
১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের এক রবিবার। দক্ষিন ফ্রান্সের আর্দেশ (Ardèche) নদীর বাম তীরের লাইমষ্টোন পাহাড়ের খাড়াই ধরে ধরে জীন মেরি শ্যোভে যখন দুই বন্ধুকে নিয়ে কিছু একটা পাবার আশায় খোঁজাখুজি করছিলেন তখন একটি ফাটল থেকে বেরিয়ে আসা মৃদুমন্দ হাওয়া তাদের প্রান জুড়িয়ে দিয়ে গেলো। অনুসরণ করা হলো হাওয়ার পথ, হাতুরী -ছেনী দিয়ে স্টালাকাইট পাথর কেটে কেটে। যদি একটা গুহা মতোন কিছু খুঁজে পাওয়া যায়, যে জন্যে তাদের এখানে আসা। পাওয়াও গেলো, সময় যেখানে থেমে গেছে তেমন একটা গুহা।
বহু শাখা-প্রশাখা বেরিয়েছে গুহাটি থেকে। প্রথমে গুহার পথ ধরে যেতে যেতে দেয়ালে লাল গেরুয়া রংয়ের দু’একটা ছোপছাপ দেখে যতোটা না অবাক হলেন তারও চেয়ে বেশি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন ভেতরে ঢুকে। সামনের দেয়ালে গেরুয়া রংয়ে আঁকা একটা প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথ যেন পথ আগলে দাঁড়িয়েছে তাদের। বৈচিত্রময় শত শত চিত্র আর খোদাই রয়েছে গুহাটির সারা দেয়াল জুড়ে। পরে জানা গেলো, ওসব চিত্র আর খোদাই সবই হাযার হাযার বছর আগের - প্রাগৈতিহাসিক ।
জীন মেরি শ্যোভের নামটিও সেই সাথে খোদিত হয়ে গেলো গুহাটির সাথে।

তাহলে শ্যোভে গুহার ঐসব চিত্র কি গুহামানবের প্রথম আঁকা ছবি!
ইতিহাস বলে, না! খ্রিষ্টপূর্ব ২ লক্ষ বছর আগে যখন সভ্য মানুষের উদয় হয়েছিলে আফ্রিকার সাব-সাহারান (sub-Saharan) এলাকায় তারও ১ লক্ষ ৩০ হাযার বছর পরে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ হাযার বছর আগেই দক্ষিন আফ্রিকার কেপটাউনের ৩০০ কিলোমিটার পূবের বর্তমানের “ব্লমবোস( Blombos ) প্রাইভেট নেচার রিজার্ভ” এলাকার গুহায় আদিম সভ্য মানুষ রেখে গেছে তার প্রথম শিল্পী মনের স্বাক্ষর, যখন “অক্ষর” কি জানতোনা সে, জানতোনা লিখতে হয় কি করে!


আসলে আর্কিওলোজিষ্ট আর পেলিওএ্যানথ্রোপলোজিষ্টদেরও জানা নেই ঠিক কোথায়, কখন আধুনিক মানুষেরা শিল্প সৃষ্টির প্রথম সূচনাটি করেছিলেন! কেনই বা করেছিলেন!
এই সব শিল্পকর্মগুলি মূলত জন্তু-জানোয়ারদের নিয়েই চিত্রিত হলেও মাঝে মাঝেই সেখানে মানুষের আকৃতিও দেখা গেছে। দেখা গেছে মানুষের হাতের ছাপ, অর্থবিহীন বিভিন্ন ধরনের প্রতীক কিম্বা কোন কিছুর খোদাই। এসবের অর্থ আর্কিওলোজিষ্ট আর পেলিওএ্যানথ্রোপলোজিষ্টদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। এই শিল্পকর্মগুলি তাদের কাছে কম বোধগম্য হলেও প্রাগৈতিহাসিক এইসব গুহাচিত্রকেই পৃথিবীর প্রথম সৃষ্ট চিত্র বলেই তারা ধরে নিয়েছেন।

কেন এসব শিল্পকর্মের অর্থ বা উদ্দেশ্য আর্কিওলোজিষ্ট এবং শিল্প ইতিহাসবিদদের কাছে অধরা বা তারা কেন এসব ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন না ?
প্রাগৈতিহাসিক,কালের এইসব নিরক্ষর সমাজের লিখিত কোনও দলিল না থাকা, সে সময়কালের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ অজানা থাকা , তুলনা করার মতো অন্যান্য শিল্প নিদর্শনের অপ্রতুলতা বা দুষ্প্রাপ্যতাই এমন না বোঝার কারন হয়ে থাকবে।
তবুও ধরে নেয়া যায়, যেহেতু আদিম মানুষকে হিংস্র প্রানীদের হাত থেকে নিজেকে যেমন রক্ষা করতে হতো তেমনি আবার বল-বীর্য্যের পরিচয় দিয়ে সেইসব পশু শিকার করে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতেও হতো। এবং প্রয়োজনের খাতিরে বা কষ্টসাধ্য শিকার করার মতো সময়-সুযোগ-শিকার প্রাপ্যতা ও যোগ্যতা ততোটা না থা্কার কারনে একসময় পশু পালন তাদের জন্যে অপরিহার্য্য হয়েও উঠে ছিলো। যখন তাদের অন্য কোনও সামাজিক -ধর্মীয় আচার-আচরনের তথ্য আমাদের কাছে নেই তাই অনুমান করতে অসুবিধে হয়না যে, জীবন ধারনের জন্য পশু সংক্রান্ত সবকিছু আদিম মানুষের চিন্তা চেতনার সবটা জুড়েই ছিলো এবং থাকাটাই স্বাভাবিক । হয়তো নিজেদের জীবনযুদ্ধের এসব চালচিত্র তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে আবাসস্থলের দেয়ালে দেয়ালে এসবের স্বাক্ষর রেখে যেতে।

আবেগ প্রকাশের জন্মগত চরিত্রের কারনেই মানুষের অভিজ্ঞতার এমন ঐতিহাসিক উপাদানটি থেকেই হয়তো প্রথম শিল্পের সৃষ্টি। এবং এই অনুশীলন এবং বিশ্বাস কালক্রমে আদিম মানুষের সামাজিক বা ধর্মীয় আচার-আচরন হিসেবেই প্রজন্মের পর প্রজন্মে ধাবিত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষ তার এই শিল্প সৃষ্টিকে নতুন নতুন আঙ্গিকে উদ্ভাবন করেছে। ইতিহাস জুড়ে তার ধারাবাহিকতাই যেন আমরা দেখতে পাই।
এইসব শিল্পকর্মের সবটাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন গুহাগুলিতে। কেবলমাত্র ফ্রান্স এবং ইতালিতেই আছে ৪০০টির মতো গুহা। এশিয়া মহাদেশে আছে ৩০০টির উপরে। এদের সবগুলোতেই যে গুহাচিত্র রয়েছে এমনটা নয়।
আর আমিও যে, শিল্প কোথা থেকে এসেছে এসবের তথ্য-তালাশ দিতে বসেছি তা কিন্তু নয়! নিজের ভালো লাগা থেকে হাযারো গুহাচিত্রের থেকে কিছু কিছু তুলে ধরা ও বলার বাসনা নিয়েই এই ছবি ব্লগটি তৈরীতে বসেছি।





বাইসনের এই ছবিটি এতো নিখুঁত যে ১৯শতকের বিদগ্ধ সমাজ এই গুহার আবিষ্কারক ও নিরীক্ষক “মার্সেলিনো স্যানজ ডি সাউতুওলা”কে জালিয়াত বলতেও দ্বিধা করেন নি। মানুষ বিশ্বাসই করতে চাইতোনা যে, প্রাগৈতিহাসিক মানুষের এমন বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা থাকার কথা নয় যে, তারা এমন একটি ছবি আঁকতে পারে! বিংশ শতকের প্রথম দিকে এসে আর্কিওলোজিষ্টরা জানালেন - এসব আসলেই ৩৬,০০০ বছর আগের আদিম মানুষের আঁকা গুহাচিত্র।

এইসব গুহাচিত্রে আপনি চমৎকার ভাবে স্টেনসিল করা অসংখ্য সব হাতের ছবিও দেখতে পাবেন । কেন হাতের ছবি, নিজেদের মুখের ছবি নয় কেন ? এসবের একটা সম্ভাব্য উত্তর দিয়েছেন পেলিওএ্যানথ্রোপলোজিষ্টরা। বলেছেন - যারা যারা এঁকেছেন, সেটা যে তাদেরই আঁকা ; এমন একটা পরিচিতি স্বাক্ষর তারা হাতের স্টেনসিল করেই দিয়েছেন অক্ষর জ্ঞান না থাকার কারনে। যেমন এখানটায় -

অথবা হতে পারে , গুহার দেয়ালে হাতের স্পর্শ মেখে তারা একটি আত্মিক যোগাযোগের অনুভূতি পেতে চেষ্টা করতেন। কিম্বা হতে পারে এসব কোনও সামাজিক আচার-আচরণ, দিক্ষা গ্রহন বা ধর্মীয় আচারের উদ্দেশ্যে আঁকা । যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন গুহাতে ৪০,০০০বছর আগের আঁকা এইসব হাতের ছবির ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ষ্টেনসিলড হাতের শিল্পকর্ম। সবগুলিই যেহেতু বাম হাতের ছবি তাই শিল্প ঐতিহাসিকদের ধারনা বাম হাত গুহার দেয়ালে রেখে, ডান হাতে কোন বিশেষ ধরনের পাইপ দিয়ে স্প্রে করে এগুলো আঁকা হয়েছে। এটা কি কোনও সামাজিক আচার-আচরণের ছবি ?




এতোক্ষন তো গেলো অনুর্ধ ৭০,০০০ বছর আগের গুহাচিত্রের কাহিনী যার বেশীর ভাগটার শিল্পীরাই হচ্ছেন সম্ভবত “নিয়ানডার্থাল” মানুষেরা। আগেই তো বলে রেখেছি, শিল্প কোথা থেকে এসেছে এসবের তথ্য-তালাশ দিতে এ লেখা নয়। লেখাটি এটাই বোঝাতে যে, সভ্য মানুষেরাই (হোমো সেপিয়েন্স) শুধু শিল্পের প্রবক্তা নন। ৪০,০০০ বছর আগেও “নিয়ান্ডার্থাল” মানুষেরা হোমো সেপিয়েন্সদের পাশাপাশিই ছিলো। আবেগ প্রকাশের জন্মগত চরিত্র শুধু আধুনিক মানুষদেরই ছিলোনা, ছিলো তাদেরও!
শেষমেশ বলি -
শিল্পানুভূতির প্রকাশক কিছুকেও যদি শিল্প বলে ধরে নেয়া হয় তবে ভারতের মধ্য প্রদেশের “ভীমবেতকা” গুহার “পেট্রোগ্লিফস” (petroglyph) কে সবচেয়ে পুরোনো শিল্পকর্মের তকমাটি দিতেই হবে।
“পেট্রোগ্লিফস” যদিও পাথর খুঁচে খুঁচে, আঁচড় কেটে, খোদাই করে, ছেঁচে ছেঁচে তোলা কোন আকৃতি/চিত্রকে বোঝায় তবে গুহা-শিল্পবোদ্ধারা ভীমবেতকার এসব ছবিকে পেট্রোগ্লিফস বলতে নারাজ। তারা এটাকে বলতে চান “পিকটোগ্রাফ” (Pictographs) কারন এখানের শিল্পকর্মগুলো প্রতীক বা চিহ্ণের ধারক, সে অর্থে ছবি বা চিত্র নয়। পেট্রোগ্লিফস হোক বা পিকটোগ্রাফই হোক সম্ভবত ভীমবেতকা শিল্পকর্মগুলো এ পর্য্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন যা খোদাই করা হয়েছে খ্রীষ্টপূর্ব ৭ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ ৯০ হাযার বছর আগের সময়কালের ভেতরে।



( বাইসন ?) তাড়া খাওয়া অসহায় মানুষ নামের প্রানী।
সূত্র ও কৃতজ্ঞতা-
MAIN A-Z INDEX - A-Z of PREHISTORIC ART
https://headstuff.org/culture/history/origin-worlds-art-prehistoric-cave-painting/
https://www.ancient.eu/Chauvet_Cave/
http://www.visual-arts-cork.com/prehistoric/hand-stencils-rock-art.htm
Click This Link
https://www.heritagedaily.com/2020/03/10-prehistoric-cave-paintings/126971
https://www.bradshawfoundation.com/news/cave_art_paintings.php?id=The-Secrets-of-Prehistoric-Hand-Paintings
https://en.wikipedia.org/wiki/Cave_of_Altamira
https://mymodernmet.com/altamira-cave-paintings/

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


