আমার মাদ্রাসা জীবন-০৩
ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উঠলাম। ক্লাসের মধ্যে প্রথম হওয়া কেউ ঠেকাতে পারলো না। শুধু নিজের ক্লাশ নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত মেধা তালিকাতেও প্রথম হওয়ার সুবাদে সবার নজরে আসলাম খুব সহজে। ক্লাসের একমাত্র প্রতিদ্বন্দী আবু সাঈদ নামের ছেলেটির সাথে আমার সখ্যতা ঘরে উঠে কিছুদিনের মধ্যেই। অনেক কাজে ওকে অনুসরণ করতাম। এই যেমন স্টাপলার ছাড়া খাতায় পিন কিভাবে মারতে হয়, পাঞ্জাবী ইস্ত্রী না করেও কিভাবে নতুনের মতো রাখা যায়, বই সেলাই করা ইত্যাদি। ক্লাস সেভেনে পড়লেও ঐ বয়সে একা একা কোথাও যাওয়া হয়ে উঠেনি। ওর সাথেই প্রথম বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ কি.মি দূরে উপজেলা সদরে গিয়েছিলাম বই কিনতে। এতো এতো সংখ্যতা যার সাথে সে হঠাৎ করেই ক্লাসে অনুপস্থিত। দুই দিন যায় তিন দিন যায় তার কোন খবর নেই। ও আসলে ওর নানা বাড়ি থেকে ক্লাস করতো। ওর নানা বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ওদের বাড়িতে চলে গেছে। ঐখানে নাকি কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। খুবই খারাপ লেগেছিলো ওর জন্য। একবার তো বলে যেতে পারতো। এখনকার মতো মোবাইল ফোনের যুগ থাকলে হয়তো জানাতো। আসলে ওর নানা মারা যাবার পর ওর মামা-মামীরা আর রাখতে চাননি বলেই হঠাৎ করে চলে যাওয়া। ওর নানাসহ ঐ বাড়িতে তিনজন একসাথে মারা গিয়েছিলো ডায়রিয়াতে।
ক্লাস সেভেনে তখন ২০ জন ছাত্র আর ১২ জন ছাত্রী। ক্লাসের মধ্যে নতুন গণিতের স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার প্রতি ক্লাসের প্রায় সবারই আগ্রহ। কিন্তু আমাদের পরিবারের অবস্থাতো আমি জানি। প্রতি মাসে ৩০০ করে টাকা দেয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আমি সেটা চাইতেও পারবো না। আমি জানি, বাড়িতে যদি বলি প্রাইভেটের জন্য টাকা লাগবে তাহলে বিনা বাক্য ব্যয়ে আমার মা-বাবা দিয়ে দিবেন। আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হয়েছে আর আমার মা-বাবা পূরণ করেনি এমনটা হয়নি। এই যেমন আমার পড়ালেখা অবস্থায় বিয়ের ব্যাপারটা।
সিদ্ধান্ত নিলাম, অন্যরা পড়ুক। আমি প্রাইভেট না পড়েই পাশ করবো। আমি পড়বো না প্রাইভেট। একদিন স্যার নিজ থেকেই আমাকে প্রাইভেটে আসতে বললো। বললো, "তুমি এসো প্রাইভেটে, কোন টাকা লাগবে না।" কোন ভাবে স্যার আমাদের পারিবারিক অবস্থা জেনে গিয়েছিলেন। আমিও আর না করিনি। কিন্তু গিয়ে দেখলাম পড়ালেখার চাইতে গল্পই হয় বেশি। স্যার প্রথম প্রথম প্রতিষ্ঠানে এসে যেমন পড়াতেন এখন ক্লাসে তেমন মনযোগী নন। কৌশলে প্রাইভেট পড়ানোর ধান্দা তার। প্রাইভেটে নিয়ে পড়াবে তো দূরে থাক আমাকে দিয়ে উল্টো ক্লাশ নিতো। মাঝে মাঝে ক্লাশ এইটের ব্যাচেরও ম্যাথ করে দিতে হতো। সপ্তাহ খানিক পর আর গেলাম না প্রাইভেটে।
ক্লাস সেভেনে থাকতে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এক্সট্রা ম্যচিউর হয়ে গিয়েছিলো। এই যেমন লাভ লেটার দেয়া, প্রেমের উপন্যাস পড়া, রাস্তায় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা প্রভৃতি। এই নিয়ে দু একজন স্যারদের বেত্রাঘাতও খেয়েছে। কিন্তু তা হলে কি হবে ওরা থামার বদলে যেন আরো বিগরে যেত। তাদের থেকে ১০ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করতাম সবসময়। আমার একমাত্র ব্রত ছিলো লেখাপড়া। অবশ্য আড়চোখে কারো দিকে যে তাকাইনি তা বলা যাবে না। আমি একটা বিষয় খুব খেয়াল করেছি। যাকেই একটু একটু ভালো লাগতো, আর সেই ভালো লাগার সুবাদে আড়চোখে তাকাতাম তারই কেন যেন বিয়ে হয়ে যেতো।
অষ্টম শ্রেণিতেও যথারীতি প্রথম হলাম। এমনকি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও। পুরষ্কার স্বরূপ একটা ফাউন্টেইন পেন ও একটা ডায়েরি পেয়েছিলাম। তবে পঞ্চম কিংবা অষ্টম কোন ক্লাসেই বৃত্তি পাইনি। আমাদের ব্যাচের শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার ছিলো সবচেয়ে বেশি। আর যারা ছিলো তারাও সবচেয়ে নিম্ন মানের শিক্ষার্থী। স্যারেরা আমাদের ব্যাচ নিয়ে খুবই হতাশ ছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে ৩২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও অষ্টম শ্রেণিতে এসে ২০ জনে নেমে আসলো সেই সংখ্যা। ৮ জন মেয়ে আর ১২ জন ছেলে। এর মধ্যে চার জন নতুন ছাত্র আসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা হলো ২৪। নতুন ভর্তি হওয়া চার জনই হাফেজে কোরআন। মনে করেছিলাম ওরা মনে হয় অনেক মেধাবী। ওদরে সাথে মনে হয় পেরে উঠবো না। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে তেমন সুবিধা করতে পারছিলো না ওরা। দুষ্টুমিতে সারাক্ষণই মেতে থাকতো। প্রতিষ্ঠানের গাছের আম, কাঠাল কিংবা লিচু সব কিছু পাকার আগেই শেষ হয়ে যেতো। তবে এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটির কারনে ওরা আলাদা একটা স্থান দখল করে দেয় প্রতিষ্ঠানে।
প্রতিষ্ঠান শুরুর পর থেকে তখন পর্যন্ত কোন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়নি। সেবারই প্রথম ওদের উদ্যোগে স্যারদের কাছে গিয়েছিলাম বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে। স্যারদের অনেক বলে কয়ে রাজী করিয়েছিলাম। মাদরাসার সবাই অনকে উৎসাহ নিয়ে ক্রীড়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে। আমিও করেছিলাম। ভেবেছিলাম পুরষ্কার জিততে পারবো কিন্তু ৫০০ মিটার দৌড়, দীর্ঘ লম্ফ, উচ্চ লম্ফ, চাতকি নিক্ষেপ, গোলক নিক্ষেপ, বর্শা নিক্ষেপ, হামদ-নাত, কোরআন তেলাওয়াত কোনটাতেই কোন পুরষ্কার পেলাম না। আর হাফেজ ছাত্রদের ৪ টা ৫ টা করে পুরষ্কার। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
সে বছরই প্রথম আমাদের প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ এলো। কিন্তু শুধু অফিসে কক্ষেই। কোন ক্লাসেই দেইনি। ক্লাসে সবাই উদ্যোগী হয়ে চাঁদা তুললাম ফ্যান কিনবো বলে। একটা ন্যাশনাল ফ্যানও কিনেছিলাম। কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধান এসে বিপত্তি বাঁধালো। বললো বিদ্যুতের লাইন দিতে দিবে না। অনেক টাকা নাকি বিল আসবে। আমরা বললাম, ফ্যান যখন কিনেছি লাগাবোই। প্রয়োজনে নিজেরা চাঁদা তুলে বিল দেবো। লাগিয়েছিলামও ফ্যান। ফ্যানটা আজও আছে কিনা জানিনা। তবে এখন আর ছাত্রদের চাঁদা তোলে বিল দিতে হয় না। প্রতিষ্ঠানই দেয়। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপারটি হচ্ছে আমাদের ক্লাসে ফ্যান লাগানোর তিন মাসের মধ্যে অন্যান্য ক্লাসেও ছাত্ররা নিজরো উদ্যোগী হয়ে ফ্যান কিনে নেয়। নতুন কোন কিছু করতে পারার মাঝে যে আনন্দ তা অন্য কিছুতে নেই। এখনো সে সব দিনের কথা ভাবতে ভালো লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৩৬