পৃথিবীতে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া বাকী সবকিছুই অনিশ্চিত ।অথচ আমরা সবাই অনিশ্চিত ভবিস্যতের দিকেই দেীড়াই ।অসম্ভাব্যি মৃত্যুকে চাই এড়িয়ে যেতে ।মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না তবে ভুলে থাকার চেষ্টা করা সম্ভব ।আসুন না একটা মৃত্যুর কথা চিন্তা করি !
ধরুন প্রতিদিনের মতো আজও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের জোরাজুরিতে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলেন ।খুব সকাল বলতে সকাল ৯ টা ।বাবা ততক্ষনে হতচ্ছাড়া ছেলের প্রতি এক পশলা ক্ষোভ ঝড়িয়ে অফিসে চলে গেছে । বদি মামার পরাটা আর সবজির চেয়ে বাড়ীর নাস্তা কখনই ভাল না মনে করে আজও বাড়ীতে নাস্তা করলেন না ।মায়ের আচল থেকে একশ টাকার নোটটা হাতিয়েই কাধের উপর ব্যাগটা কোনরকম ঝুলিয়ে দিব্বি চম্পট ।পেছন ফিরে একবার দেখলেনও না মা দাড়িয়ে আছে ।বদি মামার চায়ের কাপে চুমক দিয়েই আবিস্কার করলেন বন্ধু শফিককে ।আব্বে দোস্ত বলে জড়িয়ে ধরে আধপোড়া সিগরাটের ভাগ নিলেন ।প্রতিদিনের মতো প্রথম ক্লাসও আজও মিস পরের ক্লাশ ১১ টায় ।হাতে বিস্তর অবসর ।ফোনে ফেসবুক খুলে বসলেন ।ফেসবুক খোলা মানেই হলো দুনিয়ার দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করা ।রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতির তাবৎ জ্ঞান অর্জন করে গেলেন ফারিয়ার প্রোফাইলে ।গতকাল রাতে প্রোফাইল পিকচার পাল্টাইতে বলছিলেন পাল্টাইছে কিনা ।নাহ !পাল্টায় নায় ।এই মেয়েটারে নিয়ে আর হয় না নিশ্চয়ই আজও ঘুমাই গেছিল ।আজকে ক্লাশে আসলে দু কথা শুনিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন ।সঞ্জীব দার গানটি হটাত মনে হওয়া বোতাম টিপে টিপে স্টাটাস দিলেন "বাক্যের শুরু অন্যকোথাও তোমাতেই দেই দাড়ি/যখন যেখানে নোঙ্গর করেছি সবাইকে আজ আড়ি ।
হটাত ডাক দিল বন্ধু কিবরিয়া আর রেজওয়ান ।রেজওয়ানের বোন তুলি আপুর গায়ে হলুদ সন্ধায় ।সব বন্ধুরা যাবে । চরম মাস্তির কথা চিন্তা করে এখনই আপ্লুত হচ্ছেন ।শয়তানের ওয়াছওয়াছা আর রেজওয়ানার চাপাচাপিতে ক্লাশ বাদ দিয়ে নিউমার্কেট আর নীলক্ষেতেই কাটিয়ে দিলেন সারা দুপুর ।৪৫ টাকার খিচুরী দিয়ে জম্পেস লাঞ্চ সারলেন ।আজ ফারিয়ার সাথে দেখা হলো না ।থাক কাল করলেই হবে ।সন্ধায় পার্টি তাই একটু আগেই বাড়ীর পথ ধরলেন ।বাসের জন্য দাড়িয়ে রইলেন নিউমার্কেটের সামনে ।হাতের সিগারটেটা তখনও জ্বলছিল হটাত কোত্থেকে একটা বাস এসে পিছন থেকে ধাক্কা দিল ।ছিটকে কয়েজ গজ দুরে গিয়ে পড়লেন ।জ্ঞান হারানোর আগে দেখলেন নাক মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝড়ছে ।জাগতিক চেতনা আপনি হারিয়ে ফেলেছেন ।পৃথিবীর ভাষায় আপনি মৃত কিন্তু আপনি বেচে আছেন কোন এক পরলেীকিক জগতে ।দেখতে পাচ্ছেন বুঝতে পারছেন কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না ।
আপনাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে প্রচুর মানুষের জমায়েত ।রক্ত দেখে সব পাগল হয়ে গেছে ।অতি উতসাহী কয়েকজন বাস ভাঙ্গতে গেল অথচ আপনাকে এখন হাসপাতালে নেয়া জরুরী ।এই সামান্য বুদ্ধিটুকো কারো মাথায় ঢুকছে না ।হটাত কোত্থেকে এক মহিলা ভীর ঠেলে সামনে আসলেন,চেচিয়ে বললেন বাচ্চাটাকে আগে হাসপাতালে নেন না ।মানুষের সম্বিত ফিরল ।ধরাধরি করে একটা রিকসায় উঠান হলো ।কেউ একজন পকেট থেকে মোবাইল বের করল ।ভাবলেন বুঝি হাপিস হয়ে যাবে ।কিন্তু না ভদ্রলোক মোবাইল ঘেটে রিসিভ আর ডায়েল লিস্ট খুজে বাবার নম্বর বের করল ।তারপর তাকে ফোন দিয়ে বলল আপনি একসিডেন্ট করেছেন ।লোকটার বুদ্ধির প্রসংসা করতে হয় ।কিছুক্ষন পর নিজেকে আবিস্কার করলেন হাসপাতালের স্ট্রেচারে ।পাশে সব পরিচিত মানুষের ভীর ।এত অল্প সময়ে এরা কিভাবে খবর পেল ।বন্ধু শাহনেওয়াজকেও দেখলেন ।বেচারা বোনের বিয়ে রেখে এখানে !কি ঝামেলায় না পড়ল ।নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হচ্ছে ।সকালের ভাগ বসানো সিগারেটের মালিক শফিকও এসেছে ।হম্বিতম্বি হয়ে ছুটছে রক্তের জন্য ।কে যেন তাকে বলেছে রক্ত লাগবে ।বাবা ছোট মামা আর বড় চাচাকে দেখলেন উদভ্রান্তের মতো সারা হাসপাতাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ।কে বলবে এই বাবাই সকালে কতই না বকাঝকা করেছে তাকে ।মাকে হয়ত খবর দেয়া হয়নি এখনও ।মাকে শেষ দেখেছেন গতকাল রাতে খাবার সময় ।সকালে আসার পথে তো ফিরে তাকান নি ।খুব আফসোস হচ্ছে এখন,একবার তাকালেই হয়ত শেষ বারের মতো আজ দেখতে পেতাম ।নাহ !সারাজীবন বাউন্ডুলেই থেকে গেলেন ।ডাক্তার অহেতুক দেহটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে ।জানেই তো মরে গেছেন তারপরও যে কেন এমন করে বুঝিনা ।মৃত্যুর পর দেহে নাকি অনুভুতি থাকে না কিন্তু আপনি তো ব্যাথা অনুভব করছেন ।এর কোন মানে হয় ।হটাত আকাশ পাতাল ফাটিয়ে চিতকার শুনলেন ।নিশ্চয়ই মা এসেছে ।এমন আল্লাহর আরস কাপান চিতকার মা ছাড়া কেউ দিতে পারে না ।ভাগ্যিস ডাক্তারটা শরীরের রক্তগুলো সব মুছে ফেলেছে ।নয়ত মা দেখে বেহুস হয়ে যেতেন ।মায়ের তো হাই প্রেসার ।তাকে একটা ঔষধ খাওয়ানো দরকার ।ঈশ কেউ মায়ের দিকে একটু খেয়াল রাখছে না,এই মহিলা তো স্ট্রোক করবে ।বাবার ডায়বেটিস মনে হয় এক সকালেই বহুগুন বেড়ে গেছে ।নাম মুখ ফোলা ফোলা লাগছে,তার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন ।সবে তো মারা গেলেন এখনও তো অনেক কাজ বাকী ।দাফন কাফন কবর খোড়া,জানাযা ।মনে প্রানে চাইছেন মাকে যেন আপনার কাছে আসতে দেয়া না হয় ।সন্তানের মরা মুখ তিনি সহ্য করতে পারবেন না ।হটাত ফারিয়াকে দেখলেন মাকে জড়িয়ে আছে ।নাহ !মেয়েটাকে যত বোকা মনে করতেন ততটা বোকা না ।বেচে থাকলে হয়ত বিয়ে করে সুখীই হতেন ।
সময় বহু পেড়িয়ে গেছে ।হাসপাতালের কার্য সমাধা করে এম্বুলেন্সে করে বাড়ী ফিরলেন ।অন্যদিন ঠিক এই সময়টাতেই বাড়ী ফিরতেন ।জ্যাম আর গরমে ভিজে যখন বাসায় ফিরতেন মা জোর করে জামা খুলে ফ্যানের নিচে বসিয়ে রাখত ঠান্ডা বসে যাবে এই ছুতোয় ।বিরক্ত হলেও না করতে পারতেন না ।অথচ আজ এসি ওয়ালা এম্বুলেন্স করে বাড়ী ফিরছেন ।আজ আর মা জোর করে ফ্যানের নিচে বসিয়ে দেবেন না ।জোর করে পাশে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দিবে না ।বাড়ীর গেটমুখে জটলা ।পুরো এলাকা যেন ভেঙ্গে পড়েছে আপনার বাড়ীতে ।এইটুকো বাড়ীতে পাড়া সুদ্ধ লোক কিভাবে আছে বুঝলেন না ।সালাম কাকা,দেলোয়ার কাকা,দোকানদার রহিম ভাই,পাশের বাড়ীর আকলিমা খালা,জুথি আপু,সেলিনা চাচী !সবাই আজ বাড়ী ভীর করে আছে ।বদি মামাকে দেখলাম মনে হয় এক পলক ।এই লোক দোকান ফেলে আমার লাশ দেখতে আসবে ভাবতে পারি নাই ।আশ্চর্য হলেন এরা সবাই এত কাদছে তার জন্য !বেচে থাকতে কোনদিন বুঝেন না যে তারা আপনাকে এত ভালবাসে ।যে ছেলেটির সাথে কিছুদিন আগে ঝগড়া হলো সেই দেখেন সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছে ।নাহ !ওর সাথে ঝগড়া করাটা উচিত হয় নাই ।বেচে থাকলে হয়ত সরি বলে নিতেন ।ভার্সিটির সমর স্যার,পলাশ স্যারও দেখি আসছেন ।পলাশ স্যারের উপর রাগ ছিলেন মাত্র দুই মার্কের জন্য রিটেক খাওয়াইছে ।আজ সেই স্যার আপনারে দেখতে আসছে ।আসলে বেচে থাকতে এদের কারো ভালোবাসাই আপনি টের পান নাই ।আজ মরে গিয়ে বুঝতে পারছেন ।তারপর একসময় মসজিদের হুজুর ডেকে আপনাকে গোসল করানো হল,কাফন পড়ান হলো নাকে মুখে তুলা দিয়ে প্যাকেট বন্দী করে কবরে রাখার জন্য প্রস্তুত করা হলো ।কান্নার আওয়াজ এখনও থামে নাই ।বাবাকে কাদতে দেখলেন না ।ওনার একটু কাদা উচিত ।নইলে তো মারা পড়বেন ।পিতার কাধে সন্তানের লাশের কথা শুনেছেন আজ নিজের ক্ষেত্রেই তা সত্যি হতে যাচ্ছে ।
সবাই মিলে আপনাকে খাটিয়ায় তুলে কাধে নিল ।জানাযা শেষে গোরস্তানের পথে লম্বা লাইন ।আপনার লাশের পেছনে এত মানুষ থাকবে আপনি ভাবতেও পারেন নাই ।তারপর বাবা কবরে নেমে আপনাকে শেষ বারের মতো বুকে টেনে নিল শুইয়ে দিল মাটির বিছানায় ।এখন আর কারো চোখে পানি নাই ।সবাই শক্ত হয়ে আছে ।আস্তে আস্তে পৃথিবীর আলো বন্ধ হতে লাগল ।একটার পর একটা বাশ বন্ধ করে দিল আপনার জন্য পৃথিবীর সর্বশেষ আলো টুকো ।এখনও শুনতে পাচ্ছেন মানুষের গলা ।আপনার জন্য মোনাযাত করা হলো ।তারপর আ্স্তে আস্তে মিলিয়ে গেল পায়ের আওয়াজ পৃথিবীর সবর্শেষ শব্দটুকো
বহুদিন আগে ব্লগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সম্রাটকে নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম এই ব্লগে ।লেখাটি তার ছায়া অবলম্বনে বলতে পারেন ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:৫৩