সিদ্ধান্তটা আগেই নেয়া উচিত ছিল। ইছাহাক মুন্সী হাঁটে আর ভাবে।ট্রলারে বসে ঘন্টা খানিক সয়য় নষ্ট করা উচিত হয়নি। মুন্সী খাল পাড় ধরে হাঁটছে আর পথের ছক মনে মনে আঁকছে।খাল পাড়ের পর নতুন ব্রিজের রাস্তা তার পর পুরানো পাকা রাস্তা।ট্রলার নষ্ট নাহলে দিন থাকতে বাড়ি ফেরা যেত।মুন্সী আর তার গ্রামের কিছু পুরুষ মহিলা গিয়েছিল নদীর ওপারে।মহিলা পীরের স্বপ্নে পাওয়া তেল পানি পড়া নিতে।ফেরার পথে ট্রলার নষ্ট হয়।যেহেতু মুন্সীর স্ত্রী বাড়িতে একা তাই তার বাড়ি ফেরা দরকার।মুন্সী ট্রলারের অপেক্ষায় না থেকে হাঁটা পথে রওয়ানা দেয়, যদিও ঘুরা পথ।বর্ষা কাল,মুন্সী নতুন রাস্তায় উঠলে কাছেপিঠে কোন মসজিদে মাগরিবের আজান দেয়। বৃষ্টি নামে ঝিরিঝিরি। হাঁটতে হাঁটতে তার চলা মন্থর হয়।মন্থর হয় একারনে যে, সে চৌমাথায় পৌঁছায় সেখানে কিছু মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করে তারা সবাই কেমন ব্যস্ত।সেখানে কিছু দোকান যেগুলো প্রায় সব বন্ধ। নতুন ব্রিজ আর রাস্তা হওয়ার ফলে এখানে একটি নতুন হাট বসে,মুন্সী ভেবে নেয়।আজকেও হাটবার ছিল এমন মনে হয় তার।কিছু অস্থায়ী দোকানি তাদের দোকান গুটিয়ে নিচ্ছে।মুন্সী চৌমাথা পেরবে এমন সময় কারো ডাকে সে থামে।ছাতা মাথায় এক জন বয়স্ক লোক কিছু চারা গাছ নিয়ে দাড়িয়ে।হাটে হাটে চারাগাছ বিক্রি করে যারা, তাদের মতই সে।যদিও মূল হাট থেকে সে একটু দুরে কিছু গাছ নিয়ে দাড়িয়ে।একটি হারিকেন মানুষটার হাতে,মৃদু আলোয় বৃদ্ধ কে ঠিক ভাবে ঠাহর করতে পারেনা ।মুন্সী কিছু বলার আগে গাছঅলা বৃদ্ধ বলে একটা গাছ নিয়া যান মিঞা। স্ত্রী সন্তান নিয়া সুখে থাকবা।সন্তান নাই, হইতে কতক্ষণ।মুন্সীর হাতে ছোট একটি চার গাছ দিয়ে বৃদ্ধ বলে দাও মিঞা পাঁচ টাকা।মুন্সীর বুক পকেটে পাঁচ টাকার একটিই নোট ছিল। সেটা সে বের করে দিলে বৃদ্ধ গাছঅলা বলে ডান দিকে হাঁটা দাও আর গাছটা বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম কোনে লাগাবা।মুন্সী হাঁটা শুরু করে। সে ভাবে আমি কি কিছু বলছি বুড়ার কাছে। নাকি সে একাই কথা বলেছিল, তার কাছে শুধু পাঁচ টাকা আছে সে জানলো কিভাবে।কোনো সন্তান নেই তাও বা সে জানবে কিভাবে। মুন্সীর মনে হতে থাকে সে আসলে কিছুই বলে নাই।পিছনে তাকালে, তেমন কিছু দেখতে পায় না সে। তার মনে হয় কিছু আগে যে হাটখোলা সে পেরিয়ে এসেছে সেখানে কিছু নেই। কিছু ছিলো না এমন মনে হয় তার।সে ভাবে, মনে হয় বেশ দূরে চলে এসেছে। আর দোকানিরা চলে গেছে। যেহেতু বর্ষার রাত।
মুন্সী ঘটনা মিলাতে থাকে। লোকটি বৃদ্ধ তাই সে গাছটি কিনতে রাজি হয়েছে সে। যাতে গাছঅলা বৃদ্ধের কিছু উপকার হয় আর এমন চারাগাছের দাম পাঁচ টাকাই হয়।
মানুষে গাছ লাগায় ভবিষ্যৎ লাভের জন্য,সন্তানসন্ততির কাজে লাগে। কিন্তু ইছাহাক মুন্সীর নয় বছর বিবাহিত জীবনে কোন সন্তান নেই।আর এ কারনেই তেল পানি পড়া নিতে গিয়েছিল সে।
ইছাহাক মুন্সী বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম কোনে গাছটি রোপন করে। মুন্সীর স্ত্রী যার যে কোন নাম হলেও, তার নাম হয় মুন্সীর বউ, পরীর মা এবং আরো পরে আয়মুনের নানি। সে জানতে চায় মুন্সীর কাছে কি গাছ কোথায় পাওয়া গেল তার বৃত্তান্ত। মুন্সী নিমগাছ বলে। যেহেতু দেখতে কিছুটা নিমগাছের মত।তবে তার সন্দেহ আছে তাতে। এ ঘটনার পরে মুন্সী ও তার স্ত্রীর জীবনে এক আশ্চর্য আনন্দের ঘটনা ঘটে। মুন্সীর বউ এর বিশ্বাস স্বপনে পাওয়া তেল পানির ফল। মুন্সীর দ্বিমত থাকলেও সে কিছু বলেনা।
নিমগাছ সম্পর্কিত ঘটনা এবং ঘটনার পরম্পরায় ঘটা এই আশ্চর্য ঘটনা তাকে ভিন্ন কিছু ভাবতে প্রলুব্ধ করে। মুন্সীর বউ পোয়াতি হয় আর নীমগাছ সদৃশ গাছটি আশ্চর্য রকম ভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যথাসময়ে মুন্সীর বউয়ের একটি কন্যা সন্তান হয়।আর নিম গাছটিতে প্রথম ফুল ধরে। মুন্সী এর আগে এরকম রং আর ঘ্রানের ফুল কখনো দেখেনি।তার মনে হতে থাকে এটি একটি ভিন্ন জগৎ এর অলৌকিক গাছ।নিম ফুলের রং আর ঘ্রান এরকম হয় না।যথা নিয়মে মুন্সীর মেয়ে বড় হতে থাকে। নিমগাছ স্বাস্থ্যকর এ কারনে মেয়েকে নিমগাছের নিচে পাটি পেতে বসিয়ে রাখে মুন্সীর বউ আর মেয়ে আশ্চর্য রকম শান্ত থাকে।এমনকি হামাগুড়ি দিয়ে মাটিতে নামেনা।মেয়ে গাছের দিকে চেয়ে থাকে। অস্ফুটে গাছের দিকে চেয়ে কিছু বলে যা তার মায়ের নজনে পড়ে না।গাছের নিচে কোমল শীতলতা থাকে সব সময়।মেয়ের নাম যেহেতু পরী আর পরীর প্রতিটি জন্মতিথিতে গাছটিতে ফুল ফোটে এবং বিগত বছরের চেয়ে ভিন্ন রং আর ঘ্রাণের ফুল ফোটে। মুন্সী এ বিষটা খেয়াল করে আর সে টের পায় তার মেয়ের গায়ে এই একই ঘ্রাণ সারা বছর থাকে।প্রতি জন্মতিথি তে ফুলের সাথে মেয়ের গন্ধ পাল্টে যায়।তবে মুন্সীর বউ পরীর মা বলে সারা দিন গাছের কাছে থাকার ফলে মেয়ের গায়ে এমন ঘ্রাণ। যদিও গাছে ফুল থাকে মাস দুই।পরী কথা বলে, গাছের সাথে কথা বলে। পরী বড় হয়, গাছ বড় হয়। পরীর হাসি কান্না অভিমান সব গাছের সাথে। গাছটি মহীরুহ মহানিম গাছে পরিণত হয়।আর পরীর গায়ে ভুরভুর করে আশ্চর্য ফুলের ঘ্রাণ।
ষোল বছর বয়সে পরীর বিবাহ হয়।পরী খুব কাঁদে আর বিদায়ের কান্না কাঁদে মহানিম গাছটিকে জড়িয়ে। যেন দুনিয়ায় এই গাছ ছাড়া আপন কেউ আর নাই তার। এর পর ঘটনা গুলি দ্রুত ঘটতে থাকে। ফিরতি নায়রীর আগে মহানিম গাছটির সব পাতা হলুদ হয়ে যায়। ইছাহাক মুন্সী এটি একটি গুরুতর ঘটনা মনে করলেও তার করনিয় কি তা সে বুঝতে পারেনা। পরী ফিরতি নায়রীতে এসে দেখে পাতা শূণ্য গাছটি নিরব হাহাকার
নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পরী মুন্সীর কাছে বলে আব্বা আমার গাছটি আত্মহত্যা করেছে আর খোয়াবে আমাকে সে তার সমস্ত বৃত্তান্ত বলে গেছে এমনি আমার জন্মের আগের কথাও।এক বর্ষার রাতে কিভাবে তুমি গাছটি পেয়েছিলে সে সব ঘটনা আমাকে বলেছে।
স্বপ্নে গাছটিকে এক জন বৃদ্ধের মত দেখেছি,যেন সে ভিজতে ভিজতে মারা যাচ্ছে। যদিও মুন্সীর কিছু বলার থাকেনা।মেয়কে তার অচেনা মনে হয় আর অনর্থ ভয় পেতে থাকে। এখানে শেষ হলেও এ ঘটনার পুনুরাবৃত্তি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়।
যদিও মৃত মহানিম মুন্সী কেটে ফেলেছে।যদিও মন থেকে সরাতে পারেনি সে। আর বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম কোনে নিজের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে নজর যেত হামেশাই। আর এভাবেই
একদিন দেখে একটি চারা গাছ। মুন্সী কাছে গিয়ে দেখে সেই নিমগাছের চারার মত একটি গাছ ঠিক পুরানো গাছের গোড়ায় জন্মেছে।আর সে চলে যায় বহু বছর আগের সেই রাতে।অবিকল সেই গাছ যা তার সামনে দাড়িয়ে।যেন এই মাত্র গাছটি লাগিয়েছে। আর তার মনে হতে থাকে সেই বহুদিন আগের সময়ে সে চলে গেছে। আর মাঝের এ সমস্তই শুধু খোয়াব মনে হয়।আর ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষ যেমন বোবা কান্না কাঁদে, তেমনি কেঁদে ওঠে।সময়ের হিসাব সংক্রান্ত ঘোর, তাকে তার মেয়ের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দেয়। পরীর মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়।সে সিদ্ধান্তে আসতে পারেনা গাছটি রাখবে না উপরে ফেলবে।ফলে সে এক দোটানার মধ্যে পড়ে। আর এর মধ্যে জানতে পারে পরীর একটি কন্য সন্তান হয়েছে।এ খবরে মুন্সী একটি সিদ্ধান্তে উপনিত হয়। সে রাতে চারাগাছটি উপরে নিয়ে রওয়ানা দেয় চৌমাথার দিকে।সেই বর্ষা রাতের মতই যেন এ রাত। লোক চক্ষুর আড়ালে চৌমাথার ঠিক মধ্যখানে রোপন করে মুন্সী, তার মহানিমের গাছ।
কালক্রমে গাছটি মহীরুহে পরিনত হয়।সন্তানহীন দম্পতীরা মহানিম গাছে মানত করে সুতা বাঁধে।ফুল পাতা নিয়ে যায় সন্তান লাভের আসায়। কিছু ফললাভ হয় এমন শোনা যায়। তবে কিভাবে গাছের এ গুপ্ত খবর মানুষের মাঝে প্রচারিত হলো তা কেউ জানে না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১০:৪১