ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সরকার সমর্থক একাধিক সংগঠন ও গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার আদালত সমূহে একের পর এক মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব মামলার সংখ্যা অর্ধ শতক ছাড়িয়ে সেঞ্চুরির কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ প্রবণতা চলতে থাকলে একই ধরনের মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে দেশে একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে সন্দেহ নেই। এসব মামলা দায়েরের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, বাদীরা বিবাদীর শাস্তি কামনার চেয়ে সরকারের উপর মহলের নজর কাড়ার জন্যই এসব কর্মকান্ড করে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একাধিক মিডিয়ায় শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। এর মধ্যে কতটুকু সত্য এবং কতটকু মিথ্যা হয়রানী ও অপবাদমূলক তা বিবেকবান মানুষ মাত্রই জানেন।
তৎকালীল সেনা সমর্থনপুষ্ট সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সরবরাহকৃত সংবাদ সে সময় অধিকাংশ মিডিয়াই প্রকাশ ও প্রচার করে। এখন প্রশ্ন হলো ডেইলি স্টার সম্পাদক সে সময় তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই বাছাই করা সম্ভব হয়নি বলে খোলামনে নিজের ভুল স্বীকার করাটাই কি তাঁর অপরাধ? আসলে ঐ সময় তাঁর পত্রিকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিরুদ্ধে সরকারি সংস্থার সরবরাহকৃত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত সংবাদ যাচাই-বাছাই করার সুযোগ ছিল না। এ সত্য কি সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা জানেন না? তাদেরই অনেক নেতা সে সময় সংস্কারপন্থী সেজে তৎকালীন সরকারের আস্থাভাজন হতে অথবা নিজের পিঠ বাঁচাতে চেয়েছেন। এমনকি পরীক্ষিত ও সিনিয়র অনেক নেতা সেসময় চাপের মুখে দলীয় সভানেত্রীর বিরুদ্ধে স্টেইটমেন্ট দিয়েছেন। এসব কি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব অস্বীকার করতে পারবে? দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব যদি এসব ঘটনা হজম করে নিজেদের দলীয় লোককে ক্ষমা করে দিতে পারেন, তাহলে মিডিয়ার ব্যাপারে তারা এখন কেন এত উচ্চাকাঙ্খা। মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন, যা অন্য মিডিয়াগুলো কৌশলে অতীতের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। এখন উদার মানসিকতার কারণে তিনি একের পর এক মামলার আসামী হচ্ছেন। আর অন্য মিডিয়াগুলোর ব্যাপারে কেউ টু শব্দ করছে না। এটা কি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়।
বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের টক শো-তে আলাপচারিতার সময় কথা প্রসঙ্গে সাংবাদিকতায় দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে চেয়ে নিজের ভুল স্বীকারের পরই প্রধানমন্ত্রী তনয় ফেইসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে এ নিয়ে মন্তব্য করেন যে, মিডিয়ার এসব ভুলের জন্য তার মা প্রায় এগারো মাস জেল খেটেছেন। দলকেও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা যেতে পারে। এরপর থেকেই শুরু হয় মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিযোগিতা। বিবেকবান প্রতিটি মানুষই এধরনের মামলাকে গণমাধ্যমের ওপর আঘাত ও হয়রানিমূলক বলে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোর পক্ষ থেকেও এ ধরনের হয়রানিমূলক মামলার নিন্দা জানানো হয়। এদিকে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ফেইসবুকে দেওয়া আরও এক স্ট্যাটাসে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘এটা গণমাধ্যমের ওপর আঘাত নয়। এটা ফৌজদারি মামলাও নয়। এটা হলো দেওয়ানি মামলা। আধুনিক আইনি ব্যবস্থাসম্পন্ন সব দেশেই এটা ঘটে।’ জয় সাহেব যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে লেখাপড়া করেছেন। সে সব দেশে এমন মামলা হরহামেশাই হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু জেলায় জেলায় আদালতে একই বিষয়ে একই ধরনের মামলা করা কি হয়রানিমূলক নয়? ব্যক্তি মাহফুজ আনামের পক্ষে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে মামলায় হাজিরা দিতে গেলে তাঁর সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কি কোন বিঘ্ন ঘটবে না? আসলে জেনে শুনেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন মামলা হচ্ছে। জয় সাহেবের দ্বিতীয় স্ট্যাটাসের পর সরকার সমর্থকরা আরও মামলা দায়েরে উৎসাহিত হবেন। এটা কোন ধরনের রাজনীতি, কোন ধরনের প্রতিহিংসা? আওয়ামী লীগের কেউ কেউ এখন এমনও মন্তব্য করছেন যে, এ ঘটনায় এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। এক বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি কিছুটা অনুরক্ত মাহফুজ আনামকে শাস্তি দেওয়া যাবে। একই সাথে ভবিষ্যতে এধরনের পরিস্থিতিতে মিডিয়ার জন্য তা একটা লেসন হবে।
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী দু’বছর যারা রাজনীবিদদের ওপরে ইচ্ছে মত ছড়ি ঘুরিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পেরে ক্ষমতার জোরে মিডিয়ার উপর অপবাদ দিয়ে হয়রানি এ যেন, যত দোষ নন্দ বেটারই দোষ। সেনা সমর্থিত সরকারের সময় কোন দল বা ব্যক্তি যদি বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তা হলে বিএনপি ও তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াই হয়েছেন। এ সত্য সবাই জানেন। অবশ্য আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ক্ষমতার স্বাদতো ভোগ করছে। তাই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নয়, কৌশলী ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে সব কিছু বিবেচনা করে সব শ্রেণী পেশার মানুষকে আস্থায় নেওয়া প্রয়োজন। সরকার এই সত্যটি যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করতে পারবে ততই মঙ্গল।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১১