ইদানীং এ শহরকে নেতৃত্ব দিচ্ছে রোদ। খবরের শিরোনামও হচ্ছে কাঠফাটা রোদ নিয়ে। সবার মুখে মুখে রোদ আর রোদ। একফোটা বৃষ্টি যেন রূপকথা। প্রকৃতির খেলা তবুও তীব্র প্রতিবাদ হচ্ছে এ রোদকে ঘিরে। এই রোদের সমর্থন দিচ্ছে শুধুমাত্র লেবুর শরবত বিক্রেতা, আইসক্রিম বিক্রেতা ও ঠান্ডা পানীয় বিক্রেতারা।কারন রোদেই এদের ব্যবসা জমজমাট।
এমনই এক চলমান শরবত বিক্রেতার ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইমন। একগ্লাস লেবুর শরবত খেলো।ইমন ভাবছে এই রোদে গলাটা অন্তত কিছুক্ষনের জন্য ঠান্ডা হল।পকেটে হাত দিয়ে চোখ কপালে উঠেগেল ইমনের। ইমন বিল দেওয়ার জন্য পকেটে হাত দিয়ে দেখলো মানিব্যাগ নেই। ঘামতে শুরুকরলো ইমনকে।মানিব্যাগে ৫০০ টাকার নোট আর খুচরা ছিল ৮০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি সে। প্যান্টের সামনের পকেট দুটো খুজেও কোন টাকা পাওয়া গেল না। ইমনের ভাবনায় দুটি রাস্তা আছে, এক ভিড়ের মধ্যে আত্নগোপন করা, দুই মাপ চেয়ে বিদায় নেওয়া।
তবে মাপ করবে বলে মনেহয় না।উল্টা যদি তাকে দিয়ে দোকানদারি করায় সেই ভয়ে কিছুই বলছেনা ইমন। এমন সময় ইমনের পাশে একটা ছেলে এসে দাড়াল। বয়স ২৫ বা ২৬, মাঝারি স্বাস্থ্য,রোদপোড়া চেহারা। নোয়াখালীর ভাষায় কথাবলে তবে শুদ্ধ বলার কঠিন চেষ্টা আছে লোকটার মধ্যে। লোকটা অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাস করলো "ভাইয়ার কোন সমস্যা নি! "
ইমন ঠান্ডামাথায় জবাব দিল "জ্বি না। "
-আমি আমনেরে দেখি কিন্তু বুঝিফেলছি আমনে প্রবলেমে আছেন।
-না ভাই আমার কোন প্রবলেম নাই।
-হুরু মিয়া। আমনে কইলেই কি হইতো নি! আমনে কতক্ষন এই পকেট হাতান আবার কতক্ষন ওই পকেট হাতান। আই সিওর, হয় আম্নের টিয়াপয়সায় সমস্যা, নয়তো চুলকানির ব্যারাম আছে।
-ভাই আপনি একটু বেশি কথা বলতেছেন। যা ই হোক, সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলে ১০ টাকা ধার দেন। আর আপনার ফোন নাম্বারটা আমাকে দেন। টাকা পরে শোধ দিতে দরকার হবে।
লোকটার মুখে নিরব রহস্যের হাসি ফুটে উঠলো।সে বললো
-" এইডা না কইবেন। আমি আগেই বুঝছি যে আপনের চুল্কানি না। আপনের চুল্কানি হইলে তো এহানো থাকতেন না। থাকতেন ওয়ারব্রিজের গোড়ার ওষুধওয়ালার ধারে। হে হে হে।"
হো হো করে হাসতে হাসতে শরবতের বিলটা দিয়ে দিল। অদ্ভুত আচরন করছে ছেলেটা। ইমন উনার কথাবার্তা শুনে বেশ ভয়ে আছে। সে কোনদিন অপরিচিত মানুষের সাথে এভাবে কাউকে কথাবলতে শোনেনি। ইমন উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে মোবাইল নাম্বারটা চাইলো। লোকটা তার অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তা আবার বলতে শুরুকরলো।
-পাগল নি পাইছেন! আমনেরে আমি মোবাইল নাম্বার দিমু আর আম্নে আমারে ফোন দি টিয়া শোধ করবেন! একঘন্টা পর তো আম্নে আমারে চিনবেন ই না।
বিস্মিত হয়ে ইমন বললো
-"আরে ভাই, হেল্প তো নিজের ইচ্ছায়ই করলেন। এখন এসব কথা বলতেছেন কেন!"
-হেল্প কইচ্ছি দেইক্কা কি নদীত লাফদিছি নি! হুনেন আই আম্নের লগে আমনের বাড়িত যামু। টিয়া শোধ লইয়া আমু। যাওনের বাস ভাড়া ও আমি দিমু।হেই টিয়াও পড়ে আমারে দিত হইবো।
মহাবিপদে পড়েছে ইমন। বাড়িতে না গিয়ে উপায় নেই। ঘাড়ত্যাড়া মানুষ, কোন কথাই বুঝবেনা। রওনা হল দুজনে। ইমন উনার নাম জেনে নিল। চরিত্রের সাথে নামের অদ্ভুত মিল রয়েছে। লোকটার নাম অটল।
মতিঝিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাস। বাসের হেল্পার আসলো ভাড়া নিতে। ইমনের কাছে ভাড়া চাইতেই ইমন অটলকে দেখিয়ে দিল।
অটল হেল্পারকে জিজ্ঞাস করলো
-দুই সিট মতিঝিল। কয়টিয়া?
-১৬ ট্যাকা দেন।
-কি কয়! ফার্মগেটেরতোন মতিঝিল ৮ টিয়া ভাড়া হয় কেমনে! লগে ২ টেয়া দিলে তো সাভারেরতোন ঘুড়ি আওন যাইবো।
-ভাই প্যাঁচাল কইররেন না তো। ভাড়া দেন।জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে আর ভাড়া বাড়লেই দোষ।
-আম্নের মালিকেরে গাড়ি নামাইতো কইছে কে! গাড়ি এক্কান নামাই ভাড়া করিদিছে ৮ টিয়া।
এসব অদ্ভুত কথাবার্তা বলতে বলতে ভাড়া দিল অটল। ইমন খুব লজ্জিত। বাসভরা মানুষ সব অটলের কথায় হাসছে। অটলের হাতপায়ে অস্থিরতা। জ্যামে আটকালেই সে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠছে।বাড়িতে পৌঁছতে দুপুর হয়েগেল। বাসথেকে নেমে হাটতে হাটতে দুজন বাড়িতে পৌছে গেল। পাঁচতলা বাড়িত তৃতীয় তলায় ইমনরা থাকে।
ইমনের বাসার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে দুজনে। অটল বললো "দেখছেননি ভাই কামডা কি করলাম। একপ্লেট ভাতের টানে ফার্মগেট টু মতিঝিলে,হেইডাও ঠিক আছে আবার ৩০ ফিট উপরেও ওডোন লাগছে। "
ইমন লোকটার কথা কিছুই বুঝলোনা।তাকিয়ে শুধু শুনলো।ইমনের মা দরজা খুললো। "স্লামাইকুম খালাম্মা " হাসিমুখে সালাম দিল অটল। এরপর বলতে শুরুকরলো "খালাম্মা গত একসপ্তা ধরি খালি আম্নের রান্নার প্রশংসা হুইনতে হুইনতে খাওনের লাইজ্ঞা চইল্লা আসছি। " ইমনের মা ভাবলো এটা হয়তো ইমনের বন্ধু। তবে নোয়াখালীর বন্ধু কোত্থেকে জোগাড় করলো এটাভেবে তিনিও বেশ চিন্তিত।
টেবিলের ওপর খাবার দেওয়া হল। ইমন এবং ইমনের মা মিলে অটলের খাওয়া দেখছে। বিগত একসপ্তাহ না খাওয়া মানুষের মত খাচ্ছে। খাওয়া শেষে ইমনকে জিজ্ঞাস করলো "ইমনভাই আম্নের বেডরুম কই! বুইজজেননি ভাই, দুপুরে খাওনের পর ঘুম না দিলে আমার আবার মাথা ঘুরায়। " ইমনের সাথে ইমনের বেডরুমে গিয়ে শুয়ে আছে অটল।
অটল শুয়ে শুয়ে দুনিয়ার সব ভুয়া ভুয়া গল্প শোনাচ্ছে ইমনকে। সে একবার পুলিশের নাক ফাটাইছে, র্যাবের ক্রসফায়ার দেখছে নিজের চোখে ইত্যাদি বিভিন্ন গল্প। ইমন বুঝতে পারছে গল্পগুলো ভুয়া। কথায় কথায় অটল তার শৈশবের কথা বলতে লাগলো।
-ভাই ছোটবেলায় মা হারানোর পর বাড়িত আর ভাত খাইতারিনাই।পেটের টানে শহরে আইলাম। ঢাকা শহরে এইকোনা ওই কোনা ঘুরি ফিরি বিভিন্ন ম্যাচে থাকছি খাইছি। বুয়ার রান্দোনই কপালে জুটছে। ভাই ডাইলের মইদ্দেও পারলে মরিচ দি থোয়। আইজকা বহুদিন পর কোন ফ্যামিলি বাসাত খাইলাম। মায়ের হাতের লাঞ্চ।মা যদি ছিনতাই করোন যাইতো একটা মা ছিনতাই করি আনতাম নিজের লাগি।
দশটাকার জন্য এতদূর আসার উদ্দেশ্য ইমন বুঝে গেছে। ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছে। এ শহরে এমন পাগল আছে এখনও। ইমন জিজ্ঞাস করলো
-ভাই আপনার পেশা কি! বল্লেন না তো।
-আমি.......সে বিশাল রিস্কের কাম করি। কোনদিন রাস্তাঘাটে মরি পইড়া থাকি কে জানে।
-মানে!
-বুইজবেন না। পরে বুইজবেন। যাওয়ার সময় বুঝায়া দি জামুনে।
-আচ্ছা বাদদেন। বিকেল হয়ে যাবে একটু পর। আপনার তো ঘুমানো প্রয়োজন।
-এসি ডা একটু বাড়ায়া দিলেই তো ঘুমায়া পড়ি।
ইমন এসি টেম্পারেচার কমিয়ে দিল।কিছুক্ষনের মধ্যে দুজনই ঘুমিয়ে পড়লো।
ইমনের যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিকেল ৬ টা বাজে।অটলের কথা মনে হতেই পাশে তাকিয়ে দেখলো বিছানায় অটল নেই। অটলের জায়গায় পকেটমারে নেওয়া মানিব্যাগটা পড়ে আছে।মানিব্যাগ খুলে দেখলো ৫৮০ টাকার জায়গায় ৫৫৮ টাকা আছে।হিসেব ঠিকই আছে শরবতের ১০, বাসভাড়া ১৬। হঠাতই ইমনের মনে অটলের হো হো হাসিটা ভেসে উঠলো।