পূর্বের দুটি অংশের পর-
ধর্ম আমরা অনেকে বিশ্বাস করি। যে নাস্তিক সেও মনে হয় ধর্মের ইতিহাসগুলো অবিশ্বাস করতে পারে না। হয়তো অলৌকিক বিষয়গুলো নিয়ে কারো মতবাদ থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনাবলীকে প্রায় সবাই মেনে নেয়। কথা প্রসঙ্গে বলতে হচ্ছে, সনাতন ধর্মে মহা ভারতের কথা। সনাতন ধর্মে তাদের অবতার শ্রী কৃঞ্চ সত্যের ভিত্তি গড়তে একটি যুদ্ধের সৃষ্টি করেন, সেই সময়, শ্রী কৃঞ্চের সময়কার কথা, হাজার হাজার বৎসর আগেকার কথা। অনেকে হয়তো শুনেছেন মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা। যাদের দুটি পক্ষ ছিল, এক পক্ষ কৌরভ আর অন্য পক্ষ পান্ডব। আর এই কৌরভ পক্ষের রাজা ধৃতরাষ্টের বড় পুত্র দূর্য্যধনের শ্বশুর বাড়ি ছিল বর্তমান হবিগঞ্জ জেলায়। যা এক সময় তরফ রাজ্য ছিল। অর্থাৎ ইতিহাস মতে সেই শ্রী কৃঞ্চ সময়কার যুগ থেকে বর্তমান বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল।
আসি আরো কয়েক জাতির বসবাসে, যেমন আমি এখন ইংল্রান্ডে বসবাস করছি। তারা সভ্য জাতির অনুকরনীয় হয়ে আছে। ধনে-জ্ঞানে, গৌরবে আমরা তাদের ইতিহাস চর্চা করি। আমরা বলি তারা বড় শৃঙ্খল জাতি, তাদের আইন-কানুন সত্যি মানতে হয়। তাদের মধ্যে উঁচু-নিচু নেই, মারামারি নেই, হানাহানি নেই, কতকিছু। আমি আগে সিন্ধু সভ্যতার কথা বলেছি, মহাভারতের কথা বলেছি, এটা কি আমাদের অংশ নয়? এর অনেক পরে আসি সম্রাট আশোকার কথায়। মুসলমান ধর্মের হযরত ঈসা (আঃ), যাকে খ্রিষ্টানরা যিসুস বা খ্রিষ্ট বলে। তিনি পৃথিবীতে আসার প্রায় আড়াইশত বৎসর আগে সম্রাট আসোকা ভারতের ভেতর থেকে শাসন করে গিয়েছেন। আমরা আমাদের শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অধিকৃত বাংলা-বিহার-উড়িশ্যা এর ভেতর বিহার অঞ্চল থেকে সম্রাট আশোকা তার শাসন কার্য চালিয়েছেন। আরতো রইল সম্রাট আশোকার আগের যুগের কথা। তবে যাই হোক, সম্রাট আশোকার আড়াই শত বৎসর পরে হযরত ঈসা (আঃ), অর্থাৎ যিসুসু পৃথিবীতে আসেন। উনি যখন বর্তমান ইটালীর রোম নগরে অবস্থিত তখনকার রোম সভ্যতার রাজার বিচারের সম্মুখিন হোন, তখন ইতিহাস মতে বর্তমান বৃটেনে কয়েক ঘরের বসবাস ছিল। অথচ আমরা কত অহংকার করে বৃটিশ জাতির ইতহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করি। আমিও করি, কারণ তারা বর্তমানে অনুকরনীয় হয়ে আছে। যেমন বাউল সম্রাট কারী আমির উদ্দীন সাহেব বৃটিশদের নিয়ে প্রায় পঁচিশ বৎসর আগে বলেছিলেন, 'আমরা যখন তাদের মতো হবো, তখন তারা শূন্য আকাশে বাস করবে'।
আমার বাড়ি সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মানিক কোনা গ্রামে। আমার দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি, আমার পিতার দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি, আমার মায়ের দাদাবাড়ি, নানা বাড়ি, আমার দাদার দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি, আমার দাদীর দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি একই গ্রামে। তাই গ্রামটার পতি আমার খুব মায়া, থানার প্রতি, জেলার প্রতি অর্থাৎ সিলেটির প্রতি খুব মায়া। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের প্রতিও মায়া, তবে সিলেটি শুনলে মনে হয় আমার গ্রামের কেউ। সিলেট কিন্তু বাংলাদেশেরই অন্তর্ভূক্ত। আমি বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখি, বাংলায় উপন্যাস লিখি, গল্প লিখি, নাটক লিখি, চলচ্চিত্র লিখি। তাই বলে আমার বাবা-মায়ের সাথে 'একটু' বলি না, বলি 'তোড়া'। 'এদিকে আসো' না বলে 'ওভায় আও' বলি। অর্থাৎ সিলেটি শব্দে কথা বলি। আর এই গুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আসেনি, বা ১৮৪৬ সালের বৃটিশ পরবর্তী ভারত-পাকিস্থান ভাগের পর আসেনি, বা ১৭৫৭ মালের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর আসেনি বা সেই মোগল বা কোন মুসলিম শাসনের সময় আসেনি। বলতে গেলে শ্রী কৃঞ্চের সময়কার আমার ঐলাকার লোকতো আর কথা না বলে বাস করেনি, নিশ্চয় ভাষাতে কথা বলতো, সেই হাজার হাজার ব্ৎসর আগে। হয়তো পরিবর্তীত হয়েছে।
ভাষার কথা বলতে গিয়ে এলাকার কথা আসে। এই সিলেট অঞ্চলে মানুষের বসবাস বরিশাল বা খুলনা বা নোয়াখালী থেকে সাঁতার কেটে আসেনি, অথবা কলকাতা থেকে নৌকা বেয়ে আসেনি। প্রশ্ন রইল, সনাতন ধর্মের অবতার শ্রী কৃঞ্চের সময় বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে লোক বাস করতো, বা কোন অঞ্চল ভুমির উপর দড়িয়ে ছিল। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অসহায় পতনের ঠিক পঁচিশ বৎসর পরে বৃটিশদের বিরুদ্ধে দুর্বার যুদ্ধ সমগ্র ভারতের কোথাও হয়নি, সিলেটে হযেছে, সেখানে কতিপর লোক শহীদও হয়েছেন, সৈয়দ হাদি ও সৈয়দ মাহদি অন্যতম, যাদের হাদা মিয়া-মাদা মিয়া নামে চিনি। সেই যুদ্ধের ঠিলাটা আজো সাক্ষি হয়ে সিলেট শহরের শাহী ঈদগাহে অবস্থিত আছে। সেই যুদ্ধের বৃটিশদের পক্ষের সেনাপতি মিস্টার লিন্ডস, যিনি ১৭৮৩ সালের দিকে বৃটিশ কর্তৃক সিলেটের কালেক্টর নিযুক্ত হন, তার জীবনের স্মৃতি চারণে লিখে গিয়েছেন, আমি যখন সিলেটে যাই, কলকাতা থেকে বড় নৌকা যুগে যাত্রা শুরু করলাম, সমগ্র রাস্তায় পানি আর পানি দেখলাম, মাঝে মধ্যে দেখলাম ছোট ছোট গ্রাম, সমুদ্রের বুকে জেগে উঠা চড়াঞ্চল কিন্তু সিলেটে গিয়ে দেখলাম পাহাড় ঘেরা অতি মনোরম এক অঞ্চল, যার সম্পদের দিকে ছিল স্বয়ং-সম্পূর্ণ, ছিল বিশাল বিশাল অতি পুরাতন পাহাড়ী গাছ, বন্য প্রাণি হাতি থেকে বাঘ, আমি পাহাড়ী গাছ কেটে বড় বড় জাহাজ বানালাম, হাতি শিকার করে বিক্রি করতে লাগলাম ইত্যাদি। তিনি সিলেট থেকে খাজনা হিসাবে পেতেন বস্তা বস্তা কড়ি, যা সমুদ্রে পাওয়া যেত। অর্থাৎ তখনকার সময়ও সিলেটে পণ্যের আদান-প্রদানে কড়ির প্রথা ছিল। টাকা বা পয়সা অর্থাৎ মুদ্রাও ছিল না। তিনি বললেন সিলেট যে এক সময় সমুদ্র বন্দর ছিল তা বুঝতে তার বাকি রইল না। তাই বুঝা যাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরের বন্দর যদি সিলেট হয়, তবে ঐ সময়ে এর নিম্নাঞ্চলগুলো বঙ্গোপসাগরের কত গভিরে ছিল।