আমাদের সময়ে বুনো মোষেরা ধানক্ষেতে চড়ত, শুকিয়ে যাওয়া গাঙের বুকে বেড়ে উঠা দুর্বাঘাষের উপর ক্রিকেট খেলত অবাধ্য কিশোরেরা। বন্যায় প্লাবিত মাঠে মাছ ধরতে ভোররাতে বেড়িয়ে যেত বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
আমাদের সময়ে পুবাকাশে মঙ্গলগ্রহ দেখা যেত, লাল টুকটুকে ছোট্ট একটা তারা ;শুকতারাও সঙ্গ দিত তার।
আমাদের সময়ের প্রতিটি বর্ষার নিজস্ব সুবাস ছিল। প্রত্যেক সন্ধ্যায় রুপকথার আসর বসত অবনী'দের চালাঘরে। রাক্ষস-খোক্কস, রাজকুমারী সুবর্নরেখা, রাজকুমার দূষ্মন্ত,সুয়োরানী-দুয়োরানী আর টোনাটুনির গল্পেরা ভীড় জমাত। টিভি-রেডিও বিহীন সেই সব শৈশবে প্রতিটি গল্প আমাদের নিয়ে যেত অন্য ভূবনে। দীর্ঘশ্বাসে শেষ হত তারা। খাটের নীচে ভূত বসে থাকত !
ভর-দুপুরে অতন্দ্রিলার হাত ধরে পাড়ি জমাতাম তেপান্তরের মাঠে, খুঁজে বেড়াতাম ঘুমন্ত রাজকুমারীরর ডেরা অথবা ডোবার পাশের চড়ূই পাখির বাসা।
আমাদের সময়ে হাটু সমান পাটের ক্ষেতে ঘুড়ি উড়াতাম, রং বেরংএর ঘুড়ি ; সুতো কাটাকাটি।
আমাদের সময়ে আয়োজন করে শীত আসত।কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে চাদর মুড়ি দিয়ে আলগা রোদ্দুরে আমরা রোদ পোহাতাম। খেজুরের রসে বানানো হাজার রকমের পিঠা'র গন্ধে ম-ম করত চারদিক।
বিবর্নতায় ঝরে যাওয়া সব ফুলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পলাশ ফুটত মগডালে। ক্যানভাসে রংয়ের ঝুরি নিয়ে বসন্ত আসত।
সেই সময়ে সুকুমার রায়ের কবিতা ছিল, রবীবাবুর ছোটনদী ছিল, উপেন্দ্রদাদুর গল্প ছিল, খোলা আকাশ ছিল, আদিগন্ত প্রান্তর ছিল, কাল-বোশেখী ছিল;সাদা বক ছিল, ঘুমপাড়ানি গান ছিল!
ভালবাসা ছিল অন্যরকম, অন্য উৎসবে ; খেসারির মাঠে, হাহাকার ছড়ানো পূর্নিমায়, কদমের ফুলে, ফাগুনের গানে, জারুলের ছায়ায়, একগাদা সাদা শাপলায় !
আকা-বাকা মেঠোপথে বাবার হাত ধরে 'হাট করে' ফেরা হত প্রতি বিষ্যুদবার। স্বল্পযৌবনা রাতেই ঠাকুরমার কোলে ঘুমিয়ে পড়তাম আমরা, পুকুর-নদীতে দিনভর সাতার, মায়ের বকুনী,চাঁদনী রাতে দাদুনের মোটা কাচের চশমার ফাক দিয়ে চাঁদের মা বুড়িকে দেখা।
ইদিপাসের ডানায় ভর করে চলে গেছে আমাদের সময় টা, অতি সাধারন ভাললাগার শৈশব। এখনো মাঝে মধ্যে মাঝ রাত্রিতে জাহাজের হুইশেল কুহকের ডাক বলে ভুল হয়। কোন এক জলার ধারে শ্যাওড়া গাছের নীচে এক অশরীরি পরিবারের রান্না করা খিচুরির ঘ্রাণ পাই।
পার্কোলেটর থেকে মগভর্তি ক্যাপাচিনো, এসিটা একটু বাড়িয়ে দিই; আয়োজনের শীত শীত ভাব। পিসিতে বসি। ভার্চুয়াল অক্ষরে চলে আমার পরাবাস্তব শৈশবের গল্প।
পোর্থহোলে ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়া এসে আছড়ে পরে। অধিভৌতিক, ভিন্ন সভ্যতার বর্তমানে বসে অতীতের ছবি আঁকতে আমার মন্দ লাগে না !