কাশিমপুর কারাগার। বন্দীদের জন্য খুব একটা ভালো জায়গা এটা কখনোই না। সব থেকে দাগী কয়েদীদের রাখা হয় এখানে। কিন্তু সেই কারাগার গত ৪ মাস ধরে সর্বকালের সেরা সতর্কাবস্থায় আছে। কারন ধারনা করা হয় সর্বকালের সর্বসেরা অপরাধী এই কারাগারে সাজা কাটছে এখন।
সমস্যা অন্য জায়গায়। যে অপরাধীর জন্য সমগ্র কারাগার তটস্থ তার বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নাই। ধারনা করা হয় গতবছর পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট কে হত্যার পিছনে তার হাত ছিলো। এমন কি থাই সামরিক সরকারের পদত্যাগ ও সে করিয়েছিলো ঢাকাতে থেকে। কেউ কল্পনাও করে নাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য এই প্রফেসর এত কিছুর পিছনে ছিলো।
আগামীকাল তাকে পাকিস্তানে নেয়া হবে। পাকিস্তান সরকারের বিশেষ অনুরোধে ইন্টারপোলের সহায়তায় তাকে পাকিস্তানের আদালতে তুলা হবে। এই ৪ মাস ধরে যে কয়েদী খুব সাদামাটা ভাবে দিন অতিবাহিত করছে সে হঠাত এক আবদার করেছে। যাবার আগে সে একজন মানুষের সাথে কথা বলতে চায়। এবং এ সেই মানুষ যে কিনা তাকে ধরতে পুলিস কে সহায়তা করছিলো।
অন্যকেউ হলে কথা , এরকম হাই প্রোফাইলের এক কয়েদীকে নিয়ে গ্যাঞ্জাম খাড়া করার কোন মানেই হয় না। তাই বাংলাদেশ সরকার তার এই খায়েশ পুর্নে আপত্তি রাখে নাই।
আগামীকাল কয়েদিটাকে ইন্টারপোলের হাতে সোপর্দ করা হবে। আর আজ সেই দিন যে দিন সেই কয়েদি সেই লোকটির সাথে দেখা করবে।
কাশিমপুর কারাগারের সামনে একটা পুলিশ জীপ আসলো। সেই লোকটি ধীর পায়ে নেমে এলো। লম্বা, একহারা গড়নের। পুর্বপুরুষ হয়তো ব্রিটিশ ছিলো, অনেক কিছুই উত্তরপুরুষের কাছে দিয়ে গিয়েছে। অদ্ভুত বিষয়, গরমে একটা ওড়নামতো পেচানো তার গলায়। এপেক্স এর স্যান্ডাল, জিনস আর শার্ট, সাধারন একটা লোক, অসাধারন? তার চোখজোড়া। সব কিছু দেখছে তার চোখ, সব কিছু, আর তার মাথা তার থেকে ও কম সময়ে হিসাব কষে যাচ্ছে পরিবেশ টা নিয়ে।
একটা বিশেষ ঘরে তাকে সসম্মানে নিয়ে আসা হলো। কয়েদীর অদ্ভুত খেয়াল, তাকে যে পোশাকে ধরা হয়েছিলো, সে পোষাকে তাকে এই ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে, তবে তার হাতে হাতকড়া লাগানো। কয়েদীটি আজ পাঞ্জাবী পড়া, হলুদ রঙের, মনে হয় হিমুর ভক্ত। কালো জিন্স, একটু অদ্ভুত লাগছে তাকে। আর সে ইচ্ছা করেই খালি পায়ে এসেছে সে, তাকে খালি পায়ে কয়েদ করা হয়েছিলো।
লোকটা যখন ঘরের ভিতরে ঢুকলো কয়েদিটা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো, কিন্তু সে লোকটি নয়, লোকটির চোখে ঘৃনা। যেন তাকে খুন করতে পারলে শান্তি পেতো সে। অনেক বড় শান্তি। দুইজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন একে অপরের মনের গভীরে যেতে চাচ্ছে, যেন বুঝতে চাচ্ছে কে পরের চাল টি কি দিবে, ঠিক দাবাড়ুরা পরের চাল নিয়ে চিন্তা করে।
কয়েদিটাই নিরাবতা ভাঙল, গভীর কন্ঠে বলে উঠলো, “কিহে, আমার ড্রইংরুমে বসবে না?”
লোকটির সাথে যে পুলিশ ছিলো, তার হাত হোলস্টারে গিয়েও থেমে গেলো। সবাই এই লোকের উপর মহা খেপা। বিগত ১০ বছর এই লোক পুরা ঢাকা শহরের আন্ডারওয়ার্ড দাপিয়ে বেড়াইছে, সবার নাকে ডগায় বসে। এত অপরাধ তার মাথায় যে বলা যাবে না। কিন্তু ইন্টারপোলের কারনে তাকে দেশের বাইরে দিতে হচ্ছে। একে ১০০ বার ফাসি দেয়া উচিৎ ছিলো।
কিন্তু লোকটা শান্তভাবে চেয়ারে বসলো। টেবিলের অপর পাশে কয়েদি বসা, হাতে হাতকড়া। লোকটা জবাব দিলো “কেন ডেকেছো?”
“কেন হে বাপু, আমাকে পাকিস্তান পাঠাবে, চলে যাবো তোমাকে ছেড়ে, ভালো লাগে বলো? তাই তো তোমাকে দেখতে আমার মন আনচান করছিলো, তাই ডাক দিলাম।“ সাবলীলভাবে কয়েদীটা বলে গেলো।
-“শুধু শুধু দেখা করার মানুষ তুমি না।“
- “ লে মোর জ্বালা, তোমার মতো এতো ভালো লোককে কি এই অধমের দেখার খায়েশ ও হয় না নাকি?”
কয়েদীর গলায় একটু তাছিল্য আছে, যা ধরা পড়ে। কিন্তু তার চোখ ও বুদ্ধিদিপ্ত। লোকটা তার চোখ দেখে বুঝার চেস্টা করছে, কিন্তু এই এক জোড়া চোখ যা সে কখনোই বুঝতে পারে না।
“আসলে আমি জানতে চাচ্ছিলাম যে আমাকে পাকিস্তানে পাঠানো কি খুব জরুরী? না মানে দেখ নিজের দেশে মরার আলাদা একটা মজা আছে, শান্তির মরন, আহা কে না চায়।“
পুলিশ টা অধর্য হয়ে গেলো। বললো, “এই বলারা জন্য কি আমাদের এখানে ডেকেছো?”
-“ আহা লেলিন মশাই, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। যাহাই হোক, বন্ধুবর, তোমাকে একটা ইনফো দেই , হ্যা, তাকে আমি নিজ হাতে মেরেছিলাম।“
লোকটার চোয়াল এবং হাত দুটোই শক্ত হয়ে গেলো। বললো,”আইরিন কে কেন মেরেছো তুমি?”
- “ আইরিন, আইরিন, বড্ড ভালো মেয়ে ছিলো গো! কিন্তু কি করবো বলো, বড্ড বেড়ে গিয়েছইলো, আর আমার কাজ ও হারাম করছিলো, আর তোমার জন্য তো...... তাই মনে করলাম আইরিনের চেয়ে আমার রাতে ঘুম বেশী লাগবে, তাই তো ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। এই একটা জিনিশ তুমি খুজে পাওনাই, আমি তোমাকে ধরিয়ে দিলাম।“
- “ ধন্যবাদ তোমাকে ধরায় দেবার জন্য, আমার তোমার সাথে আর কোন কাজ নাই।“ লোকটা উঠে দরজা দিয়ে বের হতে লাগলো।
কয়েদিটা হেসে উঠলো, বললো “তোমার সাথে খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে আমার। খুব তাড়াতাড়ি”।
দরজা দিয়ে লোকটা পার হচ্ছিলো, থেমে গেলো। না তাকিয়ে জোরে বললো, “ এই বার গুলি তোমার মাথায় ঢুকবে, প্রফেসর জেমস মরিয়ার্টি”।
বলে সে আর পুলিশ অফিসার লেলিন বের হয়ে গেলো।
আর টেবিলের অপর পাশে হুইল চেয়ারে বসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথ প্রফেসর ড জেমস মরিয়ার্টি নিজের কানে শুনার মতো আওয়াজে নিজেকে নিজে বললো, “তোমার সাথে আবার দেখা হবে”
একটু নিশ্বাস নিয়ে শেষটুকু উচ্চারন করলো,
“শার্লক হোমস।“