somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিষিদ্ধ যতো বই .......

২৩ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
]


নিষিদ্ধ যতো বই .......
[ চতুর্থ পর্ব ]

"ডক্টর জিভাগো"
Doctor Zhivago



Doctor Zhivago, 1st edition cover.

বরিশ পাস্তেরনাক নামটি সাহিত্যের জগতে যুগপৎ সম্মান আর বিস্ময়ের সাথে উচ্চারিত । "ডক্টর জিভাগো" পাস্তেরনাকের প্রথম উপন্যাস । এই একটি বই লিখেই ১৯৫৮ সালে সাহিত্যের নোবেল পুরষ্কারটি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি । আবার সে নোবেল পুরষ্কার গলায়ও ওঠেনি তার । পুরষ্কারটিকে অস্বীকার করতে হয়েছে তাকে বাধ্য হয়েই । সোভিয়েত লেখক সংঙ্ঘের সদস্যপদ থেকেও তাড়ানো হয়েছে তাকে ।
আদতে ডক্টর জিভাগো একটি প্রেমের উপাখ্যান । বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রাশান ইতিহাসের বিক্ষুব্ধ, ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়টিতে দুটি নারীর প্রতি ডক্টর ইউরি জিভাগোর ভালোবাসার টানাপোড়েনের আলেখ্য ।
১৯৫৭ সালে ইটালিতে এর প্রথম প্রকাশ । ১৯০৫ সালের রাশান বিপ্লব আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বতীকালীন সময়ের ঘটনা । গল্পের কাহিনীর ভেতর দিয়ে রাশানদের গর্ব অক্টোবর বিপ্লবকে হেয় করার অভিযোগে রাশিয়াতে বইটি প্রকাশের চেষ্টা ব্যর্থ হয় । জিয়ানজিয়াকোমো ফেল্ট্রিনেল্লি নামের এক ক্ষমতাবান প্রকাশক বইটিকে লুকিয়ে ইটালির মিলান শহরে নিয়ে এলে পরে এখানেই ১৯৫৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয় । দু - দশকের ভেতরেই ছয়টি মহাদেশের পাঁচ মিলিয়ন মানুষ বইটি কিনে ফেলেন ।
১৯০৫ সালের পরের ঘটনার কথা লেখা হলেও ১৯৫৬ সালের আগে বইটি লেখা শেষ হয়নি । রুশ সাহিত্য পত্রিকা "নোভী মির" ("Новый Мир") এ ছাপানোর জন্যে পাঠানো হলেও বইটি প্রত্যাখ্যাত হয় এই দোষে যে, গল্পের মেজাজে সন্দেহাতীত ভাবে সোস্যালিষ্ট রিয়েলিজমকে প্রত্যাখ্যান করার সুরই যেন চড়া । সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের কাছে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থকেই লেখক উপজীব্য করেছেন গল্পে । রাশান সেন্সরবোর্ড একধাপ এগিয়ে বলেছেন, বইটির অনেক অধ্যায়ই পুরোপুরি – এন্টি সোভিয়েত । ষ্ট্যালিনিজম, কালেক্টিভাইজেশান, সোভিয়েত গুলাগ ( ষ্ট্যালিন আমলের সোভিয়েত ফোর্সড লেবার ক্যাম্পের রূপকার যে সরকারী এজেন্সী ) সম্পর্কে পাস্তেরনাকের করা সুক্ষ্ণ বিদ্রূপেও মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায় তাদের । বইটি নিষিদ্ধ হয় রাশিয়াতে ।

এইসব রাজনীতির ফাঁক ফোকরের আড়ালে আপনি যেটা বেশী করে অনুভব করবেন তা হলো - গল্পের সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সাহচর্য্যলাভের জন্যে একটি মানুষের মৌলিক আকাঙ্খার তীব্র আবেগ দিয়ে ।
রাশান বিপ্লব, ছেলেবুড়ো সবার ভেতরেই যে আদর্শগত একটি দ্বন্ধের টানাপোড়েন তৈরী করে দিয়েছে যা আপোষহীন অমোঘ নিয়তির মতো তাড়া করে ফিরছে তাদের , গল্পের নায়ক ইউরী জিভাগো সেখান থেকে বেঁচে যেন পালাতে চেয়েছেন ব্যক্তি চিন্তা , ব্যক্তি পছন্দ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের নির্মল আশ্রয়ের ভেতর । জিভাগো এখানে যেন একটি স্বতন্ত্র মানুষের প্রতিভু যিনি নিজেকে প্রকাশ করেন কবিতার ভেতরে । জীবনের সব কিছুর ভেতরেই যিনি সুন্দরতাকে খুঁজে ফেরেন ।
ডক্টর জিভাগো যেন পাস্তেরনাকেরই অল্টার ইগো । তেমন করেই চিত্রিত করেছেন তাকে । যিনি একাধারে কবি, দার্শনিক আবার চিকিৎসক ও । জীবন যার ওষ্ঠাগত বিপ্লবী বলশেভিক রাজত্বের নিষ্ঠুরতা আর রূঢ় বাস্তবের আঘাতে । আর এই বিক্ষুব্ধ, বৈরী, অসংহত সময়টিতে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমেও যিনি আকন্ঠ নিমজ্জিত ।


নায়ক জিভাগোকে আমরা যখোন প্রথম দেখি, তখোন তাকে দেখি চারধারের যা কিছু তার অর্জন তা থেকে উপড়ে ফেলা এক অসহায় শিশুর মতো । মায়ের কবরের পাশে ক্রন্দনরত । শৈশবে মাকে হারিয়ে যে ভালোবাসা আর স্নেহের নিরাপত্তার বেষ্টনী থেকে জিভাগো ছিটকে পড়েছেন, আজীবন তেমনি এক নিরাপত্তাকেই খুঁজে গেছেন সারাটি গল্পে । স্ত্রী তানিয়াকে শুধু বন্ধু হিসেবেই পেয়েছেন । ভালোবাসা,ভরসা, নিরাপত্তা খুঁজে পাননি সেথায় । বিংশ শতকের প্রথমার্ধে রাশিয়ার উত্তপ্ত আর বিক্ষুব্ধ সময়টিতে যখোন রাশান মানুষগুলো ছুটছে খাওয়ার মতো একটুকরো রুটি আর বরফ শীতল আবহাওয়ায় বেঁচে থাকার জন্যে জ্বালানী কাঠের পেছনে, তখোনও সেই ভালোবাসার পেছনেই ছুটেছেন তিনি । নিজের ভেতরে খুঁজে ফিরেছেন অতৃপ্ত সেই আকাঙ্খাকে, ফ্রয়েডীয় ভাষায় যাকে আমরা বলতে পারি " ম্যাটারনাল অবজেক্ট" । নারীর প্রতি ভালোবাসা আর স্নেহের টান । তাই ছুটেছেন এক নারী থেকে আর এক নারীতে । প্রথমে পরস্ত্রী লারাকে জড়িয়ে ভালোবাসায় স্থিত হতে চেয়েছেন । যে তাপ উষ্ণতা দেয়, তা খুঁজে পেয়েছেন যেন লারার মাঝেই । তাই বারবার তার কাছেই ফিরে গেছেন । তার এই আবেগ আর অন্তর্দর্শীতা তাকে ঘিরেই ছিলো সবসময় । লারার জন্যে রোমান্টিসিজম আর প্যাশন এর যে আবহ তার ভেতরে লালিত হচ্ছিল , সেসব ঘিরে নিজের এক জীবনদর্শন গড়ে উঠেছিলো তার ভেতর । কিন্তু বলশেভিক আন্দোলনের বৈরী সময়ে দানা বেঁধে ওঠা সোভিয়েত আইডিঅল্যাজির মাঝে ধাক্কা খাচ্ছিলো তা বারেবারে । বিপ্লবের প্রতি নিজের বিশ্বাসেও স্থির হয়ে থাকা তার আর হয়ে ওঠেনি । নিজের একান্ত ইচ্ছের বিরূদ্ধেও শুধু বিপ্লবের খাতিরে তাকে হত্যা করতে হয়েছে প্রতিবিপ্লবীদের । এই হত্যা নিজের একান্ত বিশ্বাসকেই যেন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে বারবার । শেষতক জিভাগো বুঝতে পেরেছেন বাস্তবের কঠিন শিক্ষাটি । বিপ্লবের পক্ষ - বিপক্ষ, যে দলেই আপনি থাকুন না কেন আপনার ব্যক্তিগত বলতে কিছু নেই । আপনার ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া , মমতার কোন স্থান নেই এই রকম সমাজ ও রাষ্ট্রে । আপনি শুধুই যুথবদ্ধ এক প্রানী , আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই আপনার । আপনাকে শুধু কাঁকাতুয়ার মতো শেখানো বুলিই আউড়ে যেতে হবে । যেখানে প্রানের কোন স্পন্দন স্পন্দিত হবেনা কারো বুকে, কারো কবিতায় । তবুও জিভাগো সেই বৈরী সময়েও লারাকে নিয়ে লিখে গেছেন সেই কবিতাই যেখানে বাস্তব উঠে এসেছে কঠিন ভাবে , যে বাস্তব থামিয়ে দিয়েছে দুটি প্রানের উষ্ণ চুম্বনকে ও ।

I've let the family go its ways,
All those close to me have long dispersed,
And the usual solitude
Fills all of nature and my heart.
And so I’m here with you in the cabin,
In the unpeopled and deserted forest.
The paths and trails, as in a song,
Are half submerged in undergrowth.
Now the log walls gaze in sorrow
At us alone. We never promised
To take the obstacles, if we perish,
We shall do so openly.
We sit down at one, get up at three,
I with a book, you with your sewing,
And at dawn we won't have noticed
How at some point we stopped kissing.

(অনুবাদ Pevear and Volokhonsky)

বইয়ের চরিত্রগুলি যেন মহাকাব্যের মতো আবার একই সাথে মামুলী, সাধারন । যে নারীতে সমর্পিত ছিল জিভাগোর ব্যক্তিমানস , সেই লারিসা ফিওদরভনা ( লারা) ও হারিয়ে গেছেন তার জীবন থেকে সাধারণ্যে । স্পষ্টত লারা হয় গ্রেফতার হয়েছেন রাস্তায়, নয়তো মারা গেছেন অজানা কোন শহরে । অসংখ্য উওম্যান কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের কোনও একটিতে । হারিয়ে যাওয়া মানুষের তালিকার নীচে চাপা পড়ে গেছে তার নামটিও । জিভাগো তাকে শুধু খুঁজেই মরেছেন ।
পাস্তেরনাক এখানে দেখিয়েছেন , যে উদ্দ্যম আর আকাঙ্খা নিয়ে বিপ্লবের যাত্রা, তা হোচট খেয়ে গেছে পূর্ণমাত্রার সিভিল ওয়্যর এর কারনে । যতোটা না অসৎ নেতাদের লোভের কারনে তার চেয়েও বেশী হয়েছে, গৃহিত ত্রুটিপূর্ণ ও অসৎ উদ্দেশ্যযুক্ত বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্যে । দেখিয়েছেন , লাইনচ্যুত বিপ্লবী ট্রেনখানার ধাক্কা সোভিয়েত সমাজে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে আঘাতের আর তার ধংশাবশেষের জঞ্জাল, মরনঘাতী দূর্ভোগের ।
এই ২০১৪ সালে আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সী ( সি.আই.এ ) র ডিক্লাসিফায়েড নথিপত্রে আমরা দেখি যে , পাস্তেরনাকের এই উপলব্ধিগুলোই তারা কাজে লাগিয়েছেন সোভিয়েত ভিন্ন মতাবলম্বীদের উসকে দিতে । ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত সি.আই.এ র আর একটি মেমোতে লেখা হয় ,
" ডঃ জিভাগো বইটি তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য আর চিন্তার খোরাক জোগানোর অর্থেই শুধু মহামূল্যবান নয়; মহামূল্যবান এই কারনে যে , বইটি দিয়ে আমরা সোভিয়েত জনগণকে বোঝাতে চাই কেন একজন জীবিত আর গ্রেটেষ্ট সোভিয়েত লেখক তার নিজ ভাষাতে লেখা বই তার নিজ দেশের মানুষদের জন্যে প্রকাশ করতে পারবেন না , নিজ দেশের মানুষকে পড়াতেও পারবেন না ! তাদের সরকারের গলদগুলো কোথায় ।"
তাই কি শুধুমাত্র রাজনৈতিক টেক্কা মারতেই " ডঃ জিভাগো" বইয়ের লেখক বরিশ পাস্তেরনাককে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করেছ পশ্চিমের পূঁজিবাদ ?

হয়তো ।

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার এই খবরটি চাউড় হয়ে গেলে ক্রুশ্চেভ এর রাশান সিক্রেট পুলিশ ঘিরে ফেলে পাস্তেরনাক সহ তার বন্ধুবান্ধবদের বাড়ী । এমোন কি তার রক্ষিতা ওলগা ইভনিস্কায়া , পাস্তেরনাকের সাথে সম্পর্কের কারনে যাকে একবার কন্সেনট্রেশান ক্যাম্পে পর্য্যন্ত যেতে হয়েছিলো ; তাকে আবারো কন্সেনট্রেশান ক্যাম্প গুলাগে পাঠানোর হুমকি দেয়া হয় । পিছু হটতে হয় পাস্তেরনাককে । ফিরিয়ে দিতে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্মানের পুরস্কার, নোবেল । নোবেল কমিটির কাছে পাস্তেরনাককে লিখতে হয় এভাবে --- "Considering the meaning this award has been given in the society to which I belong, I must refuse it. Please do not take offense at my voluntary rejection."

কী বিচিত্র এই রাজনীতির খেলা !

মৃত্যুর প্রায় ত্রিশ বছর পরে ১৯৮৭ সালে মিখাইল গর্ভাচেভ এর ডেমোক্রাটিক রিফর্ম কালে পাস্তেরনাককে আবার ফিরিয়ে আনা হয় বদলে যাওয়া রাশান সমাজে । আর প্রত্যাবর্তন ঘটে তার নিজ ভাষাতে লেখা বই "ডঃ জিভাগো"র ; তারই নিজ দেশের মানুষদের সামনে ।



লেডী চ্যাটার্লী'জ লাভার
Lady Chatterley's Lover



ফুটবলের মতো দ্রুত গড়াতে থাকা আজকের সভ্যতার মাঝখানেও, যেখানে যৌনতার কথা পেপার-পত্রিকায় সহজেই পড়া যায় , চলচ্চিত্রে যা সাধারন একটি ব্যাপার সেখানে দাঁড়িয়ে যদি এমোন প্রশ্ন করা হয় , আসলেই কি "লেডী চ্যাটার্লী'জ লাভার" বইটি একটি পর্ণোগ্রাফি নাকি অন্যরকম সাহিত্য , তবে দুবার ভাবতে হয় বৈকি !

ভাবার কারনও আছে । প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে, বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব প্রচারনার মধ্যে দিয়ে লন্ডনের ওল্ড বেইলি রোডের আদালতে শ্লীলতা নিয়ে আইনি লড়াইয়ের নামে যে সার্কাসটি অনুষ্ঠিত হয় , ভাবার কারনটি সেখানেই । শত শত পলিটিশিয়ান মিলে যা করতে পারেন নি, এই আইনি লড়াইটি একবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনকে যেন অনেকটাই যুগোপযোগী করে তোলার পথটিই দেখিয়েছে সেদিন । বৃটেনবাসীর মন-মানসিকতায় আধুনিকতার ছোঁয়ার প্রথম পরশ ।
১৯৬০ সালের অক্টোবরে জনাকীর্ন ওল্ড বেইলি আদালতে ১২জন জুরীদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেয়া হয় শতাব্দীর কুখ্যাত একটি বই "লেডী চ্যাটার্লী'জ লাভার"। লিখেছেন ডি এইচ লরেন্স । শর্ত , আদালতের বাইরে বইটি নিয়ে যাওয়া চলবেনা । পড়তে হবে আদালত কক্ষেই । তারপর মতামত দিতে হবে । বইটির বিরূদ্ধে অভিযোগ পর্ণোগ্রাফির ।
অভিযোগ, সভ্যতার ধ্বজ্জাধারী বৃটেন রাষ্ট্রপক্ষের । প্রকাশক পেঙ্গইন বুকস । ১৯২৮ সালে ইতালীর ফ্রোরেন্সে প্রথম প্রকাশিত হবার পর থেকেই বইটি যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয় । আটত্রিশ বছর নিষিদ্ধ থাকার পরে স্বনামখ্যাত পেঙ্গইন বুকস "redeeming social merit" এই প্রশ্নটি তুলে বৃটেনে বইটির নিষিদ্ধকরন চ্যালেঞ্জ করেন । শুরু হয় সার্কাসের । রেমন্ড উইলিয়ামস , হেলেন গার্ডনার , ই.এম. ফস্টার , রিচার্ড হগার্ট এর মতো সে সময়ের বিখ্যাত বিখ্যাত সব একাডেমিক ক্রিটিকস আর এক্সপার্ট আর পাদ্রীদেরও জুরী লাইনে বসে থাকতে দেখা যায় । বারো দিন পরে বারোজন জুরী একবাক্যে রায় দেন "নট গিল্টি" । প্রসিকিউশানের লোকদের উপহাস আর ব্যঙ্গ করে বলা হয়, সমাজের পরিবর্তিত মূল্যবোধের সাথে তাদের কোনও পরিচয়ই নেই ।
হেরে গিয়ে ক্ষোভে-দুঃখে চীফ প্রসিকিউটর মারভিন গ্রিফিথ জোন্স জানতে চান , এটা কি সেই ধরনের একটি বই যা আপনারা আপনাদের স্ত্রী আর চাকর-বাকরদের পড়তে দিতে পারেন ?

প্রশ্নটি আপনিও করতে পারেন । দেহ আর মন নিয়ে যে গভীর সত্য কথাটি বলেছেন লরেন্স তার বইয়ে , তাকে পাশে ঠেলে সরিয়ে আপনার ও মনে হতে পারে – আসলেই কি বইটি সবাইকে পড়তে দেয়া যায় ? আপনাকেও দুবার ভাবতে হতে পারে , কারন -

কাহিনীটি যে গড়িয়েছে, যৌন জীবনে অতৃপ্ত , অসুখি উচ্চবর্গের এক নারী আর তারই বেতনভোগী এক নিম্ন শ্রেনীর কর্মচারীর দেহগত মিলনের ব্যাপারগুলো নিয়ে । ধনী কিন্তু পক্ষাঘাতগ্রস্থ স্বামী ক্লিফোর্ড চ্যাটার্লীর কাছে পার্থিব জৌলুসের সব পেয়েও একজন স্ত্রীর যে আরো কিছু চাহিদা থাকে তা পুরনের বর্ণনা কাহিনীতে । যুদ্ধের আঘাতে নিম্নাঙ্গের পক্ষাঘাত নিয়ে বেচারা ক্লিফোর্ড চ্যাটার্লী দেহগত সুখ হয়তো দিতে পারেননি স্ত্রী কন্সট্যান্স চ্যাটার্লী (লেডী চ্যাটার্লী) কে কিন্তু মনোগত সুখ দিতেও তার কার্পন্য লেডী চ্যাটার্লীকে ঠেলে দিয়েছে সেই পথে যে পথ সমাজ স্বীকৃত নয় বরং ধিক্কারের । দেহগত সুখ পেতে যিনি ক্ষনেকের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন ক্লিফোর্ড ষ্টেটের গেমকীপার অলিভার মেলর্সকে । আর সেখান থেকেই শুরু । জীবনের ঈপ্সিত আর পরম আকাঙ্খিত সুখটুকুর সব পেয়েছেন অলিভার মেলর্সের কাছ থেকে । নিজেকে পূর্ণ মনে করেছেন তিনি । উপলব্ধি করেছেন সব মানুষের জীবনের পরম সত্যটি ; শুধু মন নিয়ে বেঁচে থাকা যায়না , চাই দেহগত সতেজতাও । সম্ভোগের উত্তুঙ্গ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন, শুধু মানসিক নৈকট্য নয় ভালোবাসা হতে পারে দেহের চড়াই উৎরাইয়ে সাঁতার কেটেই ।
শুধু এক সুরে বাঁধতে হবে দুটোকে । তাই ভালোবেসেছেন মেলরকে ।

সেক্স বুঝতে গিয়ে পৃথিবীর মানুষ যেখানে শুধু শারীরিক আনন্দের কথাই বোঝেন , সেখানে লরেন্স দেখাতে চেয়েছেন যৌনতা কেবল "স্থুলতা" নয় বরং "পবিত্র" একটি দেহ ও মনগত প্রক্রিয়া । লরেন্স, মনসর্বস্য পঙ্গু ক্লিফোর্ড চ্যাটার্লীর জীবনের অনুভব আর তারই কর্মচারী গেমকীপার অলিভার মেলর্সের দেহসর্বস্য স্ত্রীর পশুসুলভ যৌন আচরনকে প্রকারান্তরে তুলনা করে শরীর আর মনের কনট্রাস্ট দেখিয়েছেন বইয়ে । তাই লেডী চ্যাটার্লী আর মেলর্সের একে অপরের প্রতি নমনীয়তা, শারীরিক আবেগ আর পারস্পারিক শ্রদ্ধা থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নেয়া একটা ভালোবাসার কথাই তুলে ধরেছেন এখানে । দেখিয়েছেন , দেহ ও মনকে তারা আবিষ্কার করেছেন শারীরিক উষ্ণতার চাদরের ভেতর থেকেই ।

দেহ ও মন সংক্রান্ত এই সত্যটি ছাপিয়ে মনে হয় কাহিনীর পাত্রপাত্রীর সামাজিক অবস্থানটিই বড় বেশী আঘাত করেছে তখনকার তথাকথিত সুশীল পাঠক সমাজকে । যে সমাজে তখোন উচ্চবর্গ আর নিম্নবর্গের ফারাক যোজনব্যাপী । তাই বৃটেন ক্ষুব্ধ হয়েছে । বিক্ষুব্ধ হয়েছে আমেরিকা , কানাডা , আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীনও । নিষিদ্ধ হয়েছে বইটি সে সব দেশে । বইটি ৩০ বছর নিষিদ্ধ থেকেছে কানাডায়, বইতে ব্যবহৃত ভাষা আর খোলামেলা যৌনক্রিয়ার বর্ণনার কারনে । ১৯৩০ সালে আমেরিকার সিনেটে বইটি নিয়ে তর্ক হয়েছে জোর । আমেরিকাতে "অবসীন বুকস" আমদানি নিষিদ্ধে " স্মুট - হওলে ট্যারিফ এ্যাক্ট " এর বিরুদ্ধে সিনেটর ব্রনসন কাটিং এর এক প্রস্তাবের জবাবে সিনেটর রীড স্মুট বলেন .... " আই হ্যাভ নট টেকেন টেন মিনিটস অন লেডী চ্যাটার্লীজ লাভার, আউটসাইড অব লুকিং এ্যাট ইটস ওপেনিং পেইজেজ । ইট ইজ মোষ্ট ড্যামন্যাবল ! ইট ইজ রিটন বাই আ ম্যান উইথ আ ডিজিজড মাইন্ড এ্যান্ড আ সৌল সো ব্লাক দ্যাট হি উড অবসকিওর ইভন দ্য ডার্কনেস অব হেল ।"
হুমকি দেন এই বলে যে, যে বইটি সাধারন মানুষের হাতে যেন কোনক্রমেই না পড়ে, দরকার হলে তেমন বইটি তিনি পড়ে শোনাবেন সিনেট কমিটিতে ।
জাপানেও কাহিনী এক । সী-ইতো নামের এক জাপানীজ ১৯৫০ সালে বইটির পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশ করলে তা অবসীনিটি ট্রায়ালে পড়ে যায় । ১৯৫৭ সালে আদালত "গিল্টি" রায় দিয়ে সী-ইতো কে একলাখ ইয়েন আর তার প্রকাশককে আড়াই লাখ ইয়েন অর্থদন্ড প্রদান করেন ।
এরকম অবসীনিটির মামলা হয়েছে অনেক দেশেই , এমোন কি ভারতেও ।
দোষ কি বইটির ?
দেহ ও মন সংক্রান্ত ধ্রুবসত্যটি বলা হলেও বর্ণনা, ভাষা ও শব্দের ব্যবহার , খোলামেলা যৌনাচার বইটিকে এতো দোষনীয় করেছে ।


(পরবর্তী কালের চলচ্চিত্রে আপনি দেখবেন এমন ধারাটি ..)
কিন্তু সত্যিই কি লরেন্স এই বইয়ে দেহ ও মন নিয়ে সত্যকথাটি বলতে পেরেছেন ?
নিউরো সাইকো এ্যানালিষ্ট মার্ক ব্লেচনার পুরো বক্তব্যটিকে "লেডী চ্যাটার্লী ফোনোমেনান" আখ্যা দিয়ে বলেছেন , এই একই রকম যৌন সংসর্গ বিভিন্ন সময়ে , বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ভাবে আচ্ছাদিত ও প্রভাবিত করতে পারে। তিনি বইয়ের কয়েকটি প্যাসেজের উদ্ধৃতি দিয়ে ( এখানে তার উল্লেখ সমীচিন নয় বলে বিরত রইলাম ) দেখিয়েছেন, নায়িকা নায়কের কাছ থেকে মানসিক ভাবে সরে এসে শুধু শারীরিক সম্ভোগ ক্রিয়ার মূহুর্তগুলিই বারেবারে মনে করছেন । যেন র‍্যালিস করছেন । যা কোনও মতেই দেহ ও মন এক হয়ে মিলে যাওয়া নয় ।
আবার বইটির পক্ষে সাফাই গেয়ে এ্যান নামের এক ব্লগার লিখেছেন - "Lawrence has successfully portrayed sex as sacred in a world where sex is viewed as nothing more than physical pleasure.
Lady Chatterley's Lover is a true masterpiece that takes a stand against the sex-obsessed culture we live in today."
এমনি করে লিখেছেন আর ও অনেকেই ।

হয়তো তা ই ! সে জন্যে প্রথমেই অবসীনিটি ট্রায়াল নিয়ে যে সার্কাসের কথা বলেছি সেটা মূলতঃ দুই ভাবধারার , দুই ধরনের মানসিকতার লড়াই । একদলে পুরাতন মূল্যবোধ নিয়ে প্রাচীন লোকজন , অন্যদিকে প্রগতিশীলতার ধারক যৌবনের গান গাওয়া দল ।

তবুও কথা থাকে , যে সময়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে সেসময়ে বৃটেনবাসীদের গায়ে থাকতো ভারী গ্রে স্যুট , পথেঘাটে খেটে খাওয়া নারীদের দেখা মেলা ছিলো ভার, ছিলো জাগ্রত রাজতন্ত্র । সে সময়ে এই ধরনের সাহসী আর স্থুল ভাষায় লেখা বইয়ের বক্তব্য "পাবলিক মোর‍্যালিটি "র উপর হুমকি হিসেবেই বিবেচিত হবার কথা ।

আমি বলি, বইয়ের কথায় কি আসে যায় ! আমাকে তা গিলে না ফেললেই হয় ! কিন্তু সে মানসিকতা আমরা কজন লালন করি ? আদৌ করি কি ? সেরকম মানসিকতা গড়ে তোলা বড় কঠিন । আমাদের মুঠির তেমন জোর হয়তো নেই যে জোরে নির্মল, উদার এক মানসিকতা তুলে আনতে পারি !!!!!

ছবি ও সূত্র :
Wikipedia, the free encyclopedia / BBC News / Sparknotes.com / Literature Network / Lady Chatterley trial - 50 years on. / On Boris Pasternak’s Doctor Zhivago - By Matthew Zapruder / goodreads.com / Doctor Zhivago (1957) by Boris Pasternak - By Joshua Cohen / history.com /

প্রথম পর্ব এখানে Click This Link

দ্বিতীয় পর্ব এখানে ....... Click This Link

তৃতীয় পর্ব এখানে ...
Click This Link





সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৪৫
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×