এই দিঘীটির আরো একটি সুন্দর নাম আছে, যা অনেকেরি অজানা। ১৯৭১ সালে বাংলা স্বাধীন হওয়ার পর , মুক্তি বাহিনীর একজন সদস্য শ্রী বলেশ্বর পাল দিয়েছিলেন।
শ্রী বলেশ্বর পাল ছিলেন একজন সধারন হিন্দু পরিবারের খেটে খাওয়া বিন মজুর। এক মেয়ে আর স্ত্রী কে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনার প্রয় দুই মাস পূর্বে পাকিস্থানীরা তাদের গ্রাম আক্রমন করে। তখন বেশিরভাগ হিন্দু পরিবার তাদের সব কিছু নিয়ে ভারত চলে যায়। কিন্তু সে যায় নি।
বলেশ্বর পাল না যাওয়ার পিছনে অন্যতম কারন ছিল, সে দিন পাকিস্থানী বাহিনীর আক্রমনে তার বাবা শ্রী আনন্দ পালের নির্মম মৃত্যু হয়। তার বাবার বহমান তাজা রক্ত সেদিন তার বিবেকের সামনে বাধাঁ হয়ে দাড়িয় ,তার অপ্রতিরুদ্ধ কন্ঠ অব্যক্ত ভাষায় বলে উঠে। "এই বাংলা শুধু মোসলমান দের নয়, এই বাংলা সকল জাতির ,সকল ধর্মের।"
সেই থেকে বলেশ্বর দূঢ় প্রতিঙ্গা বদ্ধ , এই বাংলাকে সে স্বাধীন করবে এবং এখানেই সে বেঁছে থাকবে।
দিনটি ছিল ২৫ শে শ্রাবন! ঘন মেঘ আকাশের চারধারে ঘুর ঘুর করছে।কিন্তু বৃষ্টির বিন্দু মাএ চিহ্ন নেই। বেলা প্রয় পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, বলেশ্বর এখনো বাড়ি ফেরেনি। তার স্ত্রী "শ্যামলী" আর এক মাএ কন্যা "কনক" ঘরে এক।
একটু বাদে আকাশ প্রকান্ড ভাবে ডেকে উঠেছে, মনে হয় এখনী আকাশ ফেটে বৃষ্টির রসদ গুলু সবুজ শ্যামল প্রান্তরে চাদরের মতো বিচিয়ে পড়বে।
পৃথিবীটা আজ কেমন যেন ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
বৃষ্টির শব্দের মতো বাহিরে কিসের শব্দ হচ্ছে, তা দেখার জন্য শ্যামলী কপাট খুলতেই দেখে, কাঠাল গাছের নিছে হলুদ রংয়ের খাকি পোশাক পরা তিন জন মানুষ দাড়িয়ে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে। গোধূলীর আবছা আলোয় শ্যামলী তাদের চেহারা দেখার চেষ্টা করছে। তাদেরকে আগে কোথাও দেখেছে বলে শ্যামলীর মনে হয় না। তাদের গাল ভর্তী দাড়ি।, এক জন বসে বড়ি খাচ্ছে আর বাকিরা দাড়িয়ে পান চিবাচ্ছে.।, তাদের এক জনের থুতনি বেয়ে পানের রস পড়ছে, সে আবার মাঝে মাঝে তার হলুদ দাত গুলু বের করে হাসছে। আজকের এই চেনা পরিবেশটাও শ্যামলীর কাছে বড় বেশি অচেনা লাগছে।
ঘন মেঘ গোধূলীর রক্তিম সূর্যটাকে ঢেকে দিয়েছে। পৃথিবীতে আজ সন্ধ্যা নামার আগেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চার পাশটা কেমন যেন ভয়ানক হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে।মেঘের গর্জন আর বিজলীর অদ্ভুত আলো মিলে পৃথিবী এক ভয়ংকর রুপ ধারন করছে। বাহিরে দাড়ানো তিন জন অচেনা মানুষকে শ্যামলীর কাছে আরো অদ্ভুত লাগছে। সে কি করবে বুজতে পারছে না,বৃষ্টি আসার আগেই তাদের ভিতরে ডেকে আনবে না দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে যাবে। শ্যামলীর ভাবনা গুলু শেষ না হতে ভিতর থেকে নয়-দশ বচরের একটি মেয়ে বলে উঠলো,
মা ! খুব ক্ষুদা পেয়েছে, কিছু খেতে দাও।
ম! বাবু যে এখনো আসছে না?
বাহিরে মেঘের গর্জন শুনছো? মনে হয় একবার শুরু হলে আর থামবে না।
মা ! বাবু কখন আসবে?
বৃষ্টিতে ভিজলে বাবুর অসুখ করবে । আর বাবুর অসুখ করলে তুমি কাদঁতে শুরু করবে। মনে পড়ে মা?
কয়েক দিন আগে বাবুর একবার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হয়েছিল। বাবু সারাদিন বিচানায় শুয়েছিল, আর তুমি বাবুর মাথায় ঔষধ মেখে দিলে। আর কি কান্নাটাই না কাদঁলে। যানো মা , তুমি যখন কাদোঁ তখন আমারো খুব কান্না পায়।
মেয়েকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা শ্যামলীর জানা নেই। তবুও বললো , তোর বাবুতো এতো দেরি করে আর কোন দিন ঘরে ফিরেনি। হয়তো একটু পরেই দেখবী তোর জন্য মস্ত বড় পুতুল নিয়ে তোর বাবু ঘরে ফিরে এসেছে।
অমনিতে বাহির থেকে কেউ একজন বললো,
ঘরে কেউ আছে?
কনক দৌড়ে এসে দরজা খুললো, ভাবছে তার বাবু এসেছে। দরজা খুলতেই কিছু না বলে অচেনা তিন জন লোক ঘরে প্রবেশ করলো। কনক তার ভিতু দৃষ্টি দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এই প্রথম সে এক পোষাকে তিন জন মানুষ দেখলো। সে বললো ,
আপনারা কি বাবুর কাছে এসেছেন? বাবু ঘরে নাই।
আপনারা এই খানে বসুন , বাবু একটু পরেই চলে আসবে।
এই বলে কনক ভিতরে চলে এলো, সে তার মা কে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে জড়ানো কন্ঠে বললো।
মা !
দেখ, বড় বড় দাড়ি গোফ ওয়ালা তিন জন লোক বাবুর কাছে এসেছে, আমি তাদেরকে সামনের ঘরে বসতে বলেছি। মা, ওদের দেখে আমার না খুব ভয় করছে।
ধিরে ধিরে আকাশ ফেটে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো । বৃষ্টির ফোটা গুলু তাল পাতার চাওনী ভেদ করে কনকের স্নেহময়ী মুখে এসে পড়ছে। মেঘ বিকট গর্জন দিলে সে তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
অপরিচিত ভয়ংকর লোক গুলু সামনের ঘর থেকে ভিতরে চলে এলো। তারা কিছু না বলে কনক কে তার মায়ের কোল থেকে চিনিয়ে নেয়। ভয়ে কনকের মুখ নিল হয়ে যায়। শ্যমলী চিৎকার করে বলে উঠলো,
আপনারা কে?
কি চান?
আমার মেয়ে কে ছেড়ে দিন।
শ্যমলীর এই তিব্র আর্তনাদ মনে হয় আজ এই ঘর থেকে বের হচ্ছে না।
বৃষ্টির ফোটা গুলু ধিরে ধিরে আরো বড় হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ গুলু শ্যমলীর আহাজারী কে রুদ্ধ করে দেয়।
আরেকটা পিচাস পিচন থেকে এসে শ্যমলীকে মাটিতে শুইয়ে দেয়। শ্যমলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজকে বাঁচিয়ে খোলা দরজায় দৌড়ে পালালো। যে লোকটি কনককে পিছন থেকে ধরে রেখেছিল, কনক তার হাতে শক্ত করে কামড় বসিয়ে মায়ের পিছে পিছে চুটছে। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে মা আর মেয়ের পিছু নিলো অপরিচিত সেই ভয়ংকর লোক গুলু ।
চার দিক অন্ধকার। অন্য দিকে ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন । দাড়িয়ে যায় তারা। হঠাৎ বিজলি চমকাতে দৌড়ে ছুটে গহীনে। মা তার মেয়ে কে নিয়ে নিজদের আড়াল করার জন্য আশ্রয় নিলো নির্জন ঝোপের নিছে। ঝুম বৃষ্টি আর মেঘের বিকট গর্জন ,মাঝে মাঝে বিজলীর অদ্ভুত আলো, পৃথিবীকে এক নব ভয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
হঠাৎ সেই নিঝুম ঝোপের নিচ থেকে বিকট চিৎকার। একটি মায়ের আহাজারি আর একটি শিশুর করুন আর্তনাদ। বৃষ্টির মায়াবী শব্দের সাথে মা ও মেয়ের আর্তনাদ মিলে মিশে একাকার ।
শ্রাবনের আরেকটি দিন শুরু। নব ঊষার প্রথম আলো, রাস্তার উপর বিছিয়ে থাকা ঘাস গুলুর উপর পড়তেই মনে হয়, বৃষ্টির কনা গুলু ঘাস কে খুব আপন মনে করে জড়িয়ে আছে। বিচিএ এই সোনালী রোধ ঘন ঘাসের উপর জমে থাকা বৃষ্টির কনা গুলুকে আরো বিচিএ ময় করে তুলেছে। প্রভাতের এই মায়া ভরা ঘাসের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে বলেশ্বর। বলেশ্বরের দু'পা কে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধেরেছে জমে থাকা বৃষ্টির কনা গুলু ।
বলেশ্বর তার উঠানে দু'পা দিয়ে একটি গভীর নিরবতা অনুভব করলো। যা তাকে বহু কাল তাড়া করে বেড়িয়েছে। বলেশ্বর তার স্নেহময়ী কন্ঠে বলে উঠলো।
মা কনক !
ও মা কনক !
কোথায় গেলিরে তুই? দেক তোর জন্য বাবু কি নিয়ে এসেছি। এই বলে সে ঘরে দু'পা দিলো, দিয়ে সে আরো গভীর শূন্যতা অনুভব করলো। ঘরের চর্তুকোন আজ ভরপুর শূন্যতায়। কোথাও কারো বিন্দু মাএ সাড়া শব্দ নেই। দূরে কোথাও পান্জাবীরা কারো বাড়ি আক্রমন করেছে। সেখানের মানুষের ঘোর আর্তনাদ আর গুলির শব্দ শোনা যায়।
বলেশ্বর ভাবলো তার স্ত্রী দক্ষিন পাড়ার শ্রীমতী কাছে গিয়েছে। শ্রীমতী তার বাল্য সখী। এক সঙ্গে তারা বহু দিন ছিল। তাই মাঝে মাঝে শ্যামলী তার কাছে যায়। এছাড়া শ্যামলীর যাওয়ার মতো কোন স্থান নাই ।
বলেশ্বর তাদের জন্য দুপুর পযন্ত অপেক্ষা করলো। দুপুর গড়িয়ে প্রয় বিকেল ,তাদের ফেরার নাম গন্দ মাত্র নাই। বলেশ্বরের মন আর মানছেনা। সে চললো শ্রীমতীর বাড়ির দিকে।
বেলা প্রায় পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে, সে হাটছে রাস্তার এক পাশ ধরে। রাস্তার দু'ধার জনো শূন্য। রাস্তার পাশের দিঘীটির এক কোনে কিছু কাক জড়ো হয়ে কা..... কা.....করছে । কয়েকটি কুকুর ঘেউ ......ঘেউ.....করে সে দিকে এগেয়ে যাচ্ছে। কাক আর কুকুরের শব্দ গুলু এতোই ভয়ানক যে, বলেশ্বর জনো শূন্য রাস্তায় ভয়ে ভয়ে হাটছে।
আরেকটু সামনে এগুতেই তার শরিরের লোম গুলু দাড়িয়ে গেল। সে দেখতে পেল দিঘীর পূর্ব কোনে একটি উলঙ্গ মানুষের পাশে কিছু কুকুর ঘুরা ফেরা করছে। আর তার উপরে এক ঝাক কাক অভিরাম কা...কা... করছে।
বলেশ্বর খানিক ক্ষন এদিক ও দিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে , সে একাই উলঙ্গ মানুষটাকে দিঘীর পাড়ে টেনে তুললো । বলেশ্বর সেই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজকে আর সামলে রাখতে পারলো না। আজ তার নিরবতার সকল প্রাচির ভেঙ্গে সেখানে অশ্রুর স্রোত বইছে। সৃষ্টির অসিম সুন্দর্য্য তার নয়ন সম্মুখে স্তব্দতার কালো শোকে চেয়ে গেছে। আপন জন হারানোর বেদনা আপনাকে কত খানী কাতর করে তুলতে পারে তা আজ স্পষ্ট ভেসে উঠেছে বলেশ্বরের মুখে। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো সে ।
ঘন নির্জনে একা একটি মানুষের শব দেহের পাশে বসে কাঁদছে বলেশ্বর। তার পাশে কিছু কাক আর কুকুর ছাড়া কোন প্রানী বলতে নেই।
বলেশ্বরের রক্ত শিতল হয়ে আসছে, কন্ঠ শান্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার নড়ার বিন্দু মাএ শক্তি নেই। বলেশ্বর দেখছে দূরে জঙ্গলের পাশে, দিঘীর কিনারে আরো একটি উলঙ্গঁ বাচ্ছাকে কুকুরে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। কিছু কাক তার উপরে উড়ছে আর অবিরাম কা.....কা.....করছে।
ধিরে ধিরে কিছু মানুষ জড়ো হলো এই নির্জন জঙ্গলে । এই অবেলায় তারা আসার কারন ছিলো পাকিস্থানীরা তাদের তাড়া করছে। মানুষ গুলু দেখতে পেল বলেশ্বর একটি নারীর শব দেহের পাশে অবচেতন অবস্থায় গাছের শিকড়ের সাথে মিশে আছে । মানুষ গুলু তাকে তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। সন্ধ্যা ঘনাতে পাকিস্থানীরা জঙ্গলে এসে খুব গোলা গুলি করতে লাগে। এদিকে সবাই জঙ্গলে ছেড়ে পালিয়ে যায়। একা বলেশ্বর থেকে যায়।
অবশ্য সেদিন তার পায়ে একটি গুলিও লাগে।
সেই থেকে এই দিঘীটির নাম '"শ্যাম কনিকা দিঘী"'।