গোল্লায় নোঙর এবং হাফপ্যান্ট বাহিনীঃ চেরাপুঞ্জিকে মনে মনে বকতে লাগলাম, এভাবে হঠাৎ করে প্রথম দিনেই চমকে না দিলেও পারতো। তবে বিকেল বেলাটার মজাই ছিল আলাদা, উত্তরে যেন মাথা উপর ছুঁই ছুঁই করছে সুবিশাল পর্বত মালা, পুবের টিলার ওপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের এখানে ওখানে টিলাদের আনাগোনা, দক্ষিণে একটানা জনবসতী আর পশ্চিমের গাঙের ওপারে পাগলা বাবার মোকামের পিছনের ঘেসো টিলার ওপাশে লুকিয়ে যাচ্ছে বিকেলের সূর্যটা; সব মিলিয়ে এই মনোরম নতুনের স্পর্শকে সেদিনের অন্তর স্বর্গীয় সৌন্দর্য সুধা পেল যেন। খুব একটা শীত এসে না পড়েলও পাহাড়ী ঢলের প্রভাবে হিম হিম রাতে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে দ্বিতীয় রাতটাকেও গা কাঁটা দেয়া রাত মনে হলো। লুৎফার বাবা, মানে চাচা তার ঘরের ভেতরেই দোকান সাজিয়ে বসেছেন। এখন হয়তো অনেক পরিবর্তন এসে গেছে, কি জানি, তবে তখনকার দিনে এমন দোকানের অভাব ছিল না সে অঞ্চলে, যেখান থাকার ঘরের প্রথম কামরায় দোকান সাজিয়ে বসতেন গৃহকর্তা বা গৃহকর্তীরা। তেমন একটা মুদী দোকান ছিল লুৎফার বাবার, মাঝে মাঝে খরিদ্দার আসতো, আমরাও চকলেট-বিস্কিট কিনে ফেলতাম হুটহাট। অল্প রাত হতেই খেয়ে দেয়ে সবাই হারিয়ে গেলাম চেরাপুঞ্জির আদরে আদরে অথৈ নিদ্রায়।
দ্বিতীয় দিন ঘুম থেকে উঠলাম বেশ বেলা করে। গোল্লা (পাহাড়ী ঢল) -এর পানি যতটা কমবে বলে ধারনা করেছিলাম, তেমনটি কমেনি। তবে ভয় মোটামুটি কেটে গেছে, তাছাড়া বাড়ীর উঠোন, আশপাশের পথঘাট, রাস্তা এসবে এখন আর পানি নেই। যত্ত পানি আছে সব এখন গাঙের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ঢেউগুলোর দিকে চোখ পড়লেই বুকের ভেতর যেন মোচড় দিয়ে উঠে, একটা ভয় জাগে- যদি কোনভাবে এই দুর্নিবার স্রোতে পড়ে যাই, তাহলে সলিল সমাধি নিশ্চিত, সুরমা পর্যন্ত লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না হয়তো। পূর্বে যেমনটি বলেছিলাম, বাবার পাতানো সব আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই এই দু'দিনে কেউ ভাই, কেউ চাচা, কেউ দাদা ইত্যাদি এবং মহিলারাও সে অনুপাতে ঠিক করে নিলেন কাকে কি ডাকতে হবে। যুবক ভাইদের কয়েকজনকে দেখলাম হাতে কি যেন একটা লোহার বাঁকানো জিনিষ যা দেখতে অনেকটা বড়শীর মত, তবে তিন/চারটা মাথা রয়েছে আর সাথে লাগানো রয়েছে লম্বা এবং মোটা একটা শক্ত দড়ি। কেমন চেনা চেনা লাগছিল, জিজ্ঞেস করতেই সমবয়সীরা বললো এটার নাম "নোঙর", সেই আমার প্রথম নোঙর দেখা, আর তখনি মনে পড়লো সেই যে অ, আ, বইয়ে ছবি দেখেছিলাম, এ তো সেই নোঙর। তো এর কাজটা কি এখানে এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে দেখলাম এক বড় ভাইয়া হেঁইয়া জোরে ছুঁড়ে মারলেন গাঙের মাঝখান বরাবর। তারপর পরই তার সাথে আরো ক'জনে হাত লাগালো রশিতে এবং হেঁইয়ো হেঁইয়ো টানতে টানতে কোনমতে একটা মোটা গাছের সাথে জড়িয়ে বেঁধে ফেললো রশিটা। এবার শুরু হলো গাঙে নামা, দু'একজন নেমে পড়লো আর বাকী দু'একজন উপর কিনার থেকে টানতে লাগলো। অবশেষে যখন কিনারে এসে ঠেকলো, দেখলাম ইয়া মোটা একটা গাছের লম্বা গুড়ি। এসব কাঠের টুকরো কেটে জমা করে রাখে পাহাড়ী খাসিয়া, মগ কিংবা অন্য কোন উপজাতি সমপ্রদায়ের কাঠুরেরা। সময়মত সরিয়ে নিতে পারেনি বলে ঢল ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে আর এভাবেই তীব্র স্রোতের সাথে লড়াই করে এগুলোকে অর্জন করে নেয় গাঙ পাড়ের সাহসী যুবকেরা।
বাধাও কিন্তু কম নয় এই সাহসী সঞ্চয়ে, একদিকে তো রয়েছে সুতীব্র বেগের স্রোতধারা, অন্যদিকে হাফপ্যান্ট বাহিনী; মানে বিডিআর। সাধারণভাবেও টহলদার বাহিনীর কাউকে কাউকে বা হাবিলদারগণকে ফুল প্যান্ট পরতে দেখা যেত, তবে গোল্লার দিনগুলোতে হাফপ্যান্টই বেশী দেখা যায়। বাধা হলো পাহাড় থেকে ভেসে আসা এসব কাঠ, বাঁশ ও অন্যান্য পাহাড়ী সম্পদ কেউ গাঙ থেকে তুলে নিতে পারবে না; এটা বিডআরের নিষেধ। কেউ তুলছে ধরা পড়লেই মহাবিপদ। তাই যারাই স্রোতের সাথে লড়াই করে এসব অর্জন করে, তারা হয় বাড়ীর কোথাও লুকিয়ে ফেলে অথবা সাথে সাথেই টুকরো টুকরো করে লাকড়ী বানিয়ে ফেলে অথবা অন্য কোনভাবে গোপন করে ফেলে দ্রুত। তবে বিডিআর ক্যাম্পের সামনের গাঙে দেখা যায় সারি সারি গাছের টুকরো বাঁধা আছে। কি জানি পরে হয়তো সরকারী মালামালের সাথে যুক্ত হয় কিংবা অন্য কোথাও। সে অঞ্চলের হাফপ্যান্ট বাহিনী আর যুবক ও চোরাচালানীদের মধ্যে চলে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা, কেউ বললেই হলো যে হাফপ্যান্ট বাহিনী আসছে, অমনি পালানো ধুম পড়ে যায়। কারণ, হয়তো দেখা যাবে যে, বিডিআরের লিস্টে তাদের অনেকেরই নাম লেখা আছে। আসলে প্রাবল্যের বিচারে অন্যান্য এলাকার দুর্নীতির মত সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদেরও অনেকেই পরিবেশের কারণে হোক অথবা অন্য কোন কারণে চোরাচালানী, সাহায্যকারী কিংবা গ্রাহক হিসেবে এসবের সাথে জড়িত। তাই তটস্থ থাকে সব কাজেই। অনেককেই দেখা যায় বিডিআরের মত করে হাফপ্যান্ট বানিয়ে নিয়েছে। সব মিলিয়ে একটা এডভেঞ্চার লাগলো গোল্লায় গাছ সংগ্রহের হুলুস্থুল পূর্ণ দ্বিমুখী শত্রুর থেকে ছিনিয়ে নেয়া অর্জনকে।
ছবির জন্য কৃতজ্ঞ যেখানে। ছবিটা হয়তো কোন বন্যার, লেখার সাথে সামঞ্জস্য দেখে দিলাম; তবে সিলেট অঞ্চলের যে এটা নিশ্চিত।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।

