# কিরে এই অন্ধকার বারান্দার কোনায় করছিস টা কি ? খাবি না ?
--- তেমন কিছু না। এই বেলি ফুল গাছটা প্রায় মরে যাচ্ছে রে ,
কেয়ার নেয়া হয় না বুঝি আজকাল ?
# এখন থেকে তুই এর কেয়ার নিবি । পারবি না নিতে ??
--- কি বলবো বুঝতে পারছি নারে । আমার স্বপ্ন কে আমার কাছে দিয়ে যাচ্ছেন দাদী । কিন্তু এর উত্তরাধিকারী তো আমি নই ।
# দাদী উনার ভালোবাসা তোর কাছে সঁপেছেন । কতখানি ভরসায় তা উপলব্ধি করতে পারছি আজ ।
--- কিছু একটা গলার কাছে এসে যেন দলা পাকিয়ে উঠলো। তাই আর আবীর কে কিছু বলা হল না । ভালোবাসা আর স্বপ্নের এক অদ্ভুত বন্ধনের অমীমাংসিত গল্প বয়ান করা হল না ।
আবীরের সাথে পরিচয় হয়েছিল ইউনিভার্সিটি কোচিং করতে গিয়ে । খুবই বিরক্তিকর রকমের কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিত । তারপরও ভালো লাগতো কারন ওর সব কর্মকাণ্ড ছিল বিনদনে ভরপুর । আমরা হেসে কুটি কুটি হতাম । আর এই কারনেই হয়তো ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে ভীষণ পরিচিতি ছিল আবীরের । সেই আবীর একদিন হটাত ফোন করে জানালো যে ওর বড় ভাই কক্সবাজারে সমুদ্রের জোয়ারে ডুবে মারা গেছে । কিভাবে এমন সংবাদের সান্ত্বনা দিতে হয় আমরা বন্ধুরা তা জানি না । তাই ওর বাসায় গিয়ে ওর পাশে থাকার সিধান্ত নিলাম । আর এই প্রথম আমার এই স্বপ্নের বাড়িতে পদার্পণ । সেদিন এই বাড়িটা একটি সদ্য মৃত বাড়ির আদলে আবৃত ছিল । ফার্মগেটের মনিপুরি পাড়ায় যে বাড়িটার সামনে আমাদের গাড়ি থামল সেই বাড়ির মূল ফটক বাগান বিলাসে আবৃত । গেটের সামনে দাড়িয়ে উপরের দিকে তাকাতেই আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বাগান বিলাসের উপরের বিশাল কৃষ্ণচূড়া ফুলে ফুলে ছড়িয়ে থাকা গাছের উঁকিঝুঁকি দেখে । চোখে মুখে মুগ্ধতার অভিব্যাক্তি নিয়ে ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখলাম ফটকের ডান দিক জুড়ে সূক্ষ্ম কোনের ন্যায় সবুজে ঘেরা একটি বাগান । বাগানের সামনের সারিতে ঐ কৃষ্ণচূড়া, বকুল গাছ, শিউলি ফুল গাছ, শুভ্র সদা কাঠগোলাপের পাশেই টকটকে লাল জবা ফুলের গাছ আর একেবারেই কর্নারে সোনালু ফুল গাছ দিয়ে সাজানো। বাগানের বাকী অংশটুকু আরও ফুলের গাছে ছেয়ে রয়েছে। সূক্ষ্ম কোনের বাকী অংশটুকু লাল লাল পাথরে মোড়ানো কোন গালিচায় যেন পরিবেষ্টিত । সেই পথটুকুর অপর প্রান্তে বিশাল গ্যারেজে লাল, নীল আর কালো রঙয়ের গাড়ি অবস্থান করছে দাম্ভিকতা নিয়ে। আর সেখানেই বাড়ির ডানদিকের সীমানা শেষ । আর বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আমার স্বপ্নের সেই সাড়ে তিনতলা অথবা ত্রিকোণ বারান্দার তিনতলা বাড়িটি । যার প্রবেশ পথ শুরুই হয় বিশাল ত্রিকোন ভিত্তিক বারান্দার সমাহারে, যার সামনের পিলারে বিশাল আকারের বেলি ফুলের গাছের সমারোহ যার বিস্তৃতি তিনতলা পর্যন্ত। আর বাকী পিলার মানি প্ল্যান্টের বড় বড় লতাপাতায় আবিষ্ট হয়ে এক অদ্ভুত হলদেটে সবুজে পরিণত হয়েছে । সেই অপূর্ব বারান্দা অতিক্রম করে আমি মুগ্ধ চিত্তে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই সামনে বিশাল এক ডাইনিং রুম ছিল যেখানে আবীরের বড় ভাই কে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো । বস্তুত সাদা কাপড়ে মোড়ানো মানুষটাকে দেখেই আমার মুগ্ধতা বিষাদে পরিণত হয়েছিলো এবং আমি শূন্য দৃষ্টিতে আবীর কে খুঁজছিলাম । কিন্তু আবীর আমার পাশেই দাড়িয়ে ছিল তা আমি তখনও উপলব্ধি করি নি । মুগ্ধ বাড়ির বিষাদ আমার মুগ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল যখন আবীরের বড় ভাই কে কবর দেয়ার জন্য কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হল তখন। আমাদের সকল মেয়েরা আমরা তিনতলায় বারান্দায় বসেছিলাম । প্রতিটা ফ্লোরেই ত্রিকোণ বারান্দা বাড়ির সামনের ভাগের পূর্ব দিকে । বারান্দার পাশের পশ্চিম দিকে বাড়ির বাকী কামরা অবস্থিত । ঐ সকল কামরার আরও কিছুটা পশ্চিম পাশ জুড়ে আরেকটা সরু বাগান রয়েছে যেখানে কানাডা থেকে আনা অর্কিড থেকে শুরু করে বান্দরবনের চিকণ বাঁশ গাছ রয়েছে, লিচু গাছ, ক্রিসমাস ট্রি, কাঁঠাল গাছ, আম গাছ, কলা গাছ, আরও কিছু নাম না জানা দেশি- বিদেশি গাছের সমারোহ । পুরো বাড়িটা নীলচে-সাদা মোজাইকে আবৃত । প্রতিটা সম্ভ সৌখিনতা আর আভিজাত্যের প্রতীক যেন । সেইদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনতলার এই বারান্দায় আমি আর আবীরের দাদী বসেছিলাম । দুপুরের রৌদ্র প্রখরতা, বিকেলের মৃদু বৃষ্টির ঝলকানি শেষে শেষ বিকেলের ফিকে হয়ে আসা তেজ, সূর্যের ঘরে ফেরা আর বিষণ্ণ সন্ধ্যা আমরা দুই প্রজন্ম একসাথে উপলব্ধি করেছি । দুটি মানুষই আমরা ব্যাথিত ছিলাম সেদিন । প্রিয় মানুষ হারানোর শোক আর স্বপ্নের আকস্মিক বাস্তব রূপের যাতনা । মনের অগোচরে সেদিন আমরা একে অপরের মনের যাতনা প্রকাশ করেছিলাম কিছুটা নীরবে , কিছুটা অশ্রু ধারায় আর অনেকটা নির্ভরতায় ।
আবীর কে সেদিন কিছুই বলা না হলেও এরপর তেমন একটা আসা হয় নি এ বাড়ীতে । গুলশানে নতুন ফ্ল্যাট কিনে আবীরদের পরিবার চলে গেলে দুই পুরুষের গড়া এই বাড়িটিতে শুধু দাদা-দাদি রয়ে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। পড়ালেখার গণ্ডি পার হয়ে যখন আমরা নিজেদের জীবনে খুব ব্যাস্ত হয়ে গেলেও আমার স্বপ্নের বাড়ির বারন্দা কে আমি কখনো ভুলে যেতে পারি নি । প্রফেশনাল লাইফে আবীরের সাথেও তেমন একটা যোগাযোগ না থাকলেও কিছুদিন আগে আবীরই আমাকে ফোন করে জানালো দাদীর অন্তিম শয্যায় আমার সাথে দেখা করতে চান । বিস্ময়ে হতবাক আমি হৃদয়ের কোথায় যেন ভীষণ একটা হোঁচট খেলাম শুনে । কিছু মুহূর্তের অংশীদার এই আমাকে দাদী আজ জীবনের সায়াহ্নে এসেও মনে রেখেছেন জেনে । অনতিবিলম্বে তাই চলে এলাম দাদির সাথে দেখা করতে । দাদী কে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে এই বাড়ির তিন তলার বারান্দার পাশে উনার নিজের রুমে । উনি এই বাড়ীতেই উনার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান বলেই কোন হাসপাতালে যেতে রাজি হন নি । আমার সাথে কোন কথা বলতে পারেন নি । শুধু উনার হাত যখন স্পর্শ করেছিলাম উনি হয়তো একটু কেঁপে উঠেছিলেন । কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরেছিল বুঝি উনার বন্ধ চোখে । কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম জানি না । একটা সময় পরে আবীর নীল খামে মোড়া দাদির অনুভূতিপত্রের উত্তরাধিকার করে দিলো আমাকে । দাদির সারাজীবনের স্মৃতি, ভালোবাসা আর ভরসায় মোজাইক করা এই বাড়িটির উত্তরাধিকারী করে আমাকে ঋণী করে গেলেন ।