আমাদের দেশে আসন্ন করোনা টিকা সংকটের মূল কুশীলব ভারতের টিকা উৎপাদনকারী সেরাম;অনুঘটক সরকারের নিস্ক্রিয়তা এবং যথাসময়ে উদ্যোগহীনতা। জড়িত পক্ষগুলোর রাজনৈতিক, কৌশলগত বা অর্থনৈতিক অভিসন্ধির সম্মিলিত চাপ অনেক বড় হয়ে বিভ্রান্ত করছে সাধারন জনগনকে। গতকাল টিকা প্রাপ্তি ও আমদানি নিশ্চিত করতে অতিউৎসাহী সরকারি কমিটির সভার আলোচনা বিষয়ে লিখেছিলাম। (Click This Link) এত তাড়াতাড়ি আবার লিখবো তা ভাবনায় আসে নি।
ঢিলেমি বা অযোগ্যতা ঢাকতে অজুহাত বা খোঁড়া যুক্তির সমারোহ সরকারের কাছে অপ্রত্যাশিত নয় কিন্তু দুঃখজনক হলেও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এই পরিপক্কতার পীড়াদায়ক অভাব আমাদের অসহায়ত্বকে উপহাস করছে। গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবাদপত্রে যেভাবে সেরাম-বেক্সিমকোর যোগাযোগের সর্বশেষ অবস্থার বরাত দিয়ে টিকা সরবরাহে সেরামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অ আন্তরিকতা বারবার নিশ্চিত করছিলো তাতে আমরা আশা করছিলাম সরকারি উদ্যোগ; নিতান্ত হলেও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য যা আমাদের আশ্বস্ত করতে পারতো। চলমান অচলাবস্থায় সরকারের নিস্ক্রিয়তা আমাদের অবাক হবার মাত্রাতে নতুন রেকর্ড গড়ছে সময়ের যেকোনো একক ব্যবধানে। এদিকে ২৪ ঘন্টায় যেন ইউটার্ন নিলো সেরামের আশা জাগানিয়া তৎপরতা। কিভাবে? তার আঁচ পাওয়া গেলো পাপন সাহেবের অধিকার-অনধিকারের বয়ানে। গতকালের ইত্তেফাকে ছাপা রিপোর্টের একটি অংশ খেয়াল করিঃ ‘টিকা চেয়ে ভারতের উত্পাদক প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐ বেসরকারি কোম্পানিটি যোগাযোগ করলে তারা বলেছে, আমরা টিকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এটা এখন ভারত সরকারের বিষয়। তাদের ভ্যাকসিন প্রস্তুত আছে। ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স পেলেই তারা আমাদের দিতে পারে।’ পাপনের গলায়ও একই সুরে একই গান - ‘আরো ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি রেখেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। এ জন্য ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অনুমতি এখনো পাওয়া যায়নি। ঐ মন্ত্রণালয় ছাড়পত্র দিলেই তারা করোনার টিকা পাঠিয়ে দিতে পারবে।’ সেরামের এহেন সৎ আত্মপক্ষ সমর্থন এবং তার সাফাই গাওয়া পাপন কেন এখন নেচে-কুঁদে জেরবার! কেন হুংকার ছাড়লেন - ‘টাকা দিয়েছি, টিকা আটকানোর অধিকার সেরামের নেই’ বলে? গতকাল পর্যন্ত অভিযোগ ছিলো ভারত সরকারের প্রতি। আর আজ সেরামকে বলা হলো আসল কালপ্রিট! তবে কি আমাদেরকে এসব ঘটনার সত্যাসত্য নিয়ে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে? এ নিয়ে হম্বিতম্বি করার সুযোগ আছে কিন্তু তা এই মুহূর্তে সংকট নিরসনের গুরুত্ব বিবেচনায় অর্থহীনভাবে নিস্প্রয়োজন। ব্যাপারটাতো আর নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে মাশরাফি-তামিমদের চাহিবামাত্র বেতন বৃদ্ধি নয়!
সেরাম তাদের দায় ভারত সরকারের উপর বর্তাচ্ছে আর ভারত সরকারের তরফ থেকে হ্যাঁ-না কোনো সংকেতই পাওয়া যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেরাম কূটচালের খেলোয়াড় এবং তারা বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা মেটাতে আপাতত অনিচ্ছুক অন্তত জুন-জুলাইয়ের আগে নয়। বিশিষ্ট বেনিয়াধিপতি পাপনকে সাধুবাদ জানাই সেরাম চরিত্র দেরিতে হলেও বুঝতে পারার জন্য। তবে এখানে প্রশ্ন আসে পাপন পীরের গত পরশুর বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘এপ্রিল-মে মাসে টিকা নিয়ে একটু ঝামেলা হবে। জুন মাস থেকে কোনো সমস্যা হবে না।’ তার মানে পাপন গং সেরামের কাছ থেকে যে জবাব পাচ্ছে তাতে সেরামের তরফ থেকে কোনো গোমর নেই।
হাতে গুনে তিনদিন হলো পাপন ইনিয়ে বিনিয়ে সেরাম থেকে টিকা আমদানি সংকট নিরসনে নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে মধ্যস্থতাকারির জোরালো ভুমিকা নিতে অনুনয় করছেন। এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে দরবেশ বাবার টিম বেক্সিমকো ফার্মার ক্যাপ্টেন পাপনের আর্জি সরকার আমলে নিচ্ছে না কেন? সরকার যে টিকা হাহাকারের এই পরিস্থিতিতে বেকার বসে আছে এমন নয়। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি সুবিধার নয় তা আঁচ করে উত্তরে আর পশ্চিমে টিকা সংগ্রহের ব্যাপক চেষ্টা শুরু হয়েছে। তাদের নেপথ্য অঙ্গুলি হেলনে প্রশাসন-কূটনীতিবিদরা এখন এতোটাই তৎপর যে ভূলোকের সর্বকোণ-সর্বদিক থেকে সন্দেশ আসছে টিকা পাওয়ার। এ বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তার আভাস জানা না গেলেও আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে টিকার বানে যে আমরা ভাসবো তার লক্ষণ কেয়ামতের মতো স্পষ্ট। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের নির্ঘুম-ঘোরকাটা কূটনীতিকদের আহবানে সাড়া দিতে মরিয়া রুশ-চৈনিক-মার্কিন প্রশাসন তাদের রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে বাংলাদেশের টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে একঘাটে কেবল জল খাচ্ছেই না যেন গেটোরেট আর আদাজলের কনকোকশন খেয়ে পুরাই অস্থির!!
কিন্তু এতো ডামাডোলের মধ্যেও ভারতের সাথে যোগাযোগে মুখে এখনও কুলূপ এঁটে বসে আছে আমাদের সরকার। এই অযথা সময় ক্ষেপন কিসের আলামত? প্রাপ্য টিকার হিস্যা আদায়ে ভারতের কাছে অনুনয়-আর্জি পেশ কিংবা চাপ সৃষ্টি সময়ের দাবী। সরকারের টনক নড়ে কি নড়ে না তা আমাদের সাধারন বোধের ঊর্ধ্বে। তাই সম্বিত ফিরে পাওয়া সরকারের কাছ থেকে আমরা আশ্বাস চাই। হোক না তা ভোট পাওয়ার জন্য দেয়া প্রতিশ্রুতির মতো মিথ্যার ফুলঝুরি! করোনা মোকাবিলায় অসহায় জনগণ ধৈর্য নিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছি।
ছবিঃ ইয়াহু নিউজ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২০