"দুই টাকা?"
অবজ্ঞার সুরে কথাটি বলে আমার কোলের উপর ছুঁড়ে মারলো দুই টাকার কয়েন। এক ভিক্ষুককে দুই টাকা ভিক্ষা দিয়েছিলাম। ভিক্ষুক কয়েনটি হাতে নিয়ে এমন ভাবে ছুড়ে মেরেছিল যে, আমার কোল থেকে বাসের মেঝেতে পরে গেলো। ভিক্ষুকের কান্ড দেখে পাশে থাকা লোকজন হাসলো কিছুক্ষণ। কয়েনটি হাতে নিয়ে মানি ব্যাগ থেকে আরো এক টাকা বের করে তিন টাকা দিলাম। তবুও নিলো না।
গত মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে গিয়েছিলাম গাজীপুর। চন্দ্রা মোর থেকে ইতিহাস পরিবহনের বাসে উঠলাম নবীনগর যাবার উদ্দেশ্যে। বাস তখন নন্দন পার্কের সামনে। কয়েকজন লোক উঠলো সেই অঘোষিত স্টেশন থেকে। এক ভিক্ষুকও উঠলো। তাকেই ভিক্ষা দিতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম।
বৃহস্পতিবার গিয়েছিলাম বই মেলায়। কমিশন বাদে ২০৭ টাকা দামের একটি বই কিনে ২১০ টাকা দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই তিন টাকা খুচরা দিয়েছিলো।
বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। ভিক্ষুকদের এমন পরিবর্তনে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তারাও যুগের সাথে তাল মিলাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় বের হলে যে পরিমান ভিক্ষুক সামনে হাত বাড়ায় তাতে ৫ টাকা করে দিলেও দৈনিক শত টাকা খরচ হয়ে যাবে। তার উপর হিজরা তো আছেই। এদিকে টেকনিক্যাল মোর আর ঐদিকে আব্দুল্লাহপুর থেকে বাসে উঠবে। এ এক মহা যন্ত্রণার নাম। ওরা আবার আরো একধাপ এগিয়ে। ৫ টাকা নিবে না। দশ টাকা দিতে হবে। দিতে অস্বীকার করলেই গায়ের উপর পড়বে। অশ্লীল কথা বলে। প্রতিবাদ করলে কেউ কেউ বলে উঠে "ওরা নিবেই! ওদের পাশ আছে।" কি সাজ্ঞাতিক!
একদিন মধুপুর জাতীয় উদ্যানের সামনে থেকে বাসে উঠেছিলো এক হিজরা। হিজরাদের মেকাপ দেখলে কে হিজরা আর কে হিজরা সাজার অভিনয় করছে বুঝাই কঠিন। এক ছেলে টাকা দিতে অস্বীকার করেছিলো। আর কই যাবি! যা তা বলে গালি তো দিলোই আর সবার সামনেই কাপড় খুলে এক্কেবারে কঠিন অবস্থা। কোন মতে তাকে সামাল দেয়া গেছে।
সেদিন বক চত্তর থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ধরে হাঁটছিলাম। যাব গুলিস্তান। ফাইনাল গন্তব্য ধামরাই। রাস্তা থেকে বাসে উঠলে সিট পাবোনা বলে স্টেশন থেকে বাসে উঠার জন্যই গুলিস্তান যাচ্ছিলাম। বক চত্তর থেকে পাতাল মার্কেট পর্যন্ত আসলাম। গাড়িগুলো যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো এখনো সেভাবেই আছে। সুতরাং রিকশা নেয়ার কোন মানেই হয়না। হাফ কেজি বরই কিনে খেতে খেতে যাচ্ছিলাম। ফ্লাইওভারের নিচে সদরঘাট যাবার যে রাস্তা সেখানে পৌঁছানোর পর ঘটলো নতুন বিপত্তি। এক ঠেলাগাড়ি বাজিয়ে দিলো ডান পায়ে ঠিক পকেট বরাবর, যেখানে মোবাইল রাখা ছিলো। মোবাইলে লেগেছিলো বলে শরীরে অতটা চোট লাগেনি। তখন বুঝিনি যে মোবাইলটা ফেঁসে গেছে! সামনে খানিকটা এগিয়ে যাবার পর বিআরটিসির কাউন্টারের সামনে গিয়ে সময় দেখার জন্য মোবাইলটা বের করেছি। দেখি সর্বনাশ! মোবাইলের টাচস্ক্রিন ফেঁটে চৌচির। মোবাইলটা সেদিন জীবন দিয়ে আমাকে আঘাত থেকে বাঁচিয়েছিলো।
মোবাইলের কথা ভাবতে ভাবতে খেয়াল করিনি যে, সামনে এক মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়ে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। "ভাই কিছু দেন!" কথা শুনে চমকে উঠি। মানিব্যাগে ভাংতি টাকা ছিলো না। বললাম, বড়ই নিবেন? "দেন" বলে সম্মতি দিলো। তিন-চারটে বরই বের করে হাতে দিয়েছি সবে মাত্র। দেখি কোত্থেকে যেন আরো পাঁচ-ছয় জন মহিলা সামনে হাজির। সবাই "আমাকে দেন, আমাকে দেন" বলে পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। কি আর করার। আরেকজনের হাতে দুইটা দিলাম। পাশ থেকে আরেক মহিলা পলেথিন টান মেরে নিয়েই দৌঁড়। বড়ই হারিয়ে মোটেই দু:খ নেই। ভাগ্যিস মানি ব্যাগ বের করেনি। তাহলে তো আম-ছালা দুটোই যেত! জ্যামের কারনে সময় গেল, মোবাইল গেল আর বরইয়ের থলি তো ফাও!
২০১৫ সালের কথা। টিউশনিতে যাবো বলে দুপুর বেলা খেয়ে-দেয়ে বের হয়েছি। আয়েশাকে বলে এসেছি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। বের হওয়ার সময় মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি। অটোতে উঠে পকেটে হাত দিয়ে দেখি মানিব্যাগ আনিনি। প্যান্টের পকেট সার্চ করে কোন টাকা পেলাম না। বুক পেকেটে হাত দিয়ে দেখি ২০ টাকার একটা নোট। বাহ, ভাগ্য তো খুব ভালো। টাকাটা বের করে দেখি ভেতরে আরো পাঁচ টাকার একটি নোট। যে নোটের মধ্যে স্মৃতিসৌধের ছবি আছে একপাশে, সেই টাকা। অটো ভাড়া পাঁচ টাকা ছিলো বিধায় সেই স্মৃতিসৌধের ছবিওয়ালা টাকাটাই দিলাম।
সন্ধ্যাবেলা টিউশনি থেকে বের হয়ে ভিক্টোরিয়া রোডে অটোর জন্য দাঁড়ালাম। অটোতে উঠবো এমন সময় একজন মহিলা ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলো। আমার যেতে লাগবে পাঁচ টাকা, আর পকেটে আছে বিশ টাকা। ভাবলাম পাঁচ টাকা দেই। বিশ টাকার নোট হাতে দিয়ে বললাম, পাঁচ টাকা রাখেন এখান থেকে। টাকা হাতে নিয়েই মেলা......। দিলোই না ফেরত! কি আর করা। বাধ্য হয়ে হেঁটেই রওনা হলাম। যেতে যেতে মাগরিবের আযান দিয়ে দিলো। কলেজপাড়া মসজিদে নামাজটা পড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওদিকে আয়েশা যে টেনশন করছে সে কথা খেয়ালই নেই। মোবাইলটাও সাইলেন্ট করা। বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। ধরতে পারিনি। বাসায় যাবার কথা মাগরিবের আগে। আমার দেড়ি দেখে আয়েশা যে এভাবে কাঁদবে ভাবিনি। বাসায় এসে দেখি, সে কি কান্না! যাবার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে জোরে কান্না শুরু করলো। কিছুতেই থামছে না। কোন কথাও বলছে না। কিছুক্ষণ পর কান্না কমিয়ে বলছে, "আমি তোমার জন্য কত চিন্তা করতেছি। তুমি এখনো আসোনা দেখে কত আজেবাজে কথা মনে আসছে। আবার কোন সমস্যা হলো কিনা। তুমি ফোনও ধরছো না। আমি একটা বাচ্চা মানুষ, এতো টেনশন কি নিতে পারি!" আবেগ মাখা কথা আর কান্না দেখে আমারও চোখ ভিজে উঠলো। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, "আর এমন হবে না টুকটুকি।"
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৯ রাত ১০:১৩