রাসেল শুক্রবারের ছুটি ছুটি রোদ মাখানো সকালবেলায় ডান হাতে টুথব্রাশ দিয়ে দাঁতের মাঝে ক্লোজ আপের ঝড় তুলছিল আর বাম হাতে লুঙ্গির উপর দিয়ে শিশ্ন ও তৎসংলগ্ন এলাকাসমূহ চুলকাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় তার চোখ চলে যায় জানালার বাহিরে, রাস্তার ঠিক উল্টোপাশে ছায়ানীড় এপার্টমেন্টের নিচে ভীড়ের মাঝে। বাহ, জটলা !!! রাসেলের অতীত অভিজ্ঞতা বলে - জটলা থাকা মানেই বিনোদন। বিশালাকৃতি চোর ধৃত, কিংবা টিনের গামলায় জোঁকের নৃত্য, রাসে্ল এক তুমুল তাগাদা অনুভব করে। কোনরকমে ভদ্র একটা লেবাশ চাপিয়ে চলে যায় মানুষের ঝোপে। কিন্তু না, সেই মাপের কোন বিনোদনের বস্তু রাসেল দেখতে পায় না। এরে ওর কাছ থেকে শুনে যা জানতে পারে তার সারমর্ম এই - জনপ্রিয় টেলিভিশন অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী আজহার হোসেন তার নিজ কক্ষে আজকে রাতে মারা গেছেন। ভাগ্যের পরিহাস যে, সেইসময় তার স্ত্রী-কন্যা কেউই ছিলনা বাসায়, তারা খালাতো বোনের বিয়ে পেটপুরে খেয়ে তাদের শরীরকে ছায়ানীড় এর ছায়ায় আনতে অনীহা প্রকাশ করায় আজহার সাহেব একাই চলে এসেছিলেন এবং রাতের কোন এক ভাগে সফলভাবে মারা গেছেন। সকালে কাজের বুয়া এসে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে সাড়াশব্দ না পেয়ে প্রতিবেশীদের ঘুম হারাম করে এবং তাদেরই সহযোগিতায় লাশ আবিষ্কার করে।
সবকিছু মোটামুটিভাবে বোঝার পর রাসেল ঠোঁটের ডান পাশে একটা খলনায়ক রাজীব হাসি সঁপে দিয়ে বাম পাশে একটা নেভি সিগারেট ঝুলিয়ে দেয়। ভরসা ম্যাচের বারুদের গন্ধ নাকে আসার সাথে সাথে রাসেল টের পায় তার বেশ ভাললাগছে। যদিও রাসেল আজহার সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছে প্রায় আট মাস, এবং পরবর্তীকালে তিনি নিজেই একটা ভাল চাকরীতে রাসেলকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু আজহার সাহেবের নাম শোনার পরক্ষণেই তার মাথায় বেশ অনেকদিন যাবত প্রথম যেই ব্যাপারটা আসত আগে, সেই চল্লিশ হাজার টাকার কথা আর মনে পরবে না ভেবেই এই ভাললাগার জন্ম। রাসেল অবশ্য খুব ভালমতই জানতো যে, আজহার সাহেব টাকাটা ফেরত চাবেন না। কিন্তু এককালীন বেতনদাতা এবং পরবর্তীতে নতুন বেতনের উৎসদাতার টাকাটা মেরে দেয়াটাতে কৃতঘ্নতার নগ্নতাটুকু রাসেলের চোখে পরেছিল বলেই সেই চল্লিশ হাজার টাকা ফেরত না দিয়ে সমুদ্রজনতার ঢলে নিজেকে মিশিয়ে হারিয়ে যাবে যাবে ভেবেও যায় নাই এবং তিলে তিলে প্রায় আঠারো বিশ হাজার টাকা জমানো হয়ে গিয়েছিল। সেই টাকাটা খুব অবলীলায় ঈদের বোনাস হিসেবে ধরা ফেলে রাসেল। তো ছুটির দিনটার শুরুতেই বেশ অনেক টাকা রোজগার হয়ে গেল এই প্রফুল্লতা নিয়ে বাসায় ফেরার পথে আজহার সাহেবের স্মৃতিদল আচমকা আক্রমণ করে রাসেলকে। শেষ দেখা হয়েছিল চার পাঁচ দিন আগে। কোরবানীর ঈদের গরু কেনা সংক্রান্ত বৈষয়িক কিছু কথোপকথনসময়ে আজহার সাহেব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তার আর্থিক অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। সেই স্থবির সময়ে রাসেল ঠাওর করে উঠতে পারে নাই যে, আজহার সাহেব খুব সূক্ষ্ণভাবে তার কাছ থেকে ধারের টাকা ফেরত চাইছেন কিনা। আরও কিছুক্ষণ পর আজহার সাহেব রাসেলের হাতে কিছু হতবিহবল বিস্কুট গুঁজে দিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছিলেন। বরাবরের কৌতুহল; রাসেল জিজ্ঞেস করে - কিছু বলছেন স্যার ?
- না, মানে একটা কবিতা কিছুটা ঝালাই করে নিচ্ছিলাম আর কি।
- একটু জোরে করুন না স্যার। আমিও শুনি একটু।
বেশ খানিকক্ষণ কিছু চিন্তা করে, আরো কিছু দ্বিধা দ্বন্দে ভুগে আজহার সাহেব ভরাট গলায় আবৃত্তি করেন
- "আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে........."
মন্তব্য জানাতে দেরী করে না রাসেল - বাহ, বেশ লাগলো স্যার। এক্কেরে বাস্তব কথা। সেইদিন আমিনবাজারে একটা লোককে দুইজন ডাকাত খুন করসে স্যার। ঐ লোকের কাছে কত টাকা ছিল জানেন ? মাত্র আট হাজার টাকা। সেই টাকা পাওনের লাইগা ডাকাতগুলান খুনই কইরা ফালাইলো লোকটারে। কত্ত ছোট্ট ব্যাপারস্যাপার নিয়া কারবার, ভাইবা দেখসেন ?
রাসেল ভুল কিছু বলেছিল কিনা বোঝে নাই, আজহার সাহেব বিরক্ত হয়েছিলেন কিনা সেটাও বোঝে নাই। শুধু মনে আছে, আজহার সাহেব বলেছিলেন - তুমি এখন যাও রাসেল। গরুর ব্যাপারটা দেইখো একটু।
এরপর কাহিনীসমূহ বেশ দ্রুত ঘটতে থাকে। মিলন এর দোকানে চা খাইতে গিয়ে দেখে সবাই আজহার হোসেন কে নিয়ে আলোচনা করছে, এবং রাসেল আসার সাথে সাথে পরিচিত কেউ একজন অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে কর্কট কন্ঠে বলে ওঠে - আপ্নেরা থামেন। এইযে রাসেল চইলা আইসে। যা কওনের হেই কউক। আজহার হোসেন এর লগে হের ম্যালা দিনের খাতির।
হঠাৎ পায়ের নিচে এক অদৃশ্য মঞ্চ আবির্ভূত হলে রাসেল কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পরে। সার্বিক পরিস্থিতি অনুক্ষণ এর মাঝে বিচার করে কথার তুবড়ি ছোটায় - আরে, স্যারে আছিলো পাক্কা ভালামানুষ। লোকটা আর নাই ভাইবা কষ্ট লাগতাসে খুব। .........হের বাসায় গেলে নিজে আমারে চা বিস্কুট খাওয়াইতো। উনি নিজেতো খাওয়াদাওয়া করতেন কম। শরীরের দিকে তাকাইতেনই না।
- শুনসি, সিগ্রেট খাইতো নাকি খুব ?
- হ, খাইতো মানে ? এক্কেরে ধুন্ধুমার খাইতো। সকাল বিকাল রাইত, কোন কথা নাই, ঠোঁটে একটা থাকতই। আমি কত কইতাম, "স্যার, সিগ্রেট কম খান। ক্যন্সার ফ্যান্সার হইয়া গেলে মুসিবতে পরবেন।" "হ ঠিকই কইসো" এই কইয়া দুই চাইরদিন একটু কমাইতো, তারপর যাহা লাউ তাহাই কদু। তয় লোকটা আমারে ভালা জানতো খুব, নিজে ধইরা আমারে চাকরিখান পাওয়ায় দিসে।
আজহার হোসেন এর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিপুল আগ্রহ থাকা শহুরে চা-খোরেরা মিলনের চায়ের দোকানে ভীড় বাড়ায়। রাসেল একের পর এক কাহিনী শুনিয়ে তাদের বিমোহিত করে, তাদের জিজ্ঞাসা এবং আজহার পিপাসা নিবারণ করে। এইভাবে তারা একে একে আজহার হোসেন এর বৌ এর পছন্দের ব্রা এর রঙ জানে, আজহার হোসেন এর কিশোরী মেয়ের সদ্যস্ফীত পাছার দুলুনীর সৌন্দর্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করে, চায়ের দোকানের কাস্টমারদের বেশ ভাল ছুটির দিন কেটে যায়।
পরের দিনগুলিতে আবার ঘুরেফিরে পাওয়া যায় কথক রাসেলকে, কিংবা রাসেল নিজেই ঘুরেফিরে সব রাসেলকে কথক রাসেল বানিয়ে ফেলে। শুধু স্থান, কাল এবং প্রশ্নকর্তা পাত্র ভিন্ন। রাসেল ঈদের ঠিক আগে আগেই আরেকটা ঈদ পেয়ে যায় যখন অফিসের ম্যানেজার সাহেব তার সাথে বসে বিকালের চা-নাস্তা খান। এই কথানদী, সেই কথানদী গিয়ে আজহার সমুদ্রে গিয়ে পৌছায় - শুনলাম, নায়িকা সুকন্যাএর লগে নাকি আজহার হোসেন এর একটু ইয়ে ছিল?
- হ, স্যার, ঠিকই হুনসেন। আমি তো যখন গাড়ি চালাইতাম, তহনই কত্তবার রাতের বেলা সুকন্যা রে আনসি হের বাড়িতে। তাছাড়া, স্যারের বৌ তো চাকরী করেন। এইলাইগা, দিনের বেলাতেও সুকন্যা আইতো বাড়িতে। আমার তো আবার মনে করেন, ঐ বাড়িতে ঢুকতে কুনো পারমিশন লাগত না যদ্দিন স্যার বাঁইচা আসিলো। এক্কেরে নিজের বাড়ির লাহান আইতাম আর যাইতাম, যা খুশি খাইতাম। সেই সময়ে দেখতাম স্যারের দরজা লাগানো। ভিত্রে থিকা সুকন্যার হাসি শুনা যাইতাসে।
- হাসি শুইনাই বুইঝা ফালাইলা হেইডা সুকন্যা ?
- আরে, সুকন্যার লগে কি আমার একদুইদিনের দেখা নাকি ? হের হাসি পাঁচশ মাইয়ার মধ্যেও চিনা ফালামু।
- তা, আজহার হোসেন এর বৌ কি আবার বিয়া করতাসে নাকি ? বেশ খাসা আছে মহিলাটা।
- আরে, এগো আবার বিয়া !!
তারপর রাসেল তার মুখটা ম্যানেজারের কানের কাছে এনে খুব ফিসফিস করে বলে - স্যার, মহিলারে খাইয়া দিবেন নাকি ? ব্যবস্থা আছে কিন্তুক।
- তাই নাকি ? কি ব্যবস্থা ?
তারপর আবার এক খলনায়ক হাসি ঝুলিয়ে রাসেল জবাব দেয় - আপ্নে খালি আমার লগে থাহেন। আমিই আওয়াজ দিমুনে কয়েকটা দিন বাদে। হাজার হউক, স্যারে মইরা গ্যাসে, স্বামী হারানির ব্যাপারটা কাটায়া উঠতে দেন।
নাৎসী জার্মান গোয়েবলস বলেছিলেন -একটা মিথ্যা একশ বার বললে সেটা সত্যি হয়ে যায়। সেই কথাটি সত্য প্রমাণ করার জন্যেই হয়তো রাসেলের বেশ কিছু গল্প সত্য হয়ে গেল। তার মাঝে কিছু কিছু গল্প পত্র পত্রিকাতেও ছাপা হল। দুইজন সাংবাদিক আজহার হোসেনের মৃত্যু ও জীবদ্দশার স্মৃতি সম্পর্কে রাসেলের বক্তব্য শুনে গেল। এইসবের চেয়েও বড় কথা - রাসেল নিজের গল্পসমূহ নিজের চোখের সামনেই ঘটতে দেখতে লাগল। সুকন্যা কে সে বাস্তবে কোনদিন না দেখলেও লুকিয়ে লুকিয়ে সুকন্যা এবং আজহার হোসেন এর সঙ্গমদৃশ্য তার জ্বলজ্বল করা স্মৃতিতে পরিণত হল।
বেশ কিছুদিন পরের শুক্রবার আরেক নতুন ছুটি ছুটি রোদ মাখানো সকালবেলায় ডান হাতে টুথব্রাশ দিয়ে দাঁতের মাঝে ক্লোজ আপের ঝড় তোলার সময়, বাম হাতে লুঙ্গির উপর দিয়ে শিশ্ন ও তৎসংলগ্নএলাকাসমূহ চুলকানোর সময় রাসেলের মনে হয় - মাঝে মাঝে এইরকম মৃত্যুর দরকার আছে। তাইলে আশেপাশের বেশ কিছু মাইনষের দিনকাল খুব ভালা যায়।
ঠিক সেই সময়ে নৈঃশব্দ ভেঙ্গে রাসেলের কানে বেজে ওঠে ভরাট কন্ঠের এক অনীপ্সিত ঝংকার -
"আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে......"