতি ব্যক্তির জন্য জান্নাতের বিশাল ভুবনে বিত্ত-বৈভবে পূর্ণ দু’টি ভূখন্ড থাকবে । একটিতে থাকবে গ্রামীন পরিবেশ, অন্যটি অত্যাধুনিক শহুরে বৈশিষ্ট্য । পৃথিবীর চাইতেও বিশাল প্রতিটি অংশ । একটির অংশের সাথে আরেকটির কোন মিল থাকবে না । প্রতিটি ভূখন্ড স্বকীয় ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল থাকবে । তাদের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা ও আঙ্গিকের । দুই ভূখন্ডের বাগানে থাকবে দুই ধরনের গাছপালা, ফুল, ফল, লতাপাতা । দুই অংশেই বহু শাখা প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়ে বয়ে যাবে দুটি নদী । থাকবে দুটি দৃষ্টিনন্দন জলপ্রপাত ।

উন্নত ও অত্যাধুনিক বহু শহর, নগর, বন্দরসমৃদ্ধ অঞ্চলও হয়তো থাকবে পৃথিবীর চাইতে বহুগুন বড় একক মালিকানাধীন জান্নাতের ভূখন্ডগুলির কোথাও । জীবন-যাপন, আরাম-আয়েস, বিনোদনের জন্য সেখানে থাকবে দুনিয়ার সর্বশেষ যুগে চরম উৎকর্ষে পৌঁছানো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবিত ও আবিস্কৃত যাবতীয় সূযোগ সুবিধা ও উপকরণ । প্রকৃত সত্য জানেন একমাত্র আল্লাহ ।

জান্নাতের অধিবাসীরা ভ্রমন কিংবা শিকারের জন্য যখন যে ভূখন্ডে খুশী যাবে সদলবলে । হই-হুল্লোড় করতে করতে । অজানা অচেনা অরণ্যের কোথাও গিয়ে বিশ্রাম নিতে থামবে তারা । গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় সবুজ ঘাসের উপর দামী ও আরামদায়ক ফরাশ পেতে বসবে । পাশে বসবে তাদের লাজরাঙা প্রিয়তমা বধুরা । সদ্য পারা মুরগির ডিমের মতো ঈষৎ রক্তিমাভাযুক্ত শুভ্র ও সুন্দর গায়ের রঙ তাদের । ভালোবাসার কথা বলবে তারা, থেকে থেকে রিনিঝিনি হাসিতে ভেঙে পড়বে । হুরপরীদের চোখ ধাঁধানো ও উপচে পড়া রূপ-যৌবনের নেশায় বুঁদ হয়ে সুখের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকবে সৌভাগ্যবান জান্নাতি পুরুষরা ।

সোনা রূপার ডিশে উপাদেয় খাদ্য, ফলমূল আর সুস্বাদু পানীয় নিয়ে চারপাশে অপেক্ষায় থাকবে সেবা ও মেহমানদারিতে সদাপ্রস্তুত গেলমান বা চিরসবুজ কিশোররা । শূণ্য পানপাত্র বাড়িয়ে ধরলে সংগে সংগে সেগুলি শীতল, সুমিষ্ট, সুরভিত অমৃত ওয়াইন কিংবা ফলের জুসে পূর্ণ করে দেবে তারা ।

সুনীল জলের হ্রদ কিংবা নদীর স্রোতে সবান্ধবী সাঁতার কেটে, দোলনায় একসাথে বসে দোল খেয়ে, শিকারের পেছনে রোমাঞ্চকর ধাওয়া করে, আর পাহাড়ি ঝর্ণার পানিতে পা ডুবিয়ে পাথরের উপর বসে থেকে থেকে স্বপ্নের মতো কেটে যাবে কত যে সহস্র বছর কে জানে ।

কোন ভয়, উদ্বেগ, অস্থিরতা, অশান্তি কিংবা শংকা থাকবে না সেখানে ।

▓▒░ উৎসব ও আয়োজন ░▒▓


জান্নাতে নিজের অঞ্চলের কোন একটি অংশে থাকবে জান্নাতপ্রাপ্ত দুনিয়ার আপনজনের সাথে বসবাসের সূযোগ । সেখানে তারা একত্রিত হবে, আনন্দ করবে আর ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারনে মেতে উঠবে ।

মাঝে মাঝে পৃথিবীর সেইসব আত্মীয়-স্বজন নিয়ে গেট টুগেদার পার্টি করবে জান্নাতিরা । সেই পার্টিতে থাকবে টক-ঝাল-লেহ্য-পেয় সব ধরনের সুস্বাদু, উপাদেয় ও জিভে জল আনা খাবার-দাবারের অঢেল সমাহার । থাকবে আস্ত টার্কির সুস্বাদু রোস্ট । সোনা-রূপার ঝলমলে রেকাবিতে থরে থরে সাজানো রকমারি, বর্ণিল ও মজাদার ফল । ঝর্ণার সুপেয় পানি, মধু আর টাটকা দুধের সাপ্লাইতো থাকবেই হাতের কাছে । শুধু ট্যাপ ছাড়লেই হলো ।

ব্যস্ত গেলমানরা ছিপি-আঁটা আনকোরা বোতলের সিল খুলে তাদের সামনে পরিবেশন করবে ফেনায়িত টাটকা শরাব বা ওয়াইন । সে সুস্বাদু ওয়াইনে মেশানো থাকবে তাসনিমের সৌরভ । সেই অমৃতের সুঘ্রাণে চারপাশটা ভেসে যাবে ।

দ্রুত হাত বদল হতে থাকবে অমৃত সুধার বোতল ও গ্লাস । গ্লাসের পর গ্লাস আকন্ঠ পান করে অলৌকিক নেশায় বুঁদ হয়ে যাবে সবাই । তবে জান্নাতি এই শরাবান তহুরা আকন্ঠ পান করলেও কারো মাথা কখনোই ঝিমঝিম করবে না, দৃষ্টি ঘোলাটে হবে না, বোধবুদ্ধি লোপ পাবে না । প্রলাপ বকবে না কেউ ।

কোন দুর্মতি, রুচি বিকৃতি, অশ্লীল ও কু চিন্তা, ঈর্ষা ও শত্রুতা তৈরী হবে না জান্নাতিদের মনে । দেহ ও হৃদয়ের সমস্ত কলুষিতা ও দোষকে আল্লাহ দূর করে দিবেন । থাকবে ক্ষমা ও চিত্তের প্রশান্তি ।

কখনো হয়তো প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বিনোদন পার্টি হবে । সেসব পার্টিতে উপাদেয় ও সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয় ছাড়াও মনোরঞ্জনের জন্য থাকবে উদ্ভিন্ন যৌবনা, সুসজ্জিতা, অপাপবিদ্ধা সুন্দরী তরুনীর দল । প্রাণ খুলে স্ফূর্তি করবে তারা । জমে উঠবে পার্টি ।

জান্নাতে শয়তান ও তার স্যাঙাতরা থাকবে না । শয়তানের অনুপস্থিতিতে মানুষের অন্তরে নফসে আম্মারাটাই মরে যাবে । তাই মানুষের হৃদয়ে থাকবে না কোন পাপচিন্তা, হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, সংকীর্ণতা, শত্রুতা, ঘৃণা, ক্ষোভ কিংবা অভিমান । এ কারনেই কোন ধরনের উগ্রতা, খিস্তি-খেউর, নোংরা কথাবার্তা কারো মুখ দিয়ে বের হবে না এসব বিনোদন পার্টিতে । সুন্দর, রুচিশীল ও নির্মল উৎসব উপভোগে মেতে উঠবে সবাই ।

▓▒░ প্রমোদ বিহার ░▒▓

ডাগর নয়না অনিন্দ্যসুন্দরী বান্ধবীদেরকে নিয়ে আনন্দ ভ্রমনে যাবে জান্নাতের ওয়ারিশরা । গভীর কোন বনের সবুজ গাছপালায় ঘেরা নিভৃত ও নিরিবিলি স্থানে তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্প করবে । সবুঝ ঘাসের উপর মখমলের মতো নরম ও আরামদায়ক কার্পেট বিছানো হবে । মনিমুক্তার সূক্ষ্ম কারুকাজ করা, তুলতুলে ও আরামদায়ক তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে তারা সুঃখ-দুঃখের কথা কইবে মনের মানুষের চোখে চোখ রেখে । কখনোবা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে একে অন্যের চোখের গভীরে । সে দৃষ্টিতে উপচে পড়বে ছলনাহীন, গভীর ও প্রগাঢ় ও ভালোবাসা ।

এমন ঘোর লাগা আবেশেই হয়তো কেটে যাবে বহু দিন, মাস, বছর ।

কখনোবা জান্নাতি প্রেমিক-প্রেমিকারা হাতে হাত রেখে চারপাশে ঘুরে বেড়াবে প্রজাপতির মতো মনের আনন্দে । গলা ছেড়ে গান গাইবে । যতদূর চোখ যাবে দেখা যাবে রকমারি ফল গাছের ডাল নূয়ে আছে ফলভারে । মাইলের পর পর জুড়ে ফলের উদ্যান । অবাক বিস্ময়ে জান্নাতিরা দেখবে সব পরিচিত ফলমূলই ধরে আছে বিভিন্ন গাছে । দুনিয়াতে এসব ফল তারা দেখেছে এবং খেয়েছে ।

কোথাও সারি সারি খেজুর গাছে ঝুলছে টশটশে পাকা খেজুর, কোথাওবা কাঁটাবিহীন বরই গাছ ছেয়ে আছে সুস্বাদু কাঁচা পাকা বরইয়ে । কলাগাছে পেকে হলুদ হয়ে থাকা কাঁদিকাঁদি কলার সুঘ্রান নাকে এসে সুরসুরি দেবে । আঙুর বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে পাকা ও রসালো হরেক রঙের আঙুর । সবুজ, কালো, লাল । পেকে টুকটুকে লাল হওয়া আনারগুলি রসের আধিক্যে ফেটে পড়ার উপক্রম করছে । তাদের ভারে গাছগুলির ডাল নুইয়ে আছে । খাবার ইচ্ছা জাগলেই গাছের ডালগুলি হাতের নাগালের কাছে চলে আসবে । হাত বাড়িয়ে তখন যত খুশী পেরে খেতে পারবে জান্নাতিরা সুস্বাদু এসব, এবং এমন আরো অসংখ্য জাতের ফল ।

দুপুরে খোলা আকাশের নীচে হাঁটার সময় ফেরেশতারা মাথার উপর ছাতার মতো মেঘের সামিয়ানা মেলে ধরে রাখবে । রোদের আঁচে যেন সামান্যতম কষ্ট পেয়েও বিরক্ত বোধ না করে জান্নাতিরা । এমনকি গাছের ডালগুলিও সবসময় তাদের মাথার উপর ঝুঁকে পড়ে শীতল ছায়া বিলাবে ।

সন্ধ্যায় শিকার করা পাখির সুস্বাদু বারবিকিউ হবে ক্যাম্প ফায়ারের পাশে । ঝলমলে ও বহুমূল্য পানপাত্রে পরিবেশন করা হবে সুস্বাদু ও ফেনায়িত ওয়াইন । সেই ওয়াইনের মন মাতানো সুমিষ্ট সুবাসে ম ম করে উঠবে চারপাশটা । কাছেই কুলকুল শব্দ করে বয়ে যাবে স্বচ্ছতোয়া ও সুমিষ্ট পানির ঝর্ণা । চাঁদের মায়াবী আলো পড়ে ঝলঝল করতে থাকবে তার স্বচ্ছ জল । রাতজাগা পাখিরা ডাকতে থাকবে দূরে কোথাও ।

ওদিকে তাবুর ভেতরে নেশা ধরানো রূপ যৌবনের ভারে টলোমলো যুবতী হুরপরীরা কন্ঠলগ্না হয়ে সারারাত ভালোবাসা বিলাতে উদগ্রীব হয়ে বসে থাকবে । তাদের প্রণয়কাতর ও লাজরাঙা আহ্বানে মোহাবিষ্টের মতো সুখের নেশার কাছে আত্মসমর্পন করবে জান্নাতি পুরুষরা । হারিয়ে যাবে অনন্ত বাসরের উদ্দাম আনন্দে ।

স্বপ্নের মতো কেটে যাবে সময় । এই সুখ সমুদ্র আর স্বপ্নিল জীবন ছেড়ে আর কোনদিন কোথাও যেতে চাইবে না জান্নাতের পরম সৌভাগ্যবান বাসিন্দারা ।

জান্নাতে রুচি, মানসিকতা, স্বভাব ও বৈশিষ্ঠ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটবে মানুষের । জৈবিক চাহিদা ও সাধ-আহ্লাদ পূরনে মানুষ তাই সেখানে হয়ে উঠবে অকল্পনীয় রুচিশীল, সৌন্দর্য্যপ্রিয় ও দিলখোলা ।

তাদের পঞ্চেন্দ্রিয়গুলি হয়ে যাবে অপার্থিব ও অতিমানবিক ক্ষমতাম্পন্ন । ষড়রিপুর কামরিপুটি ছাড়া অন্যগুলি মানবপ্রকৃতি থেকে বিদায় নেবে । কামরিপুও থাকবে পবিত্র ও চরম অনুগত । মোহ যদি থাকেও তা জান্নাতের সুখের মোহই থাকবে ।

▓▒░ ফিরে দেখা ░▒▓

বিকেলে জাফরানি রঙ আলোতে বিশাল বাগান বাড়ির লনের আরামদায়ক চেয়ারে বসে জান্নাতের বাসিন্দারা উপভোগ করবে চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী । সামনে পাতা টি টেবিলে থাকবে পছন্দমাফিক পানীয় আর হরেকরম উপাদেয় ও মুখরোচক নাস্তা । প্রিয়তমার নারীদের মধুর সঙ্গ উপভোগ করতে করতে সহসা হয়তো চোখে পড়বে দূরের জাহান্নামের আগুনে চড়চড় শব্দে পুড়তে থাকা যন্ত্রনাকাতর কাফেরগুলিকে । দেখে খুব আনন্দ পাবে জান্নাতিরা । হেসে উঠবে তৃপ্তির হাসি ।

এই বদমাশ কাফেরগুলি দুনিয়াতে তাদেরকে দিনরাত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বিষাক্ত হুল ফুটাতো । পথে-ঘাটে দেখা হলেই খিক খিক করে গা জ্বালানো হাসি হাসতো আর চোখ টিপ দিতো । তাদেরকে শয়তানগুলি বেওকুফ ও পাগল বলে ডাকতো । দুনিয়ার জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছিল এই নচ্ছারগুলি ।

জান্নাতের চোখ ধাঁধানো জৌলুস, আরাম আয়েস, বিলাস ব্যসনের মাঝে মায়াবতী নারীদের সাথে মধুর ও অন্তরঙ্গ কোন আড্ডায় জান্নাতিদের কারো কারো সহসা কোন একদিন মনে পড়ে যাবে পৃথিবীর জীবনে পাওয়া নিজের অবিশ্বাসী স্ত্রীটির কথা । সেই অবাধ্য ও পথভ্রষ্ট স্ত্রী আখিরাতের কথা বিশ্বাস করতো না মোটেও । সারাক্ষন তাকে অশান্তিতে রাখতো । সেই হতভাগিনীর করুন পরিণতি দেখাতে রূপার ব্রেসলেট পরা সুশোভিত হাতের আঙুল নীচের দিকে তাক করে সে সবার মনযোগ আকর্ষন করবে । দেখা যাবে জাহান্নামের অতলে আগুনে পুড়ে বারবার ছাই হচ্ছে সেই নারী, আর মর্মান্তিক যন্ত্রনায় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চীৎকার করছে ।

সেই কপালপোড়া নারীর মনযোগ আকর্ষন করতে চেঁচিয়ে উঠবে তার সৌভাগ্যবান প্রাক্তন স্বামী,
--এই যে ম্যাডাম, শুনতে পাচ্ছো । আল্লাহর কসম, আরেকটুর জন্য আমি ধ্বংশ হতে বসেছিলাম তোমার পাল্লায় পড়ে । আল্লাহর রহমতে আমি তোমাদের মতো ক্রিমিনালদের দলে শামিল হইনি । তাই বেঁচে গেছি জাহান্নামের চরম যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি থেকে । আলহামদুলিল্লাহ ।

জান্নাত থেকে তাকালে দেখা যাবে দূরে আল আরাফে অবস্থানরত মানুষগুলিকে । দুনিয়াতে ভালো আর মন্দ কর্মের অনুপাত সমান হয়ে যাওয়ায় জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে গেছে তারা । তবে জান্নাতও জুটেনি তাদের ভাগ্যে । জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের ওয়েটিং লিস্টে আছে তারা ।

জান্নাতের বাসিন্দাদেরকে দেখে সালাম দিবে তারা । আর জাহান্নামের দিকে তাকিয়ে ভয়ে শিউরে উঠে বলবে,
--হে আমাদের রব, ঐ জালিমদের সাথে আমাদেরকে শামিল করো না ।

জাহান্নামের অধিবাসী বড় বড় কিছু কাফের নেতাকে তাদের দৈহিক লক্ষন দেখে চিনতে পেরে আল আরাফবাসিরা বলবে,
--দেখলেতো, তোমাদের বিশাল দলবলও তোমাদেরকে বাঁচাতে পারলো না জাহান্নামের শাস্তি থেকে । দুনিয়ার যে ক্ষমতা ও সম্পদের পূজা করতে তোমরা, তা কোন কাজেই আসেনি তোমাদের । ধিক তোমাদেরকে !

এভাবেই পৃথিবীর ছোট্ট জীবনে ধৈর্য্য, সংযম, বঞ্চনা আর কষ্টের ঈমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, ঈমানদার ও সৎকর্মশীল মানুষরা, অনন্ত যৌবন আর আকর্ষনীয় জীবনসঙ্গী পেয়ে, মহান আল্লাহর অলৌকিক মেহমানদারিতে আনন্দ, ভোগ-বিলাস, আমোদ-প্রমোদ আর মধুর প্রণয়লীলায় জান্নাতের স্বপ্নপুরীতে মহাস্ফূর্তিতে কাটাতে থাকবে তাদের চির রোমাঞ্চকর অমর জীবন ।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে জান্নাতের এইসব পরম সৌভাগ্যবান ওয়ারিশদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন । আমীন ।

≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡
সুরা বাকারা (আয়াত ২৫), আল ইমরান (আয়াত ১৩৩), যুখরুফ (আয়াত ৭১), নাবা (আয়াত ৩১-৩৫), মুতাফফিফীন (আয়াত ২২-৩৫), গাশিয়া (আয়াত ৮-১৬), দাহার (আয়াত ৫-৬, ১২-২০), মুরসালাত (আয়াত ৪১-৪৩), আর রাহমান (আয়াত ৪৬- ৭৬), ওয়াকিয়া (আয়াত ১৫-৩৮), ফুরকান (আয়াত ২৪-২৫), সাফফাত (আয়াত ৪১-৬০), হা মিম আস সিজদা (৩০-৩২), সোয়াদ (আয়াত ৫০-৫৪), দুখান (আয়াত ৫১-৫৭), মুহাম্মদ (আয়াত ১৫), তুর (আয়াত ৭-২৭), যুমার (আয়াত ৭৩-৭৫), রাদ (আয়াত ২৩-২৪) এবং আল আরাফ (আয়াত ৪৬-৪৯) এর ছায়া অবলম্বনে ।
≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡≡

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১:৫২
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×