somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রিকশার চাকা ও জীবনের চাক

১৫ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আকাশের ঠিক মাঝামাঝি স্থান থেকে প্রখর রোদ্দুর ছড়াচ্ছিল সূর্যটা। টাটকা ঝাঁঝালো রোদ। সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে যাত্রীর আশায় একঠাঁই দাঁড়িয়ে সালাম। তার কচি কোমল হাত দুটো রিকশার হাতলে। চোখেমুখে রাজ্যের উৎকন্ঠা। দেড়শ টাকা হবে তো দুপুরের মধ্যে! নইলে মায়ের চিকিৎসার ওষুধ যে জুটবে না! সকালে দু মুঠো পানতা খেয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিল ১১ বছরের সালাম।

একটু পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী এসে চেপে বসল সালামের রিকশায়। সালাম রিকশার প্যাডেলে পা রেখে টানতে লাগল ওদের। ছোট্ট তুলতুলে সালামের মত দশ বছরের সালমান, কামাল, নয় বছরের আলাল, লালন, বারো বছরের তাজুসহ এমন আরো প্রায় পঁচিশ জন শিশু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাদিন রিকশার চাকা ঘুরিয়ে সচল রাখে তাদের জীবনের চাকা। রিকশার চাকা না ঘুরালে ভাত জুটে না ওদের কারোরই।

আট বছরের রফিক খুব চেষ্টা করেছিল রিকশা চালাতে। পারেনি। তার পা কোনওমতেই রিকশার প্যাডেলের নাগাল পায় না। শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রহলের ক্যান্টিনে মাসিক তিন শ টাকা হারে চেয়ার-টেবিল মোছার কাজ নেয় রফিক। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখা যায় রফিকের সঙ্গে কাজ করছে তার সমবয়সী শোয়েব, পিয়ার, খালেদসহ আরো এগারোজন শিশু।

সালাম-রফিকরা সবাই মিলে প্রায় একশজন। ওরা সবাই সুবিধাবঞ্চিত শিশু। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ ওরা রিকশা চালায়, কেউ ক্যান্টিনে কাজ করে, কেউ চায়ের টংয়ে চা বানায়, কেউবা পান-সিগারেট বিক্রি করে। একেকজন এসেছে একেক জায়গা থেকে। কারো বাবা নেই, কারো বাবা আছে তো মা নেই। কারো দুজনের কেউই নেই। অভাব-অনটন জীবনের নিত্য ছবি। কাজ করলে ভাত জুটে নতুবা উপোস কাটাতে হয়। অনেকে একাই পুরো সংসার চালায়, অনেকে সংসারে টুকটাক সহযোগিতা করে। আর এভাবেই প্রতিদিন তাদের জীবনে নতুন দিনের সূর্য ওঠে। সকাল হয়। সন্ধ্যা গড়ায়। রাত নামে। মধুর কোনও স্বপ্ন তাদের জীবনকে আচ্ছন্ন করে না। জীবন মানে তাদের কাছে মাস শেষে তিন শ টাকা বেতন, রিকশাযাত্রীর ভাড়া, ক্যান্টিনে খেতে আসা শিকক্ষ-শিক্ষার্থীদের দু-চার টাকার বখশিস।

শিশুগুলোর নিষ্পাপ চেহারায় স্বর্গীয় দ্যুতি। সারা দিনের অকান্ত পরিশ্রমে ভারী হয়ে ওঠে তাদের নিঃশ্বাস। দেখলে মনে হয় মায়ের দুধের গন্ধ যেন এখনো লেগে আছে ওদের ঠোঁটে-মুখে। ক্যান্টিনের কাজে একটু উনিশ-বিশ হলেই নরম মুখে পড়ে সজোরে থাপ্পড়। চলে শারীরিক নির্যাতন।

‘কিতা করি আর? পেটে তো খানিওনি কিছু দিতে হয়। ঘরে খানি নাই। ক্যান্টিনে কাজ কাম কইরা খানিও পাই, ট্যাহাও পাই। কষ্ট কইরা তাই কাজ কররাম।’ ক্যান্টিনের চেয়ার টেবিল মুছতে মুছতে কথাগুলো বলল রফিক। মোছামুছির কাজ শেষ হলে এক ফাঁকে গিয়ে সে দাঁড়ায় টিভির সামনে। হলের কিছু শিক্ষার্থী তখন খেলা দেখছিল টিভিতে। তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টিভি দেখে রফিক। হঠাৎ ডাক পড়ে ক্যান্টিন ম্যানেজারের। রফিক বুঝতে পারে এটি তার শখ মেটানোর সময় নয়। তড়িঘড়ি করে দৌড় দেয় কাজে।

শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির ভেতর এদের জীবন কাটে। কাজের ফাঁকে একটু উঁকিঝুকি দিয়ে দেখে সুন্দর জামাকাপড় পড়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পড়াশোনা নিয়ে বিভোর তারা। অথচ এসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই তাদের জীবন কেটে যাচ্ছে শিক্ষাহীন, ভবিষ্যৎহীন।

মনের আড়ে তাদের সুপ্ত বাসনা। যদি একটু অন্তরঙ্গ হওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ভাইয়া বা আপুর সঙ্গে! কেউই এরা দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর বেশি পড়তে পারেনি। তবু এদের বুকে নাড়া দেয় স্কুলে পড়ার প্রবল ইচ্ছা। অগোচরে তাদের ভেতর তাড়া করে ফেরে বড় হওয়ার ব্যাকুলতা।

‘স্কুলে পড়তে হইলে তো টাকা দরকার। টাকার অভাবে যেখানে সংসারই চলে না, সেখানে স্কুলের খরচ চালাব কীভাবে? ইচ্ছে থাকলেও তাই স্কুলে যেতে পারি না। এখন বাধ্য হয়ে রিকশা চালাই।‘ রিকশা চালাতে চালাতে বলল সালাম।

ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে আসা সালাম তার মা, দুই ভাই, এক বোন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ধামালিপাড়ার ছোট্ট একটি ভাড়া ঘরে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সারাদিন রিকশা টেনে পায় একশ থেকে একশ বিশ টাকার মতো। এর মধ্য থেকে ত্রিশ টাকা দিয়ে দিতে হয় রিকশা মালিককে। বাকি টাকা নিয়ে ধুলোমলিন চেহারায় ঘরে ফেরে সালাম।

‘সন্ধ্যার পরে যদি আশপাশের কোনও স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা থাকত তাহলে কাজ করার পর পড়তে পারতাম। কিন্তু সে ব্যবস্থা না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও আর পড়তে পারছি না।’ বলল বারো বছরের রিকশাচালক রাব্বি ও তাজুল।

ক্যান্টিনের পঞ্চাশোর্ধ বাবুর্চি সুজন বলেন, এই কচি বয়সে তাদের বাপ-মারা সংসারের অভাবে এখানে কাজ করতে দিয়ে দেয়। কত কষ্ট করে যে এদের এখানে কাজ করতে হয়, ভাবলে খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই তো করা যায় না। কাজ না করলে ঠিকমতো এদের ভাত জোটে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তুলসী কুমার দাশ বলেন, এই বাচ্চাগুলোর অমানবিক শ্রম কখনো সমর্থনযোগ্য নয়। সরকারের উচিত এদের পরিবারের আয়বর্ধনমূলক কোনও ব্যবস্থা করা বা এই বাচ্চাগুলোকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভেতরে এনে উপার্জনম কোনও প্রশিক্ষণ দেওয়া।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কথা: দাদার কাছে—একজন বাবার কিছু প্রশ্ন

লিখেছেন সুম১৪৩২, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৫



দাদা,
কেমন আছেন? আশা করি খুবই ভালো আছেন। দিন দিন আপনার ভাই–ব্রাদারের সংখ্যা বাড়ছে—ভালো তো থাকারই কথা।
আমি একজন খুবই সাধারণ নাগরিক। ছোটখাটো একটা চাকরি করি, আর নিজের ছেলে–মেয়ে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×