(শিয়ালদহগামী দার্জিলিং মেল মিনিট পনেরো হলো জলপাইগুড়ি স্টেশন ছেড়েছে; গাছ, টিন-সিমেন্টের একচালা, দোচালা বাড়ির সার সবুজ মাঠগুলো পিছলে সরে যাচ্ছে। সূর্যদেব পাটে যাচ্ছেন, লালচে বেগুনি দিগন্ত ধীরে ধীরে কালো হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রথম শ্রেণীর কামরাটিতে যাত্রীসংখ্যা দুই, ট্যুরিস্ট সিজন নয় বলে ট্রেনে লোকসমাগমও নেই। একরঙা নীল হাফশার্ট, কালো প্যান্ট আর কালো ফ্রেমের চশমা পরা একটি মাঝবয়সী ভদ্রলোক মন দিয়ে বই পড়ছিলেন, আর আরেকজন হলদিবাড়ি স্টেশন থেকেই বাঙ্কে চড়ে ঘুম দিয়েছেন।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর দ্বিতীয় ভদ্রলোকের ঘুম ভাঙল। ধূসর সাফারি স্যুট পরা প্রৌঢ় লোকটি গায়ের পাতলা কাঁথা সরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে যখন নীচে নামলেন ততক্ষণে রাত নেমে গেছে, প্রথম ভদ্রলোক বই পাশে রেখে ঝিমোচ্ছেন।
প্রথম ভদ্রলোককে দেখে দ্বিতীয়জন কয়েক মুহুর্ত চোখ কুঁচকে চেয়ে রইলেন। পরক্ষণেই উপচে পড়া উত্তেজিত কণ্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।)
২য়: আরে, আপনি এখানে!
(ফাঁকা কামরায় এমন চড়া গমগমে গলা শুনে আধ-ঘুমন্ত প্রথম ভদ্রলোক ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে চোখ চাইলেন)
১ম: আপনি...আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
২য়: আরে ভাইয়া, চোখটা ভালো করে রগড়ে দেখুন। সেই যে অনেক বছর আগে কলকাতা ফিরতি ট্রেন আসতে লেট হচ্ছিল বলে ওয়েটিংরুমে আপনি, আপনার একটি আত্মীয় আর আমি- তিনজনে জড়ো হয়েছিলাম, ভুলে গেলেন?
(প্রথম ভদ্রলোক তখন একটু একটু করে সচেতন হয়ে উঠছেন। শেষে তিনিও উত্তেজনায় আনন্দ মেশানো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন)
১ম: দেখেছেন, একদম চিনতে পারিনি! তখন চোগা-চাপকান পরেছিলেন, সেজন্যই বোধ হয় সাফারি-স্যুটে ধাঁধাঁ লেগে গিয়েছে!
(দু'জনেই হো হো করে হেসে উঠলেন)
২য়: কিন্তু ভাইয়া, সেদিন আপনার নামটি কিন্তু জানা হয়নি। যদি আপত্তি না থাকে তবে আপনার নামটি আজ বলবেন?
১ম: আপত্তি কীসের! আমার নাম জয়ন্ত সেন। আপনার নামটিও কিন্তু কামরা ভিন্ন হওয়াতে আর জানা হয়ে ওঠেনি।
২য়: আমি ইউসুফ হোসেন। সরকারের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আজকাল শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছি।
জয়ন্ত (১ম): বেশ বেশ! সেবারেও রেলে দেখা, এবারেও তা-ই। কেমন কাকতালীয় বলুন দেখি?
ইউসুফ(২য়): যা বলেছেন, আশ্চর্য যোগাযোগ বটে! তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
জয়ন্ত: জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যাচ্ছি। আপনার গন্তব্য?
ইউসুফ: একেই বলে যোগাযোগ! আমিও তো ঠাকুরবাড়ির যাত্রী, রবিবাবুর দর্শনপ্রার্থী!
জয়ন্তখুশি হয়ে) শেয়াল বাঁয়ে করে বেরিয়েছিলুম বোধ হয়, সহযাত্রী পেয়ে গেলুম!
(ক্ষণিক নীরবতার পর)
আচ্ছা ইউসুফ ভাই, একটি বিষয় জানতে বড় কৌতূহল হচ্ছে। সেই যে সেবারে বলছিলেন, তুলোর মাশুল কালেক্টর জীবনে একটি রহস্যময় প্রাসাদে কিছুদিন বাস করেছিলেন, সে গল্পটা কিন্তু শেষ করেননি।
(মাথা নিচু করে ইউসুফ সাহেব স্বগত হাসলেন)
ইউসুফ: সেই ইরানি নায়িকাটির গল্প, সেটাই বাকি ছিল।
জয়ন্ত: মনে আছে তাহলে!
ইউসুফ: (হেসে) কী করে ভুলি বলুন?
জয়ন্ত: আজ এদ্দিন বাদে আপনাকে পেয়েছি যখন, গল্প না শুনে আর ছাড়ছি না!
ইউসুফ: আচ্ছা, আপনি কি আমার সেই কাহিনীটি সত্য বলে মেনেছিলেন? বা, এখন মানেন?
জয়ন্ত: আমি...মানে…
ইউসুফ: (মৃদু হেসে) গুল ভেবেছিলেন, ঠিক কিনা?
জয়ন্ত: আরে না না, তা নয়। তবে কী, কেমন যেন ধাঁধাঁ লেগে গিয়েছিল।
ইউসুফ: (মুচকি হেসে) সত্য বলেই মানেন না, তবে এখন কেন বাকিটা বলবো বলুন তো?
জয়ন্ত: (ব্যতিব্যস্ত হয়ে) না না ইউসুফ ভাই, রাগ করবেন না প্লিজ। কাহিনীটা কিন্তু আমি সত্যিই শুনতে চাই। বিশেষ করে আপনি ঠিক কীভাবে সে প্রাসাদের গ্রাস থেকে মুক্তি পেলেন, জানতে সত্যিই বড় ইচ্ছে হচ্ছে।
(খানিক নীরব থেকে জয়ন্তবাবুকে নিরীক্ষণ করলেন ইউসুফ হোসেন। তাঁর ঠোঁটে হাসি ঝুলে রইলো।)
ইউসুফ: বহুত সেয়ানা আছেন আপনি। বিশ্বাস করেন না, অথচ ফাঁকি দিয়ে গল্প শুনে নেবার মতলব। যাক, শিয়ালদা পৌঁছতে সেই শেষরাত, গল্পেই কাটাই!
জয়ন্ত: (স্বস্তি ফিরে পেয়ে) হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই বলতে চাইছিলাম।
(একঘেঁয়ে আওয়াজ আর মৃদু তালে চলমান রেলগাড়ির বাইরে ঘনিয়ে আসা রাতের দিকে বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন ইউসুফ সাহেব। তারপর নীরবতা ভাঙলেন)
ইউসুফ: প্রাসাদ ছেড়ে অফিস ঘরে ঠাঁই নেয়ার মতলব করার পরও যখন প্রাসাদ ছাড়তে পারলাম না, তখন অফিসের বুড়ো কেরানী করিম খাঁ আমায় সেই প্রাসাদের কবল থেকে মুক্তি পাবার উপায় বললো, আর বললো ভাগ্যের ফেরে সেই প্রাসাদে এসে পড়া এক ইরানি ক্রীতদাসীর গল্প। সেই গল্পটাই আগে বলি।
দ্বিতীয় শা-মামুদ বরীচের সেই শ্বেতপাথরের আশ্চর্যসুন্দর প্রাসাদটি ভোগবিলাসের হেতু নির্মাণ করিয়েছিলেন। সন্ধ্যে নামলেই এককালে সে প্রাসাদে শ'য়ে শ'য়ে ঝাড়বাতি জ্বলে উঠতো, গজলের মূর্ছনায় প্রাসাদের চারধারের বাতাস মাতাল হতো, পারসি আর ইরানি হুরীদের রূপের জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যেত আর আতরের গন্ধে পুরো দরবারঘর মশগুল হয়ে উঠত।
জয়ন্ত: কী সাংঘাতিক! আগেরবারেও রীতিমত থ্রিলড হয়েছিলুম, এবারেও বেশ বুঝতে পারছি থ্রিলটা পুরোনো হয়নি।
ইউসুফ: (হেসে) এ প্রাসাদটাই এমন, চিরযৌবনবতী বলা চলে। তো, যে রূপসীদের কথা বললাম, তারা সকলেই ছিল ক্রীতদাসী। সুলতানের দরবারে এমন চারশো দাসী ছিল, প্রত্যেকেই অপরূপা। তবে এত শত অপরূপার মাঝেও একটি বিশেষ দাসীর প্রতি সুলতানের নেকনজর ছিল। আমায় পাগল করে দেয়া ইরানি বণিতাটি সে-ই।
জয়ন্ত: তার নাম জানতে পেরেছিলেন?
ইউসুফ: করিম খাঁ বলেছিল তার নাম গুলবাহার। আসল নাম ছিল জুলেখা, সুলতান আদর করে ডাকতেন গুলবাহার বলে।
জয়ন্ত: তারপর?
ইউসুফ: এই ইরানি রূপসীটির কাহিনী বরীচ অঞ্চলে বেশ প্রচলিত। ইরানের খোরাসান প্রদেশের এক গরীবঘরে তার জন্ম। বাপ-মা খেতে না পেয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে দালালের হাতে মেয়েকে তুলে দেয়, তার বয়স তখন ছয়। সেই দালাল মেয়েটিকে তেহরানের এক ধনী ব্যবসায়ীর ঘরে দাসী হিসেবে বিক্রি করে। ছ' বছরের বাচ্চা মেয়েটি কুয়ো থেকে পানি তোলার কাজ যেমন করতো, তেমনই রাতের আঁধারে মালিকের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াও তার জন্য বাধ্যকতামূলক ছিল।
(একটানা কথাগুলো বলে দম নিতে থামলেন ইউসুফ সাহেব। খানিক বাদে ট্রেনের মৃদুমন্থর তালের সাথে সঙ্গতি রেখে ফের আরম্ভ করলেন)
ইউসুফ: তার জীবন হয়তো তেহরানের সেই অট্টালিকার অন্ধকূপেই কেটে যেতো, যদি না সে প্রেমে পড়তো।
জয়ন্ত: এ তো দেখছি রীতিমত রোম্যান্টিক টার্ন!
ইউসুফ: (হেসে) জয়ন্তবাবু, আপনি এখনো একে নিছক গল্প ভাবছেন! অথচ পুরো সত্য ঘটনা বলছি।
জয়ন্ত: (অপ্রতিভ হয়ে) আরে না না! তারপরে কী হলো বলুন তো?
ইউসুফ: জুলেখা প্রেমে পড়েছিল সেই বাড়িরই একটি চাকরের, নাম আব্দুল্লাহ। মালিকের সম্মতি বিনা ক্রীতদাস-দাসীদের বিয়ে ছিল নিষিদ্ধ, তাই দালালের সাহায্যে পালিয়ে তারা চলে আসে ভারতবর্ষে। যে নতুন দেশে নতুন শুরুর আশায় তারা এসেছিল, সেই দেশই তাদের জীবনে চির কালরাত্রি ডেকে আনে। ভারতবর্ষ তাদের বিচ্ছেদ ঘটায়।
জয়ন্ত: কীভাবে হলো সেই বিচ্ছেদ?
ইউসুফ: বন্দরে নামার পরেই দালালটি তার এক পরিচিত খদ্দেরের কাছে আব্দুল্লাহকে বিক্রি করে আর জুলেখাকে নিয়ে যায় বরীচের ক্রীতদাস-দাসীর হাটে। সেখানে চড়ামূল্যে খোদ সুলতানের হারেমে বিক্রির ব্যবস্থা হয় জুলেখার, ভিনদেশে শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। অথচ দালালটি নাকি তাদের একসাথে থাকবার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
জয়ন্ত: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হুম। তারপর?
ইউসুফ: তারপর আর কী! ঠাঁট-বাঁট আর ঝাড়বাতির রোশনাই কি কোনোদিন জাহান্নামকে জান্নাত করতে পারে বলুন? দ্বিতীয় শা-মামুদের হেরেমও তো আদতে সেই জাহান্নাম। বাছাই করে আনা রূপসীদের গান-বাজনার আড়ালে চলত উন্মত্ত সম্ভোগ। কী আশ্চর্য সুন্দর প্রাসাদ শ্বেতপাথরের পবিত্রতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ...ওর প্রত্যেকটি পাথরের তলায় আজও অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস আর অভিশাপ জমা হয়ে আছে। আমি সেবারে শুনেছিলাম , রাতেরবেলায় সেখানকার বাতাসে কার বুকফাটা কান্না যেন ভেসে বেড়ায়…
(ইউসুফ সাহেব খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, জয়ন্তবাবু খেই ধরিয়ে দিলেন)
জয়ন্ত: জুলেখার কী হল?
(ইউসুফ সাহেবের সম্বিৎ ফিরল। ঈষৎ হেসে ফের কাহিনীসূত্র ধরলেন)
ইউসুফ: জুলেখা আজকাল গুলবাহার হয়েছে, সুলতানের পেয়ারী। জনশ্রুতি, সুলতানের ঔরসে সে একটি সন্তান জন্ম দেয়। উপপত্নীর গর্ভে সন্তানের জন্ম প্রাসাদে কোনো বিরল ঘটনা নয়। শিশুটিকে আঁকড়ে জুলেখাও বাঁচতেই চেয়েছিল, কিন্তু...নিয়তি যে অন্ধ!
জয়ন্ত: কী হয়েছিল?
ইউসুফ: এক সকালে ঘুম ভেঙে উঠে জুলেখা আবিষ্কার করে তার সন্তান পাশে নেই। পুরো প্রাসাদ তন্নতন্ন করেও বাচ্চাটিকে না পেয়ে শেষকালে সে সুলতানের পায়ে পড়ে। কিন্তু সে চেষ্টাও বিফলে যায়, উল্টো ভরা রাজদরবারে প্রবেশের দায়ে তাকে প্রাসাদেরই একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। সম্ভবত, কোণের যে ছোট্ট ঘরখানায় আমি থাকতাম, সেখানেই।
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পর অন্য একটি দাসীর মারফত জুলেখা জানতে পারে, সুলতানের ছোট বেগম শিশুটিকে চুরি করে গোপনে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলেন। সুলতানের গুলবাহার আসক্তিই সম্ভবত বেগমের ঈর্ষা উস্কে দিয়েছিল।
(ইউসুফ সাহেব থামলেন। প্রায় এক মিনিটের নিস্তব্ধতার পর ঘোরলাগা কণ্ঠে জয়ন্তবাবু সরব হলেন)
জয়ন্ত: তারপর?
ইউসুফ: এ ঘটনা জানার পরেই জুলেখার মানসিক বিকৃতি দেখা দেয় এবং... শেষে একদিন সেই ছোট্ট কোণের ঘরটিতেই সে বিষপানে আত্মহত্যা করে। সেই প্রাসাদের অবিসংবাদী সুন্দরী গায়িকা-নর্তকীদের ভেতরের রক্তাক্ত বিকৃত ক্ষত যেন জুলেখার মৃতদেহে রক্তমাংসের রূপ ধরে দেখা দিয়েছিল।
জয়ন্ত: (খানিক নীরবতার পর) ইউসুফ ভাই, সেই পাগলা মেহের আলীর কী হলো, কোনো খোঁজ পেয়েছিলেন?
ইউসুফ: করিম খাঁ'র মারফত জেনেছিলাম বছর কয়েক হলো সে মারা গেছে। মৃত্যুর আগে অব্দি সে কেবল "তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়" বলে বেড়াতো। ইন ফ্যাক্ট, সেই প্রাসাদের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন হঠাৎ সে মাটিতে পড়ে যায়, আর ওঠেনি। সম্ভবত হার্ট ফেল।
(ইউসুফ সাহেব অন্যমনস্কভাবে জানালার বাইরে চাইলেন)
ইদানিং মনে হয়, কী প্রচণ্ড সত্য উচ্চারণ করেছিল মেহের আলী!
জয়ন্ত: (বিস্মিত হয়ে) এই পাগলের প্রলাপে আবার কী খুঁজে পেলেন?
ইউসুফ: (করুণ হেসে) আগেরবারে বলেছিলাম, সেই প্রাসাদে রীতিমত আমার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি হয়েছিল। দিনের আলোয় আমি সাড়ে চারশো টাকা মাইনের তুলোর মাশুল কালেক্টর ইউসুফ হোসেন হয়ে থাকতাম, কিন্তু সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে আসার পর থেকেই নিজেকে সুলতান গোছের কেউ ভাবতে শুরু করতাম। আর, সেই ইরানি রূপসীর অবসেশনে নিজেকে সাজাতাম, আতর মাখতাম। শুধু তাকেই বা দোষ দিচ্ছি কেন, গোটা প্রাসাদ জুড়েই তো ছড়িয়ে ছিল এই অবসেশন, মোহ।
(কামরাজোড়া অখণ্ড নীরবতা, অবিরাম ছেদ ঘটিয়ে চলছে কেবল ট্রেনের একঘেঁয়ে ঘটঘট ঘটঘট শব্দ)
জয়ন্ত: আপনি বলতে চাইছেন যে মেহের আলীর প্রলাপে সেই অবসেশনেরই বিরোধিতা আছে, তাইতো?
ইউসুফ: তাই নয় কী? এই যে সর্বনাশের মোহ, এই মোহেই তো সে পাগলা মেহের আলী হয়ে উঠলো। গোটা জগৎজুড়ে ছড়িয়ে আছে এই মোহ, এর দুর্দমনীয় টানেই তো আদম-হাওয়া থেকে আমাদের সকলেরই জোয়ার-ভাঁটা হয়ে চলেছে।
জয়ন্ত: কীভাবে?
ইউসুফ: সবটাই তো মোহ, জয়ন্তবাবু। রাজনৈতিক আদর্শের মোহ, ধর্মীয় আদর্শের মোহ, ক্ষমতার মোহ একাকার হয়ে আজকাল মানুষ জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে। মন্দির-মসজিদ, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দিনদিন কেমন যেন মানুষের অবসেশনের রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে উঠছে। কে জানে, এক সময় হয়তো শুধু এগুলোই থাকবে, মানুষকেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
(ইউসুফ সাহেব হাসলেন)
জয়ন্ত: বুঝতে পারছি।
ইউসুফ: আবার দেখুন, জুলেখা, ওরফে গুলবাহারের জীবনটাই যদি দেখি, সেও কিন্তু এই ফাঁদের বাইরে নয়। তার প্রেমটা হয়তো মোহ ছিল না, ছেলেটিও তাকে স্রেফ মোহগ্রস্ত করতে চায়নি বিশ্বাস করি, কিন্তু নতুন দেশে এলেই সব সমস্যার সমাধান হবে এমন ভাবা, এও তো মোহই বৈকি! আবার তার সেই ইরানি সওদাগর মালিক, এদিকে সুলতান- এঁদের আবার ছিল ক্ষমতার মোহ। ক্ষমতার জোরে একটি বাচ্চা মেয়েকে শয্যাসঙ্গিনী করা অথবা অবাধ সম্ভোগ- এগুলোও আরেক জাতের মোহ। বুঝলেন, এ নিয়ে বলতে গেলে গোটা রাতেও শেষ হবে না। আমরা সবাই-ই মোহের চশমা পরে পৃথিবীটা দেখি আর ভাবি, আমিই সেরা, আমিই ঠিক। আমাদের ইনসিকিওরিটি থেকেই ক্লাস, সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি ইত্যাদি বানিয়ে নিজেকে অনেক ক্ষমতাধর প্রমাণ করতে চাই, "য পলায়তি স জীবতি" নীতি মেনে নিজের থেকে পালাতে চাই, নার্সিসিজমকে উস্কে দিতেই এসব স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদির নিরাপদ আশ্রয়ে বসে থাকতে ভালোবাসি। (খানিক বিরতির পর) আদতে তো মানুষ নার্সিসিস্ট, বিনয় তো সভ্যতার নকল পলিশ।
(ইউসুফ হোসেন থামলেন। জয়ন্তবাবু ট্রেনের বাইরে রাতের দিকে চেয়ে রইলেন। খানিক বাদে কী মনে হতে ইউসুফ সাহেবের দিকে ফিরে তাকালেন)
জয়ন্ত: শেষ কথাটা কী আমায় বললেন? আমি কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই বিশ্বাস করেছি, অন্তত এখন বিনয় করছি না!
ইউসুফ: (মৃদু হেসে) বেশ বেশ! না, আপনাকে কিছু বলিনি, ইনসিকিওর হচ্ছেন কেন? তবে কিনা, "There are many things in heaven and earth, Horatio", আগেরবারেও বলেছিলাম, যদিও খানিক ভিন্ন প্রসঙ্গে। কত ব্যাপার আমরা আষাঢ়ে বলে উড়িয়ে দিই, অথচ...সেগুলো ঘটে যায়, এই যা!
(মাঝরাত পেরিয়ে গেছে ঘণ্টাদেড়েক হলো,ট্রেন গন্তব্য থেকে মিনিট দশেক দূরত্বে চলে এসেছে। জয়ন্তবাবু বাংক থেকে ট্র্যাভেল ব্যাগ নামানোর তোড়জোড় করছেন, ইউসুফ সাহেবও বিছানাপত্র বেঁধে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন। কী মনে হতে জয়ন্ত সেন ফিরে তাকালেন।)
জয়ন্ত: আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব কিন্তু পাইনি।
ইউসুফ: (হেসে) অবশ্যই দেবো। চলুন আগে প্ল্যাটফর্মে নামি।
(ক্রমশ মন্থর গতিতে ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে এসে থামল। দু'জনে ব্যাগপত্র হাতে কামরা থেকে নেমে পড়লেন, যাত্রীর ভিড় কম থাকায় প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। সেই প্রায় ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে মাথার ওপর মাঝরাত পেরোনো আকাশ নিয়ে দুই ভদ্রলোক অলস মন্থর গতিতে হাঁটতে লাগলেন)
ইউসুফ: করিম খাঁ আমায় বলেছিল, প্রাসাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার একটিমাত্র উপায় আছে আর সেটা হলো...গুলবাহারের ভালোবাসাকে তার কাছে ফিরিয়ে দেয়া।
জয়ন্ত: অর্থাৎ?
ইউসুফ: অর্থাৎ আব্দুল্লাহ, যার সাথে গুলবাহার ভারতবর্ষে পালিয়ে এসেছিল, তাকে ফিরিয়ে দেয়া।
জয়ন্ত: এ তো অসম্ভব! সুদূর ইরান থেকে মধ্যযুগীয় একটি ক্রীতদাসের ঠিকানা কী করে বের করলেন?
ইউসুফ: (মৃদু হেসে) বের করিনি, সম্ভবও নয়। তবে আমায় একটু রিস্ক নিতে হয়েছে।
জয়ন্ত: কীরকম?
ইউসুফ: করিম খাঁ বলেছিল, গুলবাহার তার প্রেমিকের অপেক্ষায় তৃষিত হয়ে আছে। কাজেই তার কাছে সেই প্রেমিকের বেশেই যেতে হবে।
জয়ন্ত: তারপর?
ইউসুফ: সেবারে বলেছিলাম, প্রাসাদ ছেড়ে আসার সংকল্পের রাতেই যখন আবার প্রাসাদে গেলাম, সে রাতে ভয়ানক ঝড়-বৃষ্টি ছিল। তার মাঝেই সমস্ত রাতজুড়ে সে প্রাসাদে চলছিল এক অশরীরী নারীর পাগলপ্রায় চিৎকার, অট্টহাসি, বুকফাটা আর্তনাদ। আমি আবার অনুতপ্ত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে আমি প্রাসাদ ছেড়ে যাওয়াতেই এই ভয়ানক অভিমান। যাই হোক, পরদিন ভোরে করিম খাঁ'র কথা শুনে শেষমেশ স্থির করলাম আব্দুল্লাহ'র বেশেই প্রাসাদে যাবো। নইলে একদিন আমার পরিণতিও মেহের আলীর মতোই হবে।
জয়ন্ত: আব্দুল্লাহ'র চেহারা, বর্ণনা…
ইউসুফ: কিচ্ছু জানতাম না ভাইয়া, কিচ্ছুটি না। তবে করিম খাঁ'র কথা শুনে প্রাসাদে ফেরত গিয়ে তন্নতন্ন করে প্রত্যেকটা ঘরে খুঁজেছি, যদি কিছু হদিশ মেলে। শেষে আমার নিজের ঘরটিতেই হদিশ পেলাম। আয়নার পেছনে।
জয়ন্ত: কী পেলেন?
ইউসুফ: একটা হাতে আঁকা ছবি। পাকা হাতের নয়, তবে চেহারাটুকু উদ্ধার করা যায়। বেশভূষা দেখে মনে হলো একটি মধ্যযুগীয় ক্রীতদাস, সুদর্শন।
( খানিক নীরবতা)
ছবিটা হাতে করে আমি আবার করিম খাঁ'র কাছে ফেরত গেলাম। সে দেখেই বললো, এ-ই আব্দুল্লাহ। তার কোনো এক পূর্বপুরুষ সুলতানের দরবারে কর্মচারী ছিল, পারিবারিক সূত্রেই সে শুনেছিল সেই প্রাসাদের কোথাও গুলবাহারের প্রেমিকের ছবি আছে। দু'য়ে দু'য়ে চার মিলে গেল।
জয়ন্ত: আপনি তারপরে কী করলেন?
ইউসুফ: সন্ধ্যার পর করিম খাঁকে নিয়ে আমি আবার সে প্রাসাদে গেলাম। তবে এবার সাজসজ্জা করে, প্রস্তুত হয়ে। মাথায় ফেজ, বুকখোলা হাতাকাটা কোর্তা, মলিন পুরোনো শালওয়ার। এ সবই করিম খাঁ'র সেই পূর্বপুরুষের কাপড়চোপড়। সব কাপড় গায়ে চড়িয়ে, সরু মোচ লাগিয়ে আয়নায় দেখে মনে হলো, ছবিটার সাথে মিল পাচ্ছি। বুড়ো বাইরে পাহারায় রইলো, আমি বলেছিলাম দরকার নেই, তাও একা ছাড়তে চাইলো না। আমি একলা প্রাসাদে ঢুকলাম।
জয়ন্ত: সাসপেন্সে দম আটকাবে এবারে। থামবেন না তো প্লিজ!
ইউসুফ: হা হা! যাই হোক, ঢুকলাম তো বটে। ঢুকতেই আবারও সেই ঘোরলাগা ভাবটা ফিরে এলো, মাথা কাজ করছে না। তখন, আমি ঠিক জানি না কেন, হয়তো পোশাক, গল্প- সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়েই আমার মধ্যে অবচেতনেই একটা অন্য সত্তা তৈরি হয়েছিল, নিজেকে কেমন এক প্রেমিক ভাবতে শুরু করলাম আর মনে হতে লাগলো, আমার বহুকালের অদেখা প্রেমিকা সেখানে অভিমান ভরে অপেক্ষা করে আছে। এটুকু কেবল মনে করতে পারি, আমি বলে উঠেছিলাম, "ম্যায় আ গায়া,জুলেখা, তুমহারি আব্দুল্লাহ!" আরেকবার চিৎকার করে জুলেখার নাম ডাকলাম। তারপরেই হঠাৎ যেন পুরো প্রাসাদ জুড়ে একটা তোলপাড় হয়ে গেল, ওদিকে বাইরে সেদিনও চলছে বৃষ্টির দাপট। এই তোলপাড়টার পর যে কী হলো, আর জানি না। জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
(দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের মূল গেটে এসে থামলেন)
ইউসুফ: পরদিন ঘরভর্তি রোদের আলোয় জেগে উঠলাম, হলঘরে পড়েছিলাম। জেগে বসতেই মাথাটা ভয়ানক ভারী লাগতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ বাদে করিম খাঁ হাতে পানি নিয়ে এলো। আমায় জেগে বসতে দেখে আনন্দে বুড়ো কেঁদেই ফেললো, জড়িয়ে বললো, "সাব, আপনি যে জিন্দা আছেন তার জন্যই আল্লাহ'র দরবারে হাজার শুকরিয়া জানাই।" তার মুখেই শুনলাম, রাতে সমস্ত প্রাসাদ নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিল, আর বাইরে চলছিল মেহের আলীর অবিরাম প্রলাপ। করিম খাঁ প্রাসাদ থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে একটা ঝোপে বসেছিল, কাছে এগোতে সাহস করেনি, আর সমানে দোয়া-দরুদ পড়ছিল; মেহের আলী প্রাসাদ ঘিরে চক্কর মারছিল। প্রাসাদের ভেতর থেকে নারীকণ্ঠের হাসি, ঘুঙুর আর সেতারের আওয়াজ ভেসে আসছিল। করিম খাঁ বললো, মানুষ আনন্দে পাগল হলে যেমন হয়, সে প্রাসাদেরও সে রাতে যেন তা-ই হয়েছিল।
জয়ন্ত: (ঘোরলাগা কণ্ঠে) তারপরে?
ইউসুফ: তারপরে আর কী! সে রাতেই কলকাতার ট্রেনে চাপলাম। করিম খাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম, গতবছর তার মৃত্যুর পরেও বরীচ গিয়েছিলাম। বুঝলেন, প্রাসাদটার ভালোবাসাহীনতার ভয়াবহ ক্ষুধা ছিল, করিম খাঁ না থাকলে আমিও কোনোদিন প্রাসাদের এই সর্বনাশা ক্ষুধার গ্রাস থেকে বাঁচতে পারতাম না।
(দু'জনেই খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। রাস্তা দিয়ে কিছু কিছু ট্যাক্সি, গাড়ি ইতস্তত চলে যাচ্ছে।)
জয়ন্ত: হুম। আচ্ছা, এত সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটে গেল, কোনো চিহ্ন কী রেখে দিয়েছেন?
ইউসুফ: (মৃদু হেসে) একটি চিহ্ন তো আছেই, সেটা আমার সঙ্গে সঙ্গেই রাখি। আব্দুল্লাহ'র সেই ছবিটা।
(ইউসুফ সাহেব একটি প্রায় ছিঁড়ে আসা তুলোট কাগজ বুকপকেট থেকে বের করলেন। জয়ন্তবাবু হাতে নিয়ে দেখলেন, কাঠকয়লায় আঁকা একটি সুদর্শন তরুণের মুখের ছবি- পাতলা মোচ, মাথায় ফেজ, উজ্জ্বল চোখ, ঘন চুল।)
ইউসুফ: বুঝলেন জয়ন্তবাবু, এই ছবিটা আমাকে শুধু একটি জিনিসই মনে করিয়ে দেয়। ছবিজুড়ে নরম রোদের মত করে এক হতভাগিনীর ভালোবাসা মাখামাখি হয়ে আছে। পাকা ছবি নয়, শিল্পকলার দর দিয়ে বিচার করলে এর মূল্য হয়তো দু'টাকাও হবে না; কিন্তু মিথ্যে আশার ফেরে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকার জন্য গুলবাহারের যে আকুতি, অন্তত সেটাকে আমি নস্যাৎ করতে পারি না। তাকে যারা শোষণ করেছিল তারা মোহগ্রস্ত ছিল, আব্দুল্লাহর সাথে ভিনদেশে পাড়ি দিলেই নতুন দিন আসবে বলে যে আশা গুলবাহার করেছিল, সেই আশাও মোহগ্রস্ত ছিল, গুলবাহারের রূপে বশীভূত মেহের আলী বা অন্যরাও মোহের ফেরে পড়েই মানসিক ভারসাম্য বা জীবন হারিয়েছিল- কিন্তু, এই যে ভালোবাসা, একে অন্তত আমি মোহ বলতে পারি না। মোহ নয় বলেই হয়তো সেই মধ্যযুগ থেকে আজ অব্দি এই ছবিটা টিকে গিয়েছে!
(প্রায় মিনিটখানেক পর জয়ন্তবাবু হঠাৎ হেসে ফেললেন)
জয়ন্ত: অথচ, আমার সেই থিওসফিস্ট আত্মীয়টির সাথে আমার জন্মের মত বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। আজ ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে, কখনো কখনো অযৌক্তিক হওয়াই পৃথিবীর নীতিসম্মত। এই অপার্থিব কাহিনীতে মানবিক ভালোবাসার যে এসেন্সটা, যুক্তি-অযুক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে এটাকেই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি দরকার।
(রাত প্রায় আড়াইটা। সহজে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না বুঝে দু'জনে রাস্তা ধরে নীরবে হাঁটতে লাগলেন। শহরের আলো ছাপিয়ে রাতের তারাদের আশীর্বাদ তাঁদের মাথায় যেন চুঁইয়ে পড়তে লাগলো।)
(সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত: @ঋদভিকা পাল)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:০৮