সময়ের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ভালবাসার গল্পটা বা না হয় নাই বল্লাম শুধু এটুকু বলি, নিনবু সেন্ট্রালে জিওনি সুপার শপের অপরুপা চাইনিজ তরুনী সোফি তার মান্দারিন দুষিত ইংরেজিতে জানতে চাচ্ছিল " প্রেমের গল্পগুলো কিভাবে শেষ হয়? ".
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, "জানিনা, হঠাত এ প্রশ্ন কেন?".
সোফি, "এমনিই, তোমার চোখ দেখেই বোঝা যায় তুমি জানো না !!"
আসলেই তো কিভাবে শেষ হয় এইসব গল্প ? সিনেমা বা উপন্যাসে একটা হ্যাপি এন্ডিং টেনে দিয়েই তো খালাস ! কিন্তু পূর্নদৈর্ঘ্য জীবন তো শেষ হয় না। ঐসব হ্যাপি এন্ডিংয়ের পরেও অনেক তেতো স্ক্রিপ্ট থেকে যায়।
প্রথম গল্পের নায়ক নায়িকা দুজনেই বেকার, দুটি পরিবারের তীব্র বিবাদ। কিন্তু বাধ না মানা ভালবাসায় পালিয়ে বিয়ে করে তারা। পরিবার মেনে নেয় শেষমেষ, ছেলেটা প্রশিকা বা আশা টাইপ কোন এক এনজিওতে চাকরি জোটায়, মেয়েটা ব্র্যাকের এডুকেশন সিম্পোজিয়ামে ; অতলান্তিক ভালবাসাবাসির পর সুখের শুরু হওয়ার কথা ছিল এখানেই কিন্তু কেন জানি না, ঐ বাড়ির আশেপাশে ইদানিং মাঝরাত্রিতে চাপা কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। চুল ছেড়া, চুড়ির ঝনঝন শব্দ, লাথি, থাপ্পর..... জঘন্য।
গল্প লেখার ইচ্ছে হারিয়ে যায় আমার... :-(
দ্বিতীয় গল্পে মেয়েটি উচ্চশিক্ষিত, ছেলেটির মূলধন বলতে সততা, সে বেকার ; কোনরকমে গ্রাজুয়েশন শেষ করা পরিবারের বড় ছেলে। মেয়েটি পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও সিডিউসড প্রেমে অন্ধ হয়ে বিয়ে করে ছেলেটিকে। তারপর যখন সামান্যতম প্রাইভেসির অভাব, লো ক্লাস মেন্টালিটির মানুষের চলাফেরা চারপাশে, ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিস, ইমেজ সংকট তখন মেয়েটি ভালবাসার উল্টোপিঠ দেখতে পায়। কোনরকমে একটা প্রজেক্ট এ চাকরি জোটে ছেলেটির, সামান্য বেতন ; মেয়েটি তখন তাকে আলাদা হবার চাপ দেয়, উপশহরে একটা বাসা ভাড়া করে আবার ভাল বাসার স্বপ্ন বোনে ; কিন্তু পরিবারের প্রতি দ্বায়িত্ববোধ আটকে রাখে ছেলেটিকে। দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, এরই মাঝে ভালবাসা থুবরি খায় ডাস্টবিনে গত সপ্তাহের বাসি খাবারের সাথে। :-(
তৃতীয় গল্পটি দুটি মানুষের, একই সময়ে দুটি পরিবারের। মহাসাগরীয় ভালবাসা যেখানে ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রের প্রাচীর ভেঙে জয়ী হয়। নায়িকা অল্প বেতনের চাকরী নিয়ে তিলোত্তমা নগরীতে আসে। ছোট্ট একটা বাসা, একপাশে সাবলেট। ছোট্ট দুটো প্রাণী কিন্তু সারা ঘরময় ভালবাসা। কয়েক বছর আর্থিক দৈন্যতা ভালবাসাকে ছুঁতে পারে না। ঘর আলো করে আসে প্রথম সন্তান, সাথে সৌভাগ্য। আস্তে আস্তে সব হয়, বাড়ী, গাড়ী, টাকাপয়সা সব। কিন্তু সুর কেটে যায় বেহালার। আত্মিক দীনতায় চুপসে যায় ভালবাসা, উবে যায় ঘরময় সেই গন্ধ। রাতভর নায়কের ঘরে না ফেরা, অথবা সেইসব বৃষ্টিমুখর দিনগুলিতে যখন নায়িকার বড় বেশি মনে পড়ে হারানো দিনের গল্প, একটু পাশে পেতে ইচ্ছে করে তাকে, সে তখনও হয়তো ছুটছে অর্থের পিছনে। নায়িকা জানে তার নায়কের হৃদয় এখনো ভালবাসার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় কিন্তু সেই লগ্ন মিলে না। হাতভর্তি জোছনার মতো স্পর্শের বাইরেই থেকে যায়।
আমি আবার লেখার আগ্রহ হারাই :-(
এরকম হয় কেন তবে ? সেটা বোঝার জন্য খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন পরে না। ভালবাসা রকেট সায়েন্স না, সস্তা একটা ব্যাপার ; ইট্টু ভাবলেই উত্তর মেলে।
প্রথমেই যেটা আসে সেটা হলো এক্সপেকটেশানস লেভেল। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই ইমপার্ফেক্ট কিন্তু ঔ লেভেল আমাদের সুপার হিউমান টাইপ। এরেঞ্জড মেরিজে একটা স্বল্পপরিচিত বিপরীত লিঙের প্রতি যেটা আমাদের খুবই কম থাকে কিন্তু প্রেমিক/ প্রেমিকা নাম্নী প্রাণির নিকট যেটা থাকে আকাশ ছোঁয়া, তাই চুন থেকে পান খসলেই চেইন রিয়াকশন শুরু হয়ে যায়।
তারপর ফেটিগ নামক মারাত্মক একটা শব্দ । একে অন্যকে ইম্প্রেস করার প্রবনতা প্রথম দিকে খুব বেশি থাকে। যেটাতে অভ্যস্থ হয় দুজনেই কিন্তু জীবনের ঘোড়াদৌড়ে সেটা চালিয়ে যাওয়া দুরুহ হয়ে পরে। ইম্প্রেশন ফেটিগ। ফেটিভ শব্দটা অবশ্য ভালবাসার সাথেও যায়, প্রতিদিন আট্টা পাচটা ডে জবের মত একনাগারে ভালবাসতে বাসতে একসময় ফেটিগ আসে। ফিজিক্স বলে কথা, ফাজলামো না।
অতপর, আত্মিক বা মানসিক সংকট। আত্মিক সংকট টা কিছুটা কম্পেসেবল। এই সংকট নিয়ে পৃথিবীর সিংহভাগ কাপল জীবন কাটিয়ে দেয় নির্দ্বিধায়। কিন্তু আর্থিক সংকট রীতিমতো ফ্যাটাল। যে সংকটের সৃষ্ট বালুঝরে ভালবাসা ঘরের দরজা বা জানালা দিয়ে নয় ; ঘরদোর ভেঙেচুরেই পালায়। তবে এটাও কম বেশি কম্পেসেবল। সিলভার লাইনিং হইলো
ভালবাসার দ্রবনীয়তা এত বেশি যে যেকোন কিছুই কম্পেন্সেবল !!
আর শেষ কথা হলো 'ম্যাজিক' যেটা হারিয়ে যায় দীর্ঘসুত্রিতায়। কালারস, ক্রাউড, ডিপ রেড, সালসা, মিউজিক.... কোনকিছুতেই আর সেই ম্যাজিক আসে না । মূলকথা হলো, ভালবেসে ভাল থাকা বা সুখে থাকাটা বিলাসিতা, কষ্ট আর বিরহ হলো লেজিটিমেট নিয়ামক।
থিসিসে যেটা পাওয়া গেছে সেটা হলো প্রতি ২০ জনে দুইজনের লাভ এফেয়ার সত্যিকার হ্যাপি এন্ডিং দেখে মতান্তরে প্রতি ২০ জনে ১৮ জন !!
একদিন মরতে হবেই তারপরেও বেচে থাকা নিয়ে আমাদের যেমন আয়োজনের শেষ নেই, তেমনই সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছাড়াই আমরা ভালবাসাবাসি করি, করবো। স্ট্যাট বা এইসব থিসিসকে মধ্যাঙুলি দেখিয়ে।
পাদটীকা- ১:
এইটা কোন ডিপ্রেশিং বা গাইডলাইন মূলক লেখা না। মস্তিস্কের উর্বরতায় একটা পরীক্ষামূলক আউটলাইন !
বহুবার সিন্ধান্ত নিয়েছি এইসব ভালবাসা, বাল-ছাল নিয়ে আর চিন্তাভাবনা বা লেখালেখি করবো না, বাট ঘুরে ফিরে একজায়গাতেই আটকে যাই।তবে অবস্থার উন্নতি হয়েছে, সুস্থ খুব তাড়াতাড়িই হবো ইনাশাল্লাহ ।
পাদটীকা-২:
লেখাটিতে আমার কিছু পরিচিত ঘটনা ও চরিত্র ব্যবহার করেছি ; তবে কাউকে হেয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়নি। মানুষের প্রতি আমার ভালবাসা হুমায়ুন স্যারের মত না হলেও খুব একটা কম নয়। :-D