somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারভার্ট – ১৪

২৩ শে মে, ২০১১ বিকাল ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


“আরে! বাদলদা! পার্থ ভাই! আপনারা?” রয়েল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তার, বাদলের একসময়কার রুমমেট এবং তার বেশ ঘনিষ্ঠ জুনিয়র মিনহাজ, পার্থ এবং বাদলকে দেখে কিছুটা অবাকই হয়।
“আরে মিনু, তুই!” একটা বিরাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাদল, পার্থও। হাসপাতালে এসেই চেনামুখ পেয়ে যাওয়াটা স্বস্তিদায়কই বটে।
বাদল এবং পার্থর সাথে করমর্দন শেষে বিছানায় শোয়ানো কায়সারের দিকে মনোযোগ দেয় মিনহাজ, “ঘটনা কি, বাদলদা?”
“আমার দুলাভাই। বাসায় ডাকাত পড়সিল।” বাদল কিছু বলার আগেই পার্থ উত্তর দিয়ে দেয়।
“হেড ইনজুরি কেস।” এবার বাদল যোগ করে।
“বলেন কি!” পার্থর দিকে একটা অবাক চাউনী ছুঁড়ে দিয়ে আবার কায়সারে মনোযোগ দেয় মিনহাজ। “পালস ফীবল, রেপিড। দেখি বি পি-টা ...” হাত বাড়িয়ে দেয় উপস্থিত ওয়র্ড বয় এর দিকে।
দ্রুত রোগী নিরীক্ষা শেষ করে পাশে থাকা সিস্টারকে মিনহাজ দ্রুত নির্দেশ দেয়, “এন এস লাগান থার্টি ড্রপে, অক্সিজেন চার, আর টি আনেন, আর ক্যাথেটার।”
এবার বাদলের দিকে ফিরে মিনহাজ প্রশ্ন করে, “ব্যান্ডেজ কখন লাগাইলেন?”
“আরে কইস না! নিজে নিজে কাবিলতি করি কোত্থেকে ব্যান্ডেজ বাঁধি বলে আমি ঠিক আছি, ঘরে ঢুকতেই বেহুঁশ।” জোড়াতালি লাগাচ্ছে বাদল।
“কিন্তু, এইটা তো পুলিশ কেস,” এবার মিনহাজ কথা বলে পার্থর উদ্দেশ্যে “পুলিশে খবর দিসেন?”
“আরে নাহ! পুলিশের ধারেকাছে যাইত না কেসটা” বাদল আস্বস্ত করার চেষ্টা করে মিনহাজকে।
“বাদলদা, আপনি তো জানেন, প্যাঁচটা কোথায়!” কিছুটা অনুযোগ প্রকাশ পায় মিনহাজের কথায়।
“আরে ব্যাটা, উকিল নিয়া আসছি সঙ্গে, তুই পুলিশের টেনশন করিসনা। আগে উনারে ঢুকা, তারপর নাহয় পার্থ গিয়া ওই সাইড দেখবে।”
একটু চুপ থেকে মিনহাজ বলে, “আসেন, ভিতরে আসেন।”

মিনহাজ জরুরী বিভাগের রুমটা থেকে বেরুলে পার্থ-বাদল পরষ্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
“আসলেই, তাড়াহুড়ায়, ব্যাপারটা ভাবাই হয় নাই!” পার্থ খানিকটা আফসোস করে।
“কিন্তু কিছুই তো করার নাই। ফুলটাইম তো দৌড়ের উপ্রে গেল, কোথাও কাউরে খবর দেবার তো চান্সই পাইলাম না।” বাদল কাঁধ ঝাঁকায়।
চিবুকে চিন্তান্বিত চুলকানি চালাতে চালাতে পার্থ বলে, “অন্যার শ্বশুরবাড়ির কারও নম্বর তো আমার কাছে নাই, তোর আছে?”
“কোত্থিকা?”
“তাইলে খবর দিই ক্যাম্নে?”
“অন্যারে কইলে হয় না?”
“তোর মাথা খারাপ? এই অবস্থায় অন্যা ফোন দিব?”
“ওর কাছ থিকা মোবাইল নিয়া নম্বর দেইখা সুমী ফোন দিতারে।”
“হুঁম! তাইলে সেইটাই কর। সুমীরে ফোন লাগা।”

বাদল ফোন করে মৌসুমীকে, ঠিক সেসময় পার্থরও ফোন আসে – তার মা। এই নিয়ে তৃতীয়বার। ফিরতে দেরী দেখে তিনিও উৎকন্ঠিত। পার্থ আর দুশ্চিন্তা না বাড়ানোর জন্য বলে, “না, আর কোন টেনশন নাই। অনন্যার হাসবেন্ডের হঠাৎ প্রেশার বাইড়া গেসল, এখন রয়ালে নিয়া আসছি। বাদলও আছে। ডিউটি ডাক্তারও বাদলের চেনা ... না, আর কোন প্রবলেম নাই ... ... হ্যাঁ হ্যাঁ, চইলা আসতেসি, তুমি টেনশন কইরো না, ঘুমাও তো!”


‘এখন কায়সার ভাইয়ের কি অবস্থা কে জানে! যদি খারাপ কিছু হয়? গড ফরবিড, যদি সার্ভাইভ না করে? অথবা, সার্ভাইভ করলেও, হেড ইনজুরি কেস, যদি লাইফ লং প্যারালাইসিস ডেভেলপ করে? সুনার অর লেটার, ওর ফ্যামিলি মেম্বার তো জানবেই, কি ঘাপলাটা লাগবে তখন?অন্যাটা কি জানে, কি ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে পড়সে সে নিজে? তার সাথে সাথে আমরাও?’ প্রবল বাতাসের ঝাপ্টায় চিন্তামগ্ন মৌসুমী তাকায় অনন্যার দিকে। হাতের তালুতে মুখ চেপে বসে আছে মেয়েটা। কে জানে ওর ভেতর কি ঝড় বইছে! ‘প্রথমেই তো বলবে, আমরাই মেরে ফেলসি, বা ক্ষতি যা করার, আমরাই করসি। এমনকি কায়সার ভাই যদি পুরোপুরি সুস্থও হয়ে যায়, তারপরও কি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে? মনে হয় না। সংসারটা বুঝি আর জোড়াই লাগবে না। এরপর শুরু কুৎসা রটনা। উফ্‌! দুনিয়াটা কেন যে এত্তো ঘোড়েল!’

অনন্যার মোবাইল থেকে “আফসার” নামটা খুঁজে পেয়ে মৌসুমী প্রশ্ন করে, “তোর দেবরের নাম আফসার না?”
“হুঁ, কেন?” ভ্রু কুঁচকে মাথা তোলে অনন্যা।
উত্তর না দিয়ে মৌসুমী ফোন করে।
অনন্যার মুখ ফ্যাকাশে হতে থাকে।
“কি করস?” অনন্যার কুন্ঠিত প্রশ্ন।
উত্তরে শাসনের কড়া চাউনী ফিরিয়ে দিয়ে মৌসুমী ওপ্রান্তের আওয়াজের অপেক্ষা করে।
“তুই কি আফসারকে ফোন করতসস?” অনন্যার কন্ঠে শংকা ঝড়ে পড়ে। “কেন?” বাধা দেবার ক্ষীণ চেষ্টা কাজ করে অনন্যার মধ্যে।
“গ্যাঞ্জাম তো বাধাইসস, এইবার সামলাইতে দে!” ঝাঁজ ঝরে পড়ে মৌসুমীর কথায়।
প্রথমবার রিং পড়ে লাইন কেটে গেছে। মৌসুমী ফের ফোন করে।

নিজের ভেতর এতক্ষণ পিষ্টই হচ্ছিল অনন্যা। কথার আঘাতে আরও বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অপরাধবোধের আঁচড় হয়ে ওঠে হিংস্রতর, সাথে যোগ হয় অদ্ভুত এক নৈঃসঙ্গবোধ। ‘সব গ্যাঞ্জাম আমিই বাধাইসি, সব দোষ তো শুধুই আমার’ এই অভিমানী অনুভবে বুকটা ভীষণ ভারী মনে হতে থাকে অনন্যার। সি এন জি থেকে লাফিয়ে ঝাঁপ দেয়ার বাসনাটা তীব্রতর হতে থাকে।


“আজকের রাতটা কঠিন ভেজাইল্যা গেসে বাদলদা!” ফাইলে অর্ডার লিখতে লিখতে বলে মিনহাজ। “একটা এম আই, একটা ডি কে এ, দুইটা ব্রঙ্কিওলাইটিস, দুইটা ডায়রিয়া উইথ শক, তিনটা ডেলিভারী কেস, আর শেষ মুহুর্তে দুইটা ইনজুরি কেস।”
“দুইটা কই পাইলি?” বাদলের প্রশ্ন।
“আপনাদের ঠিক আগেই একটা আসছে, ওই সাইডের রুমে আছে। ব্যাটার্ড কেস। ঐটার অর্ডার লেখার সময়ই আপনারা আসলেন।”
“অ! কি, পলিটিকাল মারামারি?”
“নাহ! হাসবেন্ড বউ পিটাইসে, এইখানে এসে বলে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেসে। ফাউল পাবলিক শালা!”

পার্থ-বাদল দৃষ্টি বিনিময় করে। হলোটা কি আজ রাতে?

“কস কি? এইটা তো নারী নির্যাতন কেস হইতারে, পুলিশে খবর দিসস?” বাদল ছোটভাইয়ের জন্য একটু উদ্বিগ্ন।
“এখনও দিই নাই।” মিনহাজও চিন্তিত।
“মহিলা বাঁইচা আসে?”
“হ্যাঁ, সেন্স আছে। তবে মারাত্মক উন্ডেড। উনার সাথে এই বিষয়ে তো কথা বলি নাই! আর মহিলার স্বামীর সামনে এইসব কথা ক্যাম্নে কই?”
“কিন্তু মহিলা যদি পরে মামলা করে? তখন ইনজুরি সার্টিফিকেট দেয়া, কোর্টে সাক্ষী দিতেও যাইতে হইতে পারে – চিন্তা করসস?”
“না, পুলিশ কেস হইলে তো রাখতামই না – এখন হাসবেন্ড মিথ্যা বললে ... , ধূর, ভ্যাজাল যত্তোসব!”

“ওনাকে কি আই সি ইউ-তে দিতে হবে?” পার্থর এসব আলোচনে ভাল লাগছিল না, তাই প্রসঙ্গ পাল্টায়।
“মনে হয়, নাহ!” পার্থকে উত্তর দেয় মিনহাজ। “অন্তত এখন পর্যন্ত জরুরী মনে হচ্ছেনা।” এবার বাদলের দিকে ফিরে বলে, “জি সি এস দশ এগারমত আছে, ব্রীদিং-সার্কুলেশনও এক্সেপ্টেবল, তবে আপনি ইনসিস্ট করলে ... ...”
বাদল মাথা চুলকে বলে, “নাহ! আপাতত থাক। পারলে কামাল স্যারকে দেখাইস। উনি যা বলেন।”
“উনি তো এখানে আসবেন না!”
“কেন?”
“উনি তো ড্যাবের, স্বাচিপের হসপিটালের কলে আসেন না!”
“আজিব! এইখানেও পলিটিক্স?” হতাশা চাপতে পারেনা বাদল।
“নাজির স্যারকে দেখানো যায়, দেখাব?”
“দেখা! উনিই তো অটোমেটিক সেকেন্ড চয়েস।”
“ঠিক আছে।” বলে মিনহাজ আবার লেখায় মনোযোগ দেয়।

সামনেই টেবিলে আরেকটা ফাইল পড়ে আছে। বোধহয় ঐ আগের ইনজুরি কেসটারই।

পার্থ অলস আঙুল মটকাচ্ছে। বাদল ফাইলটা টেনে নেয়, “এইটা ওই ব্যাটার্ড কেসটা না?”
মিনহাজ একটু মাথা তুলে ফাইলটা দেখেই “হুঁ” বলে মাথা নামিয়ে নেয়। লিখতে লিখতে বলে, “শালার ব্যাটা আবার ব্যাঙ্কার। কি মাইর যে দিসে বউটারে!”

ফাইলের পাতা ওল্টায় বাদল।


এই পাতায় Patient profile.


বাদলের চোখ কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে প্রায়। ওখানে লেখা,


Patient name: Sumaiya Nasreen.
Father/ Husband’s name: Md. Mahfujur Rahman.


পার্থর কান থেকে মাথা জুড়ে বোমা ফাটে যেন, যখন বিস্ময়ে বিমূঢ় বাদল অস্ফুট উচ্চারণ করে, “নীপু!”





(আগের পর্বগুলো )




[চলবে]
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×