তৃতীয়বারের মত তাকে জিজ্ঞস করলাম " শফি সাহেব, জীবনে কতটি বসন্ত দেখেছেন আপনি ?"
"সতেরটি স্যার, তারপর থেকে গ্রীষ্ম আর বর্ষার প্রচণ্ডতায় হারিয়ে ফেলেছি সবকিছু"
ছেলেটির চেহারায় কোন বিশেষ্বত্ব নেই , আর দু-পাচটা মধ্যবিত্ত যুবকের মতই; সদ্য সেভ করা আফটার সেভের গন্ধ, বুকপকেটে কিছু খুচরো টাকা বেরিয়ে আছে আর আচরনে আছে অন্যধরনের সারল্য ।
" তো আপনার বসন্তের শেষ স্মৃতিটুকু বলতে পারবেন ? "
" স্যার, আগষ্টের কোন এক ভোররাতে মহাদেব সাহার কবিতা , যদ্দুর মন পরে"
"আমার কাছে আসতে কে বল্ল আপনাকে? , আমি কিছুই করতে পারব না"
" ওরাই তো বল্ল স্যার, কিছু একটা করেন ; আপনি পারবেন "
ওর আত্মবিশ্বাসে আমি চমকে গেলাম এবং হঠাত করেই যেন ওর শীতে কুচকে যাওয়া হাতের চামড়ায় আমি স্বল্পপরিচিত এক রমনীর উষ্ণতা টের পেলাম ।
আমার আমিত্ত্বের প্রাচীর আরো দৃঢ় হলো, নিজেকে হারপুনবিদ্ধ হাঙ্গর মনে হতে লাগল । ঈর্ষার ঘোরে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করল ঐ দুটি হাত আর প্রতিটি কোষ যাতে উষ্ণতা মিশে আছে ।
কিন্তু তা সম্ভব না। ইচ্ছেগুলির মত বাস্তবতা ফ্লাট টায়ারে চলে না।
অতপর, শফিকে নিয়ে গেলাম "হাউজ অব গডস" এর তেত্রিশ চলায় ; ঈশ্বরের কাছে ।
উপরে উঠতে গিয়ে এলিভেটরে বিশ্বাসের মেটালিক প্লাটফর্ম বার বার কেপে উঠছিল । সংশয়ের প্রতিটি ফ্লোরে হাজার লোকের সমাগমে চলছিল অস্বিত্বহীনতার কনসার্ট ।
অবশেষে রহস্যের শেষ দরজা পেরিয়ে হাস্যোজ্জ্বল ঈশ্বরের দেখা পেলাম । পুরোটা সময় শফির য়,আড়ষ্টতা আমার নজর এড়াচ্ছিল না । খুব মায়া হচ্ছিল ওর জন্য ।
শফির বসন্তহীনতার কথা বললাম ঈশ্বরকে ।
তার হাসি বিস্তৃত হলো , তিনি জিজ্ঞসে করলেন " জিয়ান, তুমিই বলো আমি কি ?"
আমি বললাম "স্যার, আপনি আমার বিশ্বাস, আমার বিভ্রম"
"আর তুমি ?"
"আমি সম্ভাবনা, আমি গল্পকার,আমি প্যাসিফিস্ট আর আমি পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ"
তিনি বললেন " আমরা এখানে কোন সঞ্চিত বসন্ত রাখি না, তোমার কাছে সাহায্যপ্রার্থীকে তোমার নিজস্বতা দিয়েই সাহায্য করতে হবে; আমার মত বিভ্রমে তুমি কেনই বা বিশ্বাস করবে ?"
হটাত নিজেকে আমি সংশয়াবাদীদের দলে আবিস্কার করলাম; এত আশা করে ছুটে আসা যুবককে নিরাশ করতে ইচ্ছে করছিল না । ওর চোখে আমি জীবনের গাঢ়ত্ব দেখলাম ; দেখলাম প্রতিটি অলিন্দ-নিলয়ে অন্য কারো অস্তিত্ব । ওর বসন্ত বড়ই প্রয়োজন !!
চরমভাবাপন্ন গ্রীষ্মের উষ্ণতায় আমি ছুটছি । আমার নিজস্ব বসন্তগুলো ওকে দিয়ে দিলাম শেষমেশ । খরতাপ আমার মন্দ লাগে ; তবু মানুষকে নিরাশ করতে ভয় পাই ।
নিজের নিরাশাগুলো নয়তো ছিন্নমূলের দলেই যাক । তবু এইসব আগন্তুকের সুখগুলোকে নীল ফ্রেমে জমা পরতে দেয়া চলে না । আমি জানি সামনে শীত আসছে , জমাকালো শীত ; তুষারে ছেয়ে যাবে যাবে আজকের প্রতিটি কাকফাটা রোদ্দুর ।
বর্ষায় ভিজে যাবে অপ্রাপ্তির ধুলো ; বাঁচার জন্য বসন্তের খুব একটা প্রয়োজনের পড়ে না । ঈশ্বর নামক ভদ্রলোকের কাছে এক জীবনে একটা উইন্টার ধার করে নিলেই হলো । একটি বিশেষ্বত্বহীন উইন্টার অথবা একটি "উইন্টার অব ডিসকন্টেন্ট" ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৫