(লেখাটি দৈনিক সমকালের ২৮ নভেম্বর সংখ্যায় ‘ ফুটবল কা¬সিক বিভাগে ’প্রকাশিত হয়েছে, আমি আমার ব্লগারন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য আবার পোস্ট করলাম )
ফুটবল অঙ্গনে তার প্রতিটি কথা ,ধ্যান ধারনা, চিন্তা-ধারার চিরচারিত প্রবাহে সাময়িকভাবে অন্য ঢেউ সৃষ্টি করে ; নতুন দর্শনের জন্ম দেয়। এ কারনেই ফুটবল বিশ্বে বিখ্যাত স্ট্রাইকার আলবের্তো ভালদানোর পরিচিতি ‘দি ফিলোসফার’ বা দার্শনিক হিসাবে। তরুন ভালদানো যখন মাঠে বল নিয়ে অসাধারন সব নৈপূন্য দেখাচ্ছিলেন তখনও যেমন এই পদবী তার চরিত্রের সঙ্গে দূর্দান্তভাবে মিলে যেত , আর এখনও যখন যিনি কোচিং বা ক্লাব সংক্রান্ত কাজে বিভিন্ন কথামালা নিয়ে মানুষের সামনে আসেন তখনও সেগুলো তার ওই ছোট্ট ডাক নামেটির সার্থকতা অবিসংবাদিতভাবে প্রমান করে।
আাবার ফুৃটবল ক্লাসিক। আবারো ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ। কেন যেন এ বিশ্বকাপটিকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া গল্পের ভান্ডার শেষই হতে চায়না । বারবার ফিরে আসে। নানান দিক থেকে ঘটনা বহুল এ আসরের আরেক নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন এই ভালদানো। সেবার আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো কাপ ঘরে তোলে আর তাদের অন্যতম সেরা ট্রাম্পকার্ড তার প্রতিভার পূর্ণ বি”ুছরন ঘটান। বিপরীতে বললে গ্র“পের প্রথম ম্যাচেই কোরিয়ার বিপক্ষে দুই গোল করে তিনি দলের বন্ধুর পথ মসৃন করে দেওয়ার মিশন শুরু করেন ।‘ হ্যা আসলেই, প্রথম ম্যাচের ওই রকম একটি ফল দলের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে দিয়েছিল’এই আজেন্টাইনের বক্তব্য। পুরো টুর্নামেন্টে তিনি অবশ্য আরও দুই গোল করেছিলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গোলটি এসেছিল ছিল জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে । ৩-২ ব্যবধানে জার্মানদের হারানোর সাফল্যে তার অবদান ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটি। অবশ্য বিশ্ব মহামিলনের চূড়ান্ত মঞ্চে অভিনীত কীর্তি সব সময়ই মহান। এর চেয়ে চিরস্মরনযোগ্য আর কিছু মঞ্চস্থ হতে পারেনা। কিন্তু দর্শনে বিশ্বাসী এই স্ট্রাইকারের জীবনে হয়েছে। যে কীর্তি তিনি গড়তে পারেন নি অর্থ্যাৎ যে বল তিনি জালে পাঠানোর সুযোগ পেতে গিয়েও পাননি সেটিই হয়ে গেছে ইতিহাস। পেয়েছে সর্বকালের সেরার মর্যাদা।
বিষয়টা একটু গোলেমেলে মনে হলেও কঠিনভাবে সত্য। ম্যারাদোনার সেই বিখ্যাত গোলটি তার পা থেকেই আসতে পারতো। অথচ পারেনি বলে কোনো আক্ষেপ অন্তত ভালদানোর মনে নেই। তার মুখ থেকেই শুনুন ‘ ‘দিয়াগো পরে ড্রেসিং রুমে নিজ মুখে বলেছে, ও নাকি ঠিক সময়ে আমাকে পাস দেয়ার জন্য ক্রমাগত সঠিক জায়গা খুজছিল। পাচ্ছিলনা দেখেই নিজেকে উদ্যোগী হয়ে ডিফেন্ডারদের ট্যাকল করে এগিয়ে গিয়েছে। জানি সবই রসিকতা । সে মোটেই আমাকে বল দেয়ার সুযোগ খোঁজেনি। তাও ভাগ্যিস্ পায়নি। নইলে আমি সেই গোল করলে তা এতটা নান্দনিক হতো না , সেটা নিয়ে এত হইচইও হতো না আর পত্র-পত্রিকায় পাতার পর পাতা ঐতিহাসিক মহাকাব্যও তৈরি হতো না।’
কথাটার মধ্যে কি একটু কি মন খারাপের আভাস পাওয়া যায় ? যেতেই পারে, কারন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ২২ ম্যাচে ৭ গোল করা এই ফুটবলারের বিশ্বকাপজয়যাত্রার এমন রাজসিক শুরু হতে পারত অনেক আগে ; ১৯৮২ সালের স্পেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে। ওই সময় রানী ইসাবেলার দেশ বলতে গেলে তার বাড়ির মাঠ। যাকে বলে হোম গ্রাউন্ড। সেখানকার ক্লাব রিয়াল জারাগোজার নিয়মিত এই সদস্যের স্থানীয় সমর্থক নেহায়েত কম নয়।এই অর্জনের সঙ্গে যোগ হলো তখন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্কোয়াডে খেলতে পাওয়ার সুযোগ। মনে মনে তিনি ভাবলেন, ‘পরিচিত পরিবেশে নিজের মাঠে নৈপুন্য প্রদর্শন করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। আমার আর কিছুই চাই না।’ কিন্তু ভাগ্য সে আশা পূরন করতে দিল কই ?
বরং হাঙ্গেরির বিপক্ষে দ্বিতীয় গ্রুপ ম্যাচে হাটু ও গোড়ালিতে মারাত্মকভাবে চোট পেয়ে ফুটবলকেই চিরতরে বিদায় জানানোর উপক্রম হয় তার। সেরে উঠার পরও আঘাতের নিদর্শন বিরাজ করেছিল বহুদিন। এমন কি চার বছর পরের বার মেক্সিকোতেও তার উপস্থিতি হয়ে উঠেছিল অনিশ্চিত। অবশ্য সব আশঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে মোট চারবার গোলাকৃতির বলকে তার যথাযথ জায়গায় পৌছে দেন। সে আসরের শীর্ষ গোলদাতাদের নামের তালিকায় মোট চার জনের সঙ্গে তৃতীয় অবস্থানে তার নাম আজও জ্বলজ্বল করে ।
পুরো ঘটনাটি ফুটবলপ্রেমীদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হলেও ভালদানোর কাছে স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন। কারন ১৯৫৫ সালের আজের্নন্টিনার সান্টোসে জন্ম নেয়া ভালদানো বুকের ভিতর এই ইচ্ছা বাসা বেধেছিল বহুদিন আগে থেকে।‘সেই ’৫৮ সালের কথা যখন তার বয়স মাত্র তিন , যেবার ব্রাজিল প্রথমবারের মতে সোনালী বিশ্বকাপটি ঘরে তোলে তখন থেকেই ইচ্ছা জাগে , একদিন আমিও কাপ জিতে দেশের মানুষকে গর্বিত করব, আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দেব’ ।
ছোটবেলায় ফুটবল নিয়েই ঘুরপাক খেত ভালদানোর ভাবনা। যদিও অন্য সব বিখ্যাত ফুটবলারের মতো তিনি ছোট্ট বেলা থেকেই বল নিয়ে মেতে থাকেন নি। নিজের ক্ষমতা বুঝতে কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে অনেক। একটু পরিনত হয়ে ১৬ বছর বয়সে প্রথমে নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজ ক্লাবের যুব দলে এবং পরে সে দলের খেলোয়াড় হিসাবেই পেশাদারদের দলে নাম লেখান। এভাবে কিছূ দিন চলার পর স্প্যানিশ লিগের দ্বিতীয় বিভাগের দল দোপর্তিভ আলাভেসের ডাক পান। বাকীটা এরপর ইতিহাস। সফল এক বীরের বর্ননা।
খেলা ছেড়েছেন তাও অনেক দিন হয়ে গেলো। এরপর অন্যান্য কাজের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবল নিয়ে দুটো বই প্রকাশ করেছেন।এর একটি স্ব লিখিত ‘ ড্রিমস অফ ফুটবল’। অন্যটির নাম ‘ফুটবল শর্ট স্টোরিজ’ ;এর লেখক অবশ্য বেশ কয়েকজন। সম্পাদনার গুরু দায়িত পালন করেছেন ভালদানো। প্রকৃত পক্ষে ফুটবল-কোচিং -ট্রেনিং-ব্যবসা-লেখালেখি সবমিলিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার মতো মানুষ একজন ভালদানো।এতটাই এসবের ব্যপ্তি যে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এখনকার রিয়াল মাদ্রিদের অধিনায়ক রাউল গঞ্জালেস তার বড় ছেলের নাম ভালদানোর সঙ্গে মিলিয়ে রাখতে পেরে গর্বিত বোধ করেন।
তবে আজও, এই ২১ বছর পরও জয় করা ট্রফি দেখে ভালদানোর মনে শিরশিরে এক রোমাঞ্চকর অনুভূত হয়, এক মনে আওড়ান সেই মহান বানী ,‘ফুটবল সকল মানুষের হয়ে কথা বলে, সবার জন্য কথা বলে, সার্বজনীন কথা বলে; এর জন্যই আমার এত প্রাপ্তি’।
নাহ্ সত্যিই ,সবার আগে তিনি একজন দার্শনিক। অন্য উচ্চতায় উনœত তার জীবন দর্শন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




