আমার বান্ধবীর তালিকাটা নাতিদীর্ঘ, এর মধ্যে একজন গতকাল হঠাত ফোন দিল।
"কিরে তুই কই ?"
"আমি বাড়ীতে।"
"তাহলে দশটা নাগাদ দেখা কর।"
"কেন?"
"গুরুতর কাজ আছে।"
ওর সাথে কি কাজ থাকতে পারে আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না।
১০ টায় গেলাম, প্রায় এক বছর পর দেখছি ওকে, কি মিষ্টি চেহারাটা ছিল ওর ।
কিন্তু শুয়োপোকা যে এরই মাঝে প্রজাপতি হয়ে গেছে,
শেই মায়াময়ী কিশোরী এখন পুরদস্তুর যুবতী।
বল্লাম, "বান্দা হাজির মহারানি !!"
"তোকে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে হবে ।"
"কোথায়?"
"বলছি, আগে যাবি কিনা বল ?"
"ওকে যাব।"
"এবার বল জায়গাটা কোথায় ?"
"গুড।"
বলেই সে হাঁটা শুরু করলো !
স্বয়ং ঈশ্বরও নাকি নারীর কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না , সেখানে কোথাকার ইউক্যারিওটিক নচ্ছার ।
হাঁটতে থাকলাম একসাথে ।
অনেকটা পথ হেঁটে উপশহরের একটা এনজিওর সামনে এসে থামল ও ।
ও আচ্ছা , ওর নামটাই বলা হয়নি ! ওর নাম তন্বী । অতপর তন্বী আমাকে নিয়ে গেল এনজিওর ভিতরে । এখানে ও কি কাজে আসতে পারে আমার মাথায় আসছিল না । সারা বাংলাদেশ জুড়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়েছে এসব এনজিও ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম , "এখানে তোর কি কাজ ?"
তন্বী বলল , "উত্তর দিব কিন্তু এর এগেনস্ট এ আর কোন প্রশ্ন হবে না।"
অলরাইট, বল
M.R. করাব, কি বুঝলি ? কিস্যু না !!
সত্যি বলতে এটা আমার বোঝার কথাও নয় , এবং বোঝা উচিতও নয় । কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে ব্যাপারটা জানতাম ।
M.R. হল Manstruation Regulation যাকে বৃহত্তর অর্থে Abortion ও বলা যেতে পারে । অনাকাংক্ষিত সন্তান ফিটাস থেকে গ্রোথ হওয়ার আগেই তা ফেলে দেওয়া এবং একই সাথে মেন্স সাইকেলে রেগুলারিটি আনাই এম আর ।
আমরা ভিতরে ঢুকলাম । একটি বেডরুমকে জোর করে অফিস বানাতে গিয়ে অদ্ভুত এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এনজিও কতৃপক্ষ । পারটেক্সের বেড়ার ওপাশে অফিসের বস, জোনাল ম্যানেজারের কক্ষ ।
বাইরে পুরো মুখে বসন্তের দাগ ভরা এপ্রোন পরা মহিলা পাশাপাশি ডেস্ক এ । এত কিছুর মাঝেও আমার বার বার মনে প্রশ্ন জাগছিল এরা একই চেহারার দুইটা মেয়ে কই পাইল !!
তন্বীর মনে হয় পূর্ব পরিচিত । একজন ভদ্রমহিলা এসে ওকে নিয়ে গেলেন আর আমাকে বললেন ঘন্টাদেড়েক লাগবে আপনি বরং বসুন ।অথচ রুমে বসার মত কোন আসবাব নেই । আমি বেরিয়ে আসলাম , গ্রীষ্মের দুপুর বড় বেশি উত্তপ্ত । আমার মাথার ভিতরে অসংখ্য প্রশ্ন ভীড় করে চলেছে ।
"কে ? কোথায় ? কিভাবে ? কেন ?
উত্তর জানা নাই !
এনজিওর ব্যাপারে বছর খানেক আগে একটা স্ট্যাট রিপোর্টে দেখেছিলাম এগুলির আয় মূলত স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের কিছু প্রজেক্ট, এম আর , হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন উচ্চমূল্যে বিক্রি সহ এধরনের কামকাজ । দেশের জনসংখ্যা হ্রাসে ইফোর্টের জুড়ি মেলা ভার ।
কিন্তু তন্বী কেন এখানে আসবে ?
শৈশব কৈশরের সেই বাধাহীন দুরন্তপনায় সে আমার পাশে ছিল । এরকমই দুপুরে ওকে রাজকন্যা ভেবে রুপকথার গল্পের খোঁজে বন বাদারে দৌড়েছি কত ! প্রয়োজনে- অপ্রয়োজনে ছুটে গেছি কতবার একে অপরের কাছে । ওকে না দেখলে ভাল্লাগত না একসময় , ওর সাথে মারামারি , ঝগড়াঝাটি না করলে ডালভাত মনে হত সেই সব দিন । তখন এসব আকর্ষনের মানে বুঝিনি । আমি চিরকালই স্লো, আমার ক্রমাগত দেরী হয়ে যায় । যখন বুঝলাম আমি ওকে কতটা ভালবাসি বা এই আকর্ষনকে ভালবাসা বলা হয় ততক্ষণে দুজনের মাঝে ব্যক্তিত্ববোধের নো ম্যানস ল্যান্ড, সৌজন্যতার লাইন অব কন্ট্রোল । যা টপকে বলা হয়ে উঠেনি আর !
তারপর.........
তারপর জীবনের প্রয়োজনে দূরত্ব বেড়েছে । আমরা জানতাম কতটা ভালবাসা জমা ছিল ভিতরে কিন্তু শেষমেশ অপ্রকাশ্যই থেকে গেল সব । অপূর্নতাকেই গ্রহন করে আমরা ক্রমাগত জিতে যেতে চাই ।
ওর কাজ শেষ; বেড়িয়ে এসেছে । চুলগুলো কেমন উষ্কখুষ্ক, লিপস্টিক ঠোটের কোনায় লেপ্টে গেছে ।
ঠিকমত হাটতে পারছে না ও । পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে । আমি ওকে ধরতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, নিজের ঝড়গুলো মানুষ নিজেই মোকাবেলা করুক ।
খুব কাছাকাছি হাটছি দুজনে, কোন ভনিতা ছাড়াই ও আমার হাতট ধরল শক্ত করে । বলল , "এটাই সুবর্ন সুযোগ, আর হয়তো কখনো আমার হাতটা ধরতে পারবি না ।" আমার খুব ভাল লাগতে লাগল, খুবই। পৃথিবীর এইসব মহামারী সুখগুলো কেন জানি শ্বাসরুদ্ধকর হয়।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম," তন্বী, তুই আমাকে কেন আনলি ?"
ও বলল , " তুই চিরকালই বুদ্ধু থেকে গেলি, তুই নিজেও জানিস না তুই কতটা সহজলভ্য ; আর পৃথিবীতে আমার পাপের ভাগী নেওয়ার মত তুই ছাড়া আর কেউ নেই ।"
আমি বলেই ফেললাম শেষমেশ, " আমার কেন জানি মনে হয় আমি তোকে ভালোবাসি। "
ও হাসতে শুরু করলে , হাসলে এখনো ওর মুখে টোল পড়ে । হাসি থামিয়ে বলল
" তাই নাকি ? সস্তা ডায়ালগ কপাচাস না ; বিচ্ছিরি সব প্রেমের কবিতা লেখা ছাড়া তোর আর কোন সামর্থ্যই নেই সেটা আমি ভালভাবেই জানি । কোথায় ছিলি এদ্দিন ?"
কথা গোছাতে পারলাম না আমি ; বলার মত কিছু খুঁজেও পেলাম না
ওর হাত ছেড়ে দিলাম । ও খুব দ্রুত হাটছে ; আমি ক্রমাগত পিছনে পরে যাচ্ছি ।
কাকফাটা দুপুর ; কোথাও বাতাস নি একটুকু । পিচঢালা রাস্তা অঙ্গারের মত উত্তপ্ত । হাইহিলে দুলে দুলে হাঁটছে তন্বী ।ওর চোয়ালের পাশে ঘাম অথবা চোখের জল চিকচিক করছে ।
ওর সাথে আমার যতই দূরত্ব বাড়ছে আমি অদ্ভুত এক বিভ্রমে আটকে যাচ্ছি । কিছুক্ষণ পর মনে হলো ও আসলে তন্বী নয় , অন্য একটা মেয়ে যার হাসির শব্দ কানে বাজে ; ক্রমাগত কথা বলে যে মাতিয়ে রাখে চারপাশ । যে হঠাত করেই হারিয়ে গেছে সবজায়গা থেকে । নাগরিক জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে তাকে কবে যে ভালবেসে ফেলেছিলাম নিজেও জানি না ।
আরো দূরে সরে যাচ্ছে তন্বী, আমি আরো বিভ্রান্ত; আমার মনে হতে লাগলো তন্বী, আনিলা, সুবর্না, দিপু বা ঐরী আলাদা কোন মেয়ে নয় । পৃথিবীর সব নারীই এক ।
এরই মধ্যে কোথেক্কে লিলুয়া বাতাস এসে জুড়িয়ে দিল আমাকে । থমকে তাকিয়ে দেখি সামনের রাস্তায় তন্বী নেই ।উত্তপ্ত দুপুরে বস্তাপচা দর্শন কে সঙ্গী করে আমি হাটতেই থাকি ; হাটতে আমার মন্দ লাগেনা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৪০