শুরুতেই ভাগ্যটাকে কষে একটা গাল দিলুম। পনের ঘন্টার একটানা আকাশ ভ্রমন, কোথায় ডানাকাটা পরীদের মুখ দেখতে দেখতে যাবো তা নয়, এতোখানি পথ যেতে হবে আধবুড়ো-বুড়ি কেবিনক্রুদের মুখ দেখে ! প্রায় সব মানুষকেই বলতে শুনি, বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে এমনকি আকাশ পথেও তারা সহযাত্রী হিসেবে নাকি সুন্দরীদের দেখা পেয়ে থাকেন! আফসোস- আমার ভাগ্যে কখনও তেমনটা ঘটেনি। আজও ঘটলোনা।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সিডনীগামী ফ্লাইটে উঠতেই দু’জন আধ-বুড়ি কেবিনক্রু যখন স্বাগত জানালো, বুঝলুম এই মহা-বেকুবের ভাগ্যে তো এমনটাই হবার কথা! জানা ছিলো, আজকাল আমেরিকান তরুন-তরুনীরা নাকি এসব কেবিনক্রুর মতো একঘেয়ে চাকরীতে আসতে মোটেও উৎসাহী নয়। তো সে যাক…. এমন কপাল নিয়েই সঙ্গিনী সহ নিজেদের সীটে বসে পড়লুম। নন-ষ্টপ পনের ঘন্টার উড়াল পথ – প্রায় সবটাই পানির উপর দিয়ে। মাটির দেখা মিলবেনা সিডনীর আকাশে না ঢোকার আগে। যাত্রাপথটা কেমন হবে সেটা বুঝতে সামনের মনিটর অন করে সানফ্রানসিসকো টু সিডনী রুটের ম্যাপটা বের করলুম, সবটা পথই প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে।
চিত্র- ১) যাত্রাপথ - SFO টু SYD…….
বুঝলুম, ছোট্টবেলা যেমন সাঁতরে পুকুরের এপাড়-ওপাড় করেছি এখন এই বুড়োকালে মহাসাগরের এপাড় ওপাড় করতে হবে উড়াল দিয়ে ! এই মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বয়েসটা একদিন বেড়ে যাবে এই দুঃখতেই চোখ বোজার এন্তেজামে লেগে গেলুম। কারন, আমরা উড়াল দিয়েছি ২০শে এপ্রিল’ শনিবার রাত ১১টায় আর সিডনীর মাটিতে পা রাখবো সেই ২২শে এপ্রিল’ সোমবার সকাল ৭টায়। মাত্র ১৫ ঘন্টা যাত্রাপথে ক্যালেন্ডার থেকে একটি দিন হাপিস হয়ে যাবে! তো ৩৫হাযার ফুট উপর দিয়ে প্রায় সাড়ে ৫’শ মাইল বেগে উড়তে থাকা প্লেনের পেটের ভেতরে আর যখন কিছু করার থাকলোনা তখন ঘুমের কসরত করতে করতে আর মনিটরে ছবি আর ফাঁকে ফাঁকে যাত্রাপথে প্লেনের হাল হকিকত দেখতে থাকলুম!
চিত্র- ২) যাত্রার তথ্যপঞ্জী।
তো একদিন বেশী বয়েস নিয়ে যখন সিডনী এয়ারপোর্টে নামলুম তখন ছোট ভাই আর বোনকে দেখে প্রানটা জুরিয়ে গেলো যেন! বেশ কয়েক বছর পরে ওদের সাথে দেখা।বাসার পথে আসতে আসতে কি করবে আমাদের নিয়ে, তার ফর্দ বানিয়ে যাচ্ছিলো দু’জনেই। একদম ছোট ভাইটা গোল্ডকোষ্ট থেকে তার ক্লিনিকের কাজ-কাম ফেলে উড়ে এলো বেলা সেদিনই ১১টায়। ঘরে বসে তিন ভাই-বোন মিলে পারলে দ্বীপ মহাদেশটার চারপাশের হাযার দশেক সী-বীচে আমাদের এখনই সান-বাথ করিয়ে আনে, এমন প্লানে তুমুল তর্ক-বিতর্কে মেতে উঠলো। এ বলে আগে ঐখানে, তো আরেক জন বলে- আগে সেইখানে না গেলে তো অষ্ট্রেলিয়া বেড়াতে আসাটাই বৃথা!
বললুম – ভাইয়ু আর বহেনারা শোন্, একসময় ঢাকা শহরে বেড়াতে এসে কেউ গুলিস্থানের মীর-জুমলার কামান দেখে নাই শুনলে তার জীবনটাই বৃথা বলে মনে করা হতো। এখন অষ্ট্রেলিয়া এসে সিডনী হারবার আর সেখানে থাকা বিশ্বখ্যাত অপেরা হাউসটি না দেখলে তো জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে! ওটা দিয়েই শুরু হোক।
সমস্বরে তারা চেচিয়ে উঠলো- না না….. ভাবী যেটা বলবে সেটাই আগে। ভাবী মানে আমার গিন্নী, তাদের কাছে আমার চেয়েও বেশী আপন সব সময়ই। এখানে আসার অনেক আগে থাকতেই অষ্ট্রেলিয়া ভ্রমন সংক্রান্ত যতো কথা তার সাথেই। আমি সেখানে ফালতু। অবশ্য ভাবী-ননদ-দেবরদের এই রসায়ন আমাদের বিয়ের পর থেকেই। আমি যদি থাকি তাদের ঘরের দেয়ালের বাইরে তবে গিন্নী থাকেন তাদের ঘরের খাস অন্দমহলে, এমনটাই তার জায়গা আমাদের পরিবারে। তো যাক- যে গিন্নী আমার সব কথায় ভেটো দিয়ে থাকেন সব সময় , সেই গিন্নী খোদার কোন কেরামতিতে যে এবার আমার মতে মত দিলেন কে জানে! ঠিক হলো, সন্ধ্যার আলো ঝলমল হারবার আর অপেরা হাউসটি দেখতে যাওয়া হবে। দু’টো গাড়ী লাগবে। গাড়ী কোনও সমস্যা নয়, সমস্যা হলো হারবার এলাকায় পার্কিং পাওয়া নিয়ে। পার্কিং পাওয়া গেলেও এতো দূর হবে যে হাটতে হবে অনেক পথ। আমার গিন্নীর আবার হাটুতে ব্যথা। তার দিকটা প্রাধান্য দিয়ে ঠিক হলো ট্রেনে যাওয়া হবে। তাহলে হারবার এলাকার একেবারে পেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যাবে আর আমার ভাই-বোনদের প্রিয় ভাবীজিকে বেশী হাটতে হবেনা। তাই বাসার কাছের ক্যাম্পবেলটাউন রেল ষ্টেশনের লাগোয়া পার্কিংয়ে গাড়ী রেখে ট্রেনে যাত্রা শুরু ………
চিত্র- ৩) বাসার কাছের ক্যাম্পবেলটাউন রেলষ্টেশন ।
ছিমছাম, ভিড় বিহীন ষ্টেশন। চমৎকার পরিচ্ছন্ন ট্রেন। কয়েকদিনে যা দেখলুম, সব মিলিয়ে ট্রেনের সীট সংখ্যার পাঁচ/ছয় ভাগের একভাগ যাত্রীও থাকে না। অথচ প্রতি ১০/১৫ মিনিট পরপর অসংখ্য ট্রেন চলছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এদের কি কোনও লোকসান হয়না ???
চিত্র- ৪) প্রায় যাত্রীশূন্য ট্রেনের কামরা।
এই ট্রেন জার্নিটা আমরা খুব উপভোগ করেছি । হাতপা ছড়িয়ে সব কিছু দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। তাই সিডনীতে ঘোরার বেশীর ভাগ সময়টাতেই আমরা ট্রেন ব্যবহার করেছি। ইচ্ছে হলে কোনও এক ষ্টেশনে নেমে গেছি। ভয় ছিলোনা কারন ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই আবার ঘরে ফেরার ট্রেন পাওয়া যাচ্ছিলো।
চিত্র- ৫) “সার্কুলার কিউ” ট্রেন ষ্টেশন থেকে সিডনী হারবারের দৃশ্য।
চিত্র- ৬) সন্ধ্যার সিডনী হারবার ব্রীজ।
চিত্র- ৭) পাশ থেকে রাতের সিডনী অপেরা হাউস।
চিত্র- ৮) রাতের সিডনী অপেরা হাউসের সামনের চত্বর।
কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পুরো এলাকা। মানুষে মানুষে সয়লাব কিন্তু কোথাও হৈ-হট্টগোল নেই, যেখানে সেখানে নোংরা নেই। রাতের আলোকে অপেরা হাউসটাকে অপূর্ব লাগছিলো। এতোদিন শুধু ছবিতেই দেখেছি , এখন দিব্য চর্মচক্ষুতে দেখলুম।
চিত্র- ৯) অপেরা হাউসের দিকে পর্যটকদের আনাগোনা।
পরের দিনটাতে দলেবলে গেলুম ম্যানলী বীচ ঘুরতে্। আবার ট্রেনে করে যেতে হলো সেই হারবার এলাকায় । সেখান থেকে ফেরীতে করে ম্যানলী বীচে যাওয়া। ঝকঝকে রোদ আর বাতাসের ঝাপটা গায়ে মেখে সুন্দর একটি যাত্রার গল্প ।
চিত্র- ১০) ম্যানলী বীচের উদ্দেশ্যে ফেরীতে সিডনী হারবার ছেড়ে যাওয়া।
চিত্র- ১১) ফেরীর উন্মুক্ত টপ ডেকে দাঁড়িয়ে……
চিত্র- ১২) মোবাইলের ক্যামেরায় ধরা পড়া নীল জলের ওধারে নান্দনিক সিডনী অপেরা হাউস।
সুন্দর ছিমছাম ফেরী। প্রচুর পর্যটক, আমাদের একই যাত্রাপথের সঙ্গী। দলের লোকজন দারুন খোশগল্পে মেতে আছে আর ছবি তুলছে, ভিডিও করছে ইচ্ছে মতোন।
চিত্র- ১৩) ফেরীতে দলের লোকজন- ছোটভাই, স্ব্রী, বোন আর ভাগ্নে বউ।
চিত্র- ১৪) প্রায় ৩০/৪০ মিনিট প্রশান্ত মহাসাগরের জলে ঢেউ তুলে অবশেষে ম্যানলী বীচের ফেরী ঘাটে……
চিত্র- ১৫) মোবাইলের প্যানোরোমা ভিউতে তোলা ম্যানলী বীচের দৃশ্য।
ম্যানলী বীচের একটি রেস্তোরায় দুপুরের খাবার খেয়ে আবার প্রশান্ত মহাসাগরের জলে ঢেউ তুলে ফিরে আসা সিডনী হারবার ষ্টেশনে। হাতে অনেক সময়। ঘুরতে যখন এসেছি তখন ঘোরাটাই মোক্ষ ! যাই কই ? চলো ….. চলো ….. কাছেই হাইডপার্ক। ওখানটাতেই যাওয়া যাক –
পার্কে ঢুকতেই হাতের বা-দিকে অনেকটা চত্বর জুড়ে একটি দাবার কোর্ট সাজানো। লোকজন প্রায় দুই হাত সাইজের লম্বা দাবার ঘুটি দু'হাতে তুলে নিয়ে হেটে হেটে খেলছে। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে গিন্নী ভিড়ে গেল সেই দলে- খেলায়। আমি গেলুম সামনে কিছুটা দূরে গোলাকার চত্বরের মাঝখানে থাকা মূল আকর্ষন ফোয়ারাটির কাছে যেখানে তিনদিকে সাজানো আছে বিভিন্ন ভঙ্গিমার কালো রঙয়ের পৌরানিক সব ষ্ট্যাচু।
চিত্র- ১৬) হাইড পার্কের মূল আকর্ষন…………..
চিত্র- ১৭) প্রায় ১০০বছর আগে তৈরী হওয়া হাইড পার্কের স্মারক শিলা খন্ড ।
শেষ বিকেলের আলোতে পাতা্ওয়ালা প্রচুর বড় বড় ঝাকড়া গাছের ছায়া আর তার ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে আসা আলোতে গল্পের মতো লাগছিলো পার্কের পরিবেশ। ডাকার আগেই গিন্নী চলে এলো দাবা খেলা ছেড়ে তার সাথের দলবল নিয়ে। তার পরে ফোয়ারা থেকে ছিটকে আসা পানিতে ভিজে তাদের ছবি তোলার হিড়িক।
চিত্র- ১৮) পরে অষ্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসার আগের দিন সিডনী টাওয়ার থেকে তোলা হাইড পার্কের দৃশ্য……..
চিত্র- ১৯) পার্ক লাগোয়া সেন্ট জেমস রেল ষ্টেশনের প্রবেশ/বেরুনোর পথ।
এখান থেকেই আজকের মতো ঘরে ফেরার ফিরতি ট্রেন ধরা…………….
চলবে ----------
ছবি - নিজের মোবাইলে তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২৪ ভোর ৬:২২