১৫ বছরের "টোকাই বালকটি স্থানীয় সবার কাছে মইত্তা নামে পরিচিত। যদিও কিছু এনজিও জীবিদের দারিদ্র বিমোচনের রুপকথার গল্পে সে "মোহাম্মদ মতিয়ার রহমান। কিন্তু আজন্ম অভাব আর অনটন তার জীবনের মতো নামটাকেও বিকৃত আর সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে ।তবে এতে করে তাকে কখনও দু:খিত মনে হয়নি বরং মতিউর রহমান সম্মোধনেই কিছুটা বিব্রতবোধ করে ।
পুরো কমলাপুর স্টেশন জুড়েই তার আবাস ।যখন যেখানে খুশি সিমেন্টের বস্তা বিছিয়ে মাথার নীচে ইট দিয়ে ঘুম ।মাথা ভর্তি অযত্ন অবহেলায় বেড়ে ওঠা এক গাদা চুল ।তাতে শেষ কবে তেল আর চিরুনির ছোয়া পড়েছে সেটা গবেষকদের গবেষনার বিষয় হতে পারে ।দিপ্তিময় এক জোড়া চোখ,নীল সাগর জুড়ে কেবলই মায়া ।
পরিধেয় অর্ধনগ্ন জামাটির ইতিহাস খুজতে গেলে ঐতিহাসিকের জাদুঘরে ঢু মারতে হবে ।আর প্যান্টের অবস্থা তার চেহারার মতোই মলিন ।মাংসের অভাবে হাড়ের সাথে ঝুলে থাকা প্যান্টটি মাঝে মাঝে হাতে ধরে টেনে তুলতে হয় ।বেচারা ইদানিং দড়ি দিয়ে বেধে কোন মতে বিলুপ্ত প্রায় লজ্জা আগলে রাখছে ।
যদিও ঢাকা শহরে সাধারনত এমন হাড় হাভাতে অভাবী টোকাই পাওয়া যায় না । তবু তাকে পাওয়ার একমাত্র কারন হলো আমাদের মইত্তা মিয়া তার জীবন সম্পর্কে একেবারেই উদাসিন !"টোকাই থেকে রংবাজ" হওয়ার মুল তরিকা গুলো তাকে কখনও আকৃষ্ট করেনি ।তাই রেলের তেল চুরি,রেলের পাটি খুলে নিজের মনে করে বিক্রি করা কর্মকান্ডে তাকে কখনও অন্তরর্ভুক্ত করা যায় নি ।এ নিয়ে তার বন্ধু মহল তার উপর বিরাট নাখোশ ।এমনকি যাত্রীদের ব্যাগ কেটে টুকটাক চুরি করা কিংবা বড় বড় ছিনতাইকারীদের ছোট ছোট এসিসটেন্টশীপেও যখন তার তীব্র অনিহা তখন তার বন্ধুসকল তাকে গোত্র বিতারিত করে "ভদ্রলোক" বলে ক্ষেপায় !
মইত্তা নিজের অজান্তেই তাদের বিদ্রুপে আনন্দিত বোধ করে ।তার ক্ষুদ্র হৃদয়ের কোন একটা স্থিতিশীল জায়গায় "ভদ্রলোক" হবার একটা সুপ্ত বাসনা ভর করে ।তাই হয়ত মুখ ফসকে কখনও কখনও নিজের নাম মতিয়ার রহমান বলে ফেলে ।প্রতিদিন হাজার হাজার "ভদ্রলোক" বেশী যাত্রী দেখে তারও টোকাই থেকে যাত্রী হতে ইচ্ছা করে ।
স্বপ্ন দেখে নতুন জামা কাপড় পড়ে মাথার বামপাশে সিথি করে চুল আচড়ে বাবা মায়ের পিছু পিছু ছেড়ে যাওয়া রেলগাড়ীর দিকে ছুটবে ।বাবার ব্যাস্ততার সাথে মা তাল মিলাতে পারবে না ।সে মাকে কোলে করে তুলে দৌড়াবে ।স্টেশন ভর্তি মানুষ দেখবে তাদের মইত্তা "ভদ্রলোক" হইছে ।মাকে কোলে নিয়ে গাড়ীতে চড়ছে ।
রেল গার্ডের বাশির শব্দে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায় ।পায়ের কাছে শুয়ে থাকা কুকুরটার খাবারের দিকে নজর দিয়ে নিজেরও ক্ষুধা অনুভুত হয়।যদিও ভাতের কোন নিশ্চয়তা নেই তারপরও একটা ক্ষীন আশা নিয়ে এলোমেলো পায়ে নিজের ছাপড়ার দিকে এগোতে থাকে ।তাকে দেখে বন্ধু মহলে বিদ্রুপের হর্ষধ্বনি ওঠে ।এই দ্যাখো কে আসছে ?আমাদের মইত্তা,বিশিষ্ট ভদ্রলোক ।মইত্তার অবিরাম নিরাবতা হয়ত তাদের মানবতা উদ্রেক করে ।প্লেট ধুয়ে সামনে এগিয়ে দেয় ।সামনের বাড়ীতেই এক 'ভদ্রলোকের" বিয়ের আয়োজন ।ঘটা করে গন্ধই আসে কেবল ।টোকাই গুলো দল বেধে কাচা মরিচে কামড় দেয় আর ভদ্রলোকরা মুরগীর মাংষল রানে ।মইত্তা অবাক হয় ।ভদ্রলোকরা তো তার মুখে ভাত তুলে দিল না শুধু ঘ্রান দিয়ে গেল !
তারপরও মইত্তা মতিয়ার রহমান হতে চায় ।ভদ্রলোক হতে চায়