somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফুলজান আমার লাজুক হাওয়া (ছোটগল্প)

০১ লা মার্চ, ২০১৩ রাত ১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





হয়, মাঝে মাঝে এমন হয়। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক চোখ আর নিঃসাড় মস্তিষ্ক দল বেঁধে ছুটে যায় ভ্রান্ত সময় ভ্রমণে।

যেমনটা হয়েছিল সেদিন। আমি আর আজহার পলাশীতে নৈশব্দের সুতো বিমর্ষতায় পুড়ে সন্ধ্যাটুকু সেলাই করছিলাম। অনেকক্ষণ পর নেমে এল চাঁদ, নাগরিক নির্জনতার মাঝে। আজহার বলল – 'ভাপাপিঠা খাবি ?? এইখানে এক খালা আছে, খুব ভাল বানায়।'
আমরা গেলাম। আটপৌরে নীল শাড়ির মাঝ থেকে বেরিয়ে এল একটা কোমল হাত, সেখানে দুটো চুড়ির ধাক্কা, রিনিঝিনি শব্দের মাঝ দিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরলো তার সৃষ্ট দুটো পিঠা। আমি পিঠার দিকে তাকাই, মনে হয় যেন ঐ চাঁদের একটা মিনিয়েচার হাতে ধরে থাকি। শুভ্র-শুক্ল, সেখানে কলংকের মত লেপ্টে আছে খেজুরের গুড়। খালা আজহারের দিকে নিশানা করে জোছনা মাখানো হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় একটা প্রশ্নবোধক – ‘ভালা আছেন ভাই ??’ আজহার দায়সারারকমভাবে মাথাটা নাড়িয়ে পালটা একটা প্রশ্নবোধক ছোড়ে – ‘আচ্ছা খালা, দ্যাখো, আমি তোমার এইখানে পিঠা খাই কতদিন হল। অথচ, আমরা নিজেদের নামটাই জানিনা এখনো। আমার নাম আজহার, তোমার নাম কী ??’
সাথে সাথে কোন এক অলীক স্পর্শ অনুভূত হয় তার। একটা নিশ্চিন্ত কেন্নো হঠাৎ স্পর্শ পেলে যেমন, তেমনিভাবে শরীর গুটিয়ে নেয়। লজ্জাবতী পাতার মত শাড়ির ঘোমটার মাঝে গুটিয়ে নেয় মুখ, সেই লজ্জাবতীর ফুল হয়ে নির্লজ্জ ফুটতে থাকে পিঠাগুলি। খালা লজ্জা পায়, সে যে কী ব্রীড়া, সে যে কী সংকোচ !! যেন নাম তার এক গোপন অপরাধ। লজ্জাবতী বলে- ‘বলাই লাগবো ??’ আজহার বলে – ‘না, তা না, ইচ্ছা না হইলে কওনের দরকার নাই।‘ আচল টেনে, ঘোমটা টাকে আরেকটু লম্বা করে খালা জবাব দেয় – ফুলজান। যেমন করে নববিবাহিতা বাসর ঘরে স্বামীর প্রশ্নে জবাব দেন।

তখনই আমি তার ব্রীড়ার উৎস খুঁজে পাই, শহুরে যান্ত্রিকতায় সেকেলে নামটা বয়ে বেড়ানোই তার লজ্জা। এই নামটা ধরে সম্ভবত কেউ তাকে ডাকে না আর, সম্ভবত কোন পলাশ কিংবা বকুলের মা – এইটুকুই তার পরিচয়। তবে কেউ নিশ্চয়ই ডাকতো, আদর করে ডাকতো। গোল্লাছুট খেলার মত নামটাও তার ছুটে পালিয়ে গেছে জীবন থেকে।

আর, ঠিক সেই সময় ঐ যে বলেছি মাঝে মাঝে ভ্রান্ত সময় ভ্রমণে চলে যাই। আমি ডুবে গেলাম, ফুঁড়ে গেলাম অজস্র সময়।



যেন ফুলজান আমার বধূ, কৈশোর কে বিদায় জানাতে অপ্রতিভ এক পল্লি তরুণী। শিশুদের আঁকা ছবিতে যেমন দেখা যায়, একটা নদীর পাশে একটা কেবল কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে, ঠিক সেইরকম একটা কুঁড়েঘরে আমাদের বাস। আহ, ফুলজান, আমার ফুল, আমার জান। ফুলজান ঘরে থাকে, আমি কিষাণ মাঠে আলের মাঝে, আগাছার ফাঁকে ঘরে ফেরার আকাংখাটা লুকিয়ে রাখি। ধানের মাঝে গেঁথে দেই সোনালী স্বপ্ন। ফুলজানের কোলে আসবে নতুন কিষাণ। শাড়ির ভাঁজে লেপ্টে থাকবে, আচলে মুখ লুকাবে। উঠানে হামাগুড়ি খাবে দিনভর।

মনে হয়, যেন আমি আর ফুলজান ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই আর। আমি আদম, ফুলজান আমার হাওয়া। আমাদের চারপাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় রঙ, লাল-নীল-হলুদ সবরকম। আমি সেই রঙ দেখে, দেখতে দেখতে বাঁশি বাজাই, বাঁশির সুরে আমার শব্দ খেলা করে। দুপুরবেলা বটগাছটার নিচে বসে ছায়ায়; আর ফুলজান বসে বসে ঘাসে হাত বুলায়, আঙ্গুলের মাঝে সবুজ মাখে। ফুলজানের অনাবৃত শরীরএর চামড়া একটু কুঁচকে গেলে তার নিচে খেলা করে আমাদের শিশু।
এরই ফাঁকে কখনো পাখিরা শিষ দিয়ে ওঠে, উদাস করা। সেই শিষ সীসার বুলেটের মত আমাদের কানে এসে লাগে। আমরা ব্যথা পেয়ে ছোট্ট একটা ধ্বনি তুলে হাসাহাসি শুরু করি। সেই হাসির সাথে অল্প একটু পানি মিশিয়ে ফুলজান আমাদের উঠান লেপে। তাই, আমাদের উঠানে হাসিগুলো ফুটে থাকে সবসময়। আমাদের ছাদে মেঘ ভাসে নিরন্তর, সেই মেঘের ছায়াগুলো, মায়াগুলো ঝড়ে পড়ে আমাদের খড়ের চালে।

আমাদের আপন নদীতে মাঝে মাঝে একটা দুইটা নৌকা চলে, হেরে গলায় গান গাইতে গাইতে মাঝিরা, তাদের আরোহীরা সরে যায়। তাদের গান মিশে যায় নদীর মন্থর ঢেউয়ে। সেই ঢেউ আচড়ে পড়ে আমাদের উঠানে, আমাদের হাসির সাথে মিশে নতুন রঙ এর জন্ম দেয়।
আবার, মাঝে মাঝে আমি আর ফুলজান শরত বিকালে নৌকায় চেপে বেড়াতে যাই নদীর অন্য ঢেউয়ে। তখন আমি নূহ, আমার নৌকার সওয়ার শুধু ফুলজান। সবাইকে ফেলে রেখে আমরা নৌকায় চাপি নতুন পৃথিবীর দিকে।

আঁধার নামলে ফুলজান হারিকেন কিংবা মোমবাতি নিয়ে আসে। সেউ আলো ফুলজানের মুখে পিছলে যায়। মুখে একটা লাজুক হাসি খেলে। চোখের পাপড়িতে বোনা সুখের নীড়। খেতে বসলে ফুলজানের থালা থেকে উড়ে আসা গরম ভাতের ভাঁপ এর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, আনন্দগুলো কি সুন্দর ভেসে বেড়াচ্ছে কুয়াশার মত।
আবার, কোন কোন রাতে আমরা একসাথে গান গাই, নাচি, আমাদের ঠোঁটগুলো আরেকজনের ঠোঁট ছুঁয়ে ফেলে।
কিংবা, কোন কোন রাতে ফুলজানের চুলোর পাশে বসে আগুন পোহানোর ফাঁকে ফুলজান বাড়িয়ে দেয় একটা ভাপাপিঠা।
মাটির চুলোয় আগুন ধাক্কা খেয়ে ফুলজানের মুখে আছড়ে পড়ে; সেখানে লজ্জা।



ফুলজানের ডাক শুনে সম্বিত ফেরে, ‘ কি ব্যাপার ভাইজান, খাইবেন না পিঠা?? ঠান্ডা হইয়া যাইবো তো !!’
কতক্ষণ চলে গেলো মধ্যে ?? কতক্ষণ ধরে আমি দাঁড়িয়ে?? বুঝতে পারি না। আনমনে পিঠা খেতে খেতে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আদম কি কবিতা লিখতো ?? হাওয়ার দিকে তাকিয়ে কি তার একবারও কবিতা লিখতে ইচ্ছা করেনি ??

আমি ফুলজানের দিকে হতবিহ্বল চাহনি দেই একটা। আর কী আশ্চর্য !! ফুলজানের চোখে সেই লজ্জাটাই লেপ্টে আছে এখনো।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৩ রাত ৩:২২
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×