প্রায় একাকীই, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির পর্বতসম পথ জয়ে হাটছেন এক নিঃসঙ্গ শেরপা।
অথচ আজ তের দিন হয়ে গেলো, পর্বত শিখরের পথ জয় হয়নি তার। দৃশ্যত তেমন কেউ তার পেছনে নেই যারা তাকে যোগাবেন অমিত সাহস, পায়ে এনে দেবেন অনতিক্রম্য পাথুরে পথে চলার শক্তি, পাশে এসে স্বশরীরে এককাতারে দাঁড়িয়ে পর্বতের পাদদেশ কাঁপিয়ে দেবেন!
কমলাপুর রেল ষ্টেশনে যারাও এসেছিলেন তাদেরও কাছে ঘেসতে দেয়নি অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির ধারকরা, তল্পিবাহকেরা। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে ঢুকতে দেয়া হয়নি অবস্থান কর্মসূচি পালনের ইচ্ছে নিয়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের । এ নিয়ে দ্বিতীয়বার শিক্ষার্থীরা বাঁধার মুখে পড়লেন। গাজীপুরের একটি কলেজ থেকে আন্দোলনে একাত্মতা জানাতে আসা একদল শিক্ষার্থীকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি কমলাপুর রেলষ্টেশনে। স্টেশনের পাশেই নিঃসঙ্গ সেই শেরপার সাথে তাদের দেখা করতে হয়েছে। অনেকেই এসে জানিয়েছেন সংহতি। চুয়াডাঙ্গা, জামালপুরে হাতে গোনা কিছু ছাত্রকে দেখা গেছে প্রতিবাদের স্বপক্ষে।
কিন্তু দূর্বার প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্যে মানুষকে স্বশরীরে জড় হতে দেখা যায়নি, যে যুদ্ধ মূলতঃ তাদের স্বার্থের জন্যেই।
ছবি - নিঃসঙ্গ শেরপা । কৃতজ্ঞতা - দেশ টিভি
আজ বারো / তেরটি দিন ধরে একাকী প্রতিবাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি। আগেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের আধুনিকায়নের দাবিতে অনশন করেছিলেন। ফল কি হয়েছিলো জানিনে কিন্তু এটা জেনেছি, বুকে অদম্য সাহস আর শুভপ্রত্যয় থাকলে একাই একশো হতে পারা যায়!
“জনগনই ক্ষমতার উৎস” বলে যারা গলা ফাঁটান, সেই সব সুবোধদের দেখাও মেলেনি । সামান্য নড়েচড়ে বসার আলামতটিও দেখান নি কেউ। প্রতিবাদকারীকে ভয় দেখানো, হুমকি দেয়ায় যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তা নিয়ে মানবতাবাদীদের “মানবাধিকার লঙ্ঘিত” আওয়াজ কোথায় ? অপরাধীদের বেলায় “মানবাধিকার লঙ্ঘিত” হয়েছে চীৎকারে আকাশ-পাতাল এক করে ফেলা সেই মানবতাবাদীরা এখন কোথায় মুখ লুকিয়ে আছেন ?
কি বিচিত্র এই দেশ!
অথচ মহিউদ্দিন রনি কিন্তু লাখো রেলযাত্রীর স্বার্থে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনঢ় তার প্রতিবাদে। দাবী খুব এমন কিছু নয় যে, তা মানতে গেলে দেশ রসাতলে যাবে, ধ্বংশ হয়ে যাবে, উন্নয়ন থেমে থাকবে!
দাবী তার সামান্যই - ১) অনলাইনে টিকিট কেনায় হয়রানি বন্ধ করে তদন্ত করতে হবে, হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, টিকিট কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে,২) অনলাইন-অফলাইনে টিকিট কেনার ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে,৩) ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে,৪) ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক, তত্ত্বাবধায়কসহ অন্য দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ড সার্বক্ষণিক মনিটর করতে হবে,৫) শক্তিশালী তথ্য সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে রেলসেবার মান বাড়াতে হবে এবং ৬) ট্রেনে ন্যায্য দামে খাবার, বিনা মূল্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন-ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
খুব বেশী এবং অপুরণীয়-অন্যায্য দাবী কি ?
যে রাষ্ট্র জনগণের পয়সায় চলে, সে রাষ্ট্র কি করে জনগণের এই সামান্য দাবীটুকু পুরনেও অপারগ হয়, অনীহা দেখাতে পারে ??
তবে কি রাষ্ট্র, শিষ্টের পালনের বদলে দুষ্টের লালনে বদ্ধপরিকর??? রেলওয়ে কি সরকারের ভেতরে আর একটি সরকার ????
নইলে এতোদিনেও তারা ব্যাপারটির সুরাহার জন্যে একটু হলেও মুখ কেন খোলেন নি ? ভোক্তা অধিদপ্তরই বা কেন দীর্ঘসূত্রিতা করলেন বিষয়টি আমলে নিতে? উল্টো, রেলওয়ে পুলিশ, অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রেলের কর্মী দিয়ে প্রতিবাদমুখর একাকী এক যোদ্ধাকে হেনস্তারও শিকার করেছেন । মামলার ভয়ও দেখাচ্ছেন। মিথ্যা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। রেলের টিকিট কালোবাজারীরা তাকে হুমকি দিয়েছে অথচ রেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ। এতে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, রেলের টিকিট কালোবাজারী, টিকিট অব্যবস্থাপনাকারীদের সাথে রেল কর্তৃপক্ষের গাঁটছড়া বাঁধা আছে।
রেল মন্ত্রনালয় কি রেলের এসব অসংগতির, যাত্রী হয়রানির কথা জানেনই না ? কমপক্ষে বছরে দু-দু’বার ঈদের সময় বিশদ করে এসবের চিত্র প্রত্যেকটি খবরের কাগজেই ছাপা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে!
আসলে, চোখ না থাকলেই অন্ধ হয়না, অন্ধ হয় যখন দৃষ্টিতে কিছু ধরা পড়েনা।
ছবি - https://shampratikdeshkal.com/print/220784324
এক হাতে প্ল্যাকার্ড, অন্য হাতে একটি শিকলের এক প্রান্ত ধরা। শিকলের অন্য প্রান্ত আরেকজনের গলায় জড়ানো। এমন ছবির মতো আরও আরো “রনি” চাই আমাদের । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভার্চুয়াল ঝড় তুলে কি লাভ যদি সে ঝড় সত্যি হয়ে পথ-প্রান্তরে আছড়ে না পড়ে ? স্বশরীরে পথে নেমে সব অন্যায়ের -অন্যায্যতার -অসংগতির -অব্যবস্থাপনার বিরূদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর মতো “ রনি” কি আর নেই ?
অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ পরিচালন ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও যে দেশটাকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবার প্রধান একটি উপায়, সে কথা কি সরকার জানেন না ? জানেন তো বটেই শুধু করে উঠতে পারেন না সব ধরনের সিন্ডিকেটবাদীদের ভয়ে। এতোই যদি ভয় তবে “ রনি” র মতো নিঃসঙ্গ শেরপাদের পাশে দাড়াঁক সরকার, মুখ আটকে শেকল না পরিয়ে আরও আরও “ রনি” দের জন্মের পথ করে দিক যাতে অন্যায়ের -অন্যায্যতার -অসংগতির -অব্যবস্থাপনার সিন্ডিকেটধারীদের বুক কেঁপে ওঠে, ভিত নড়ে যায়।
স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে; স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরনের প্রত্যাশা, মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। এমন করে না ঘুমিয়ে থাকলে হয়তো সরকারের “ সোনার বাংলা” গড়ার স্বপ্ন সফল হলেও হতে পারে..................
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০২২ রাত ৯:৪৪