বন্ধু শব্দটির সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটে ছোটবেলা থেকেই। বন্ধুত্ব বিষয়টি মানুষের জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, এখন আলাদা করে প্রতিবছর পালিত হচ্ছে বন্ধু দিবসও। কিন্তু এই যে অনেক বন্ধু থেকে বন্ধুর পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ কি? কিংবা কেনই বা ভেঙে যায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক? কেনই বা তিল তিল করে সময় নিয়ে গড়ে ওঠা নিবিড় বন্ধুত্ব ভেঙে যায় মুহূর্তের মধ্যেই?
বন্ধুত্ব ভাঙার অনেক কারণ থেকে কিছু বাছাই করা কারণ থাকছে আজকের লেখায়।
ভৌগোলিক দূরত্ব : বন্ধুত্ব ভাঙার সবচেয়ে কমন ও গ্রহণযোগ্য কারণ হলো ভৌগোলিক দূরত্ব। পড়ালেখার কারণে, বাবার বদলির চাকরির সুবাদে কিংবা কর্মস্থান পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় অনেকেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এমনকি বিদেশেও যেতে হয়। এমন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য হয়ে ওঠে, চোখের আড়াল তো মনের আড়াল প্রবাদটি।
টাকা : অর্থই অনর্থের মূল! কথাটি বন্ধুত্বের বেলায়ও মিথ্যা কিংবা ভুল নয়। এর কারণ হলো টাকার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই ছাড় দিতে চায় না। তাই বন্ধুত্বের সম্পর্কে টাকার বিষয়টি সব সময় পরিষ্কার থাকাই শ্রেয়।
স্ট্যাটাস : কেউ স্বীকার করুক বা না-ই করুক, বন্ধুত্বে স্ট্যাটাস বড় ফ্যাক্টর। দেখা যায়, একই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশি হয়ে থাকে। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বন্ধুত্ব কম দেখা যায় বা সেটা তেমন আদর্শ বন্ধুত্ব হয়ও না, আবার ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রদের সঙ্গে শেষের সারির ছাত্রদের বন্ধুত্বও খুব একটা দেখা যায় না। হঠাৎ কোনো বন্ধুর স্ট্যাটাসে পরিবর্তন হলে বন্ধুত্বে ফাটল ধরতে পারে।
প্রেম নিয়ে দ্বন্দ্ব : এমন ঘটনা মোটেও বিরল নয়, দুজন বন্ধুর প্রেমিক বা প্রেমিকা হিসেবে পছন্দ একই ছেলে বা একই মেয়েকে। যদি দুজনের কারো অভিলাষ পূরণ হয়েই যায়, তাহলে দ্বিতীয় বন্ধুটির মন যেমন ভেঙে যায়, তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেঙে যায় প্রথম বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এমন ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্বেই দুই বন্ধু ছেলে হলে, বন্ধুত্বের কোমল সম্পর্ককে উপেক্ষা করে তা মাঝে মধ্যে পেঁৗছে যায় তিক্ত মারামারি বা কাটাকাটি পর্যন্তও। আর দুই বন্ধু যদি মেয়ে হয়, তাহলে হতে পারে তীব্র কথা কাটাকাটি, মুখ দেখাদেখি বন্ধ, এমনকি চুলাচুলি পর্যন্তও। অবশ্য উভয় ক্ষেত্রেই নিঃস্বার্থ ত্যাগ যে দেখা যায় না তা কিন্তু নয়। আবার বন্ধুত্বের জন্য প্রেম বিসর্জন দেয়ার ঘটনাও কম নয়।
স্বার্থ : এমন ঘটনাও বিরল নয়, মানুষ কেবল স্বার্থের জন্য বন্ধুত্ব করে। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধরা যাক, কারো আগামী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু লেখাপড়ায় অমনোযোগী বা অনিয়মিত হওয়ার কারণে তার কাছে নেই প্রয়োজনীয় লেকচার ও নোট। তখন তার করণীয় কী হতে পারে? সে তখন বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করে ক্লাসের ভালো ছাত্রের সঙ্গে। পরীক্ষার হলেও অনেক কম পরিচিত সহপাঠীকেও দোস্ত দোস্ত সম্বোধন করে মুখে লালা এনে ফেলা ছাত্রের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।
ইগো : কিছু মানুষের মধ্যে ইগো বিষয়টি প্রবল। তারা অল্পতেই রিঅ্যাক্ট করে। আবার অনেকেই তিলকে তাল করে দেখতে ভালোবাসে। দুজন বন্ধুর মধ্যে ছোটখাটো বিবাদ বা মনোমালিন্য হতেই পারে। কারণ সবার মানসিক গঠন, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও সহনশীলতা এক নয়। কেউ একটি বিষয় নিয়ে দেখা গেল কিছুই মনে করেনি, অন্যদিকে অন্যজন সে বিষয়টি নিয়েই মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলছে। বন্ধুত্বে এমন বিবাদ বা মনোমালিন্যে এগিয়ে এসে কথা বলার প্রবণতা, এটা অনেকের মধ্যেই নেই। এ ধরনের ইগো অবশ্যই বন্ধুত্বের সম্পর্কের অন্তরায়।
সুপিরিয়রিটি ও ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স : সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স হলো নিজেকে অন্যের তুলনায় যোগ্য, গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ভাবা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেরা ভাবা। আর ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স হলো নিজেকে অন্যের তুলনায় অযোগ্য, কম গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যহীন ভাবা। দুজন বন্ধুর মধ্যে যদি এ সমস্যার যে কোনো একটি উপস্থিত থাকে, তাহলে সেই বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখাটা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দুজনের মধ্যে যোগ্যতার বিচার চলে এলে সে সম্পর্কে আর যাই হোক ফেয়ারনেস থাকে না। একটা কথা পরিষ্কারভাবে সত্য, যোগ্যতা বিচার করে বন্ধুত্ব হয় না। সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয় সত্যিকারের মনের টানেই।
সম্পর্কের নতুন মোড় (ছেলেমেয়ের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে) : একটি ছেলে ও একটি মেয়ের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে, ছেলেটি মেয়েটির বা মেয়েটি ছেলেটির প্রেমে পড়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে কেবল বন্ধুত্বের সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া প্রেমে পড়ে যাওয়া বন্ধুটির জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় সে অনুভূতির কথা জানাতেও পারে না এ কারণে, যদি অন্যজন তাকে রিফিউজ করে, তখন বন্ধুত্বও হারাতে হবে। তার চেয়ে নীরবে ভালোবেসে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখাই ভালো। তবে ডুবে ডুবে জল খাওয়ার কথা যদি প্রকাশ পেয়েই যায়, তখন কী হতে পারে? যদি অন্যজনের সম্মতি থাকে, বন্ধুত্ব তখন হয়ে যায় প্রেম। আর যদি অন্যজন বিষয়টি না মেনে নেয়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।
আন্তরিকতা ও তাগিদের অভাব : যে কোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য অবশ্যই থাকতে হবে আন্তরিকতা ও মনের তাগিদ। বন্ধুত্ব আছে, ভালো কথা কিন্তু সেটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সেটিকে চর্চা করার জন্য বন্ধুর প্রতি যে আন্তরিকতা ও তাগিদ থাকা দরকার; সেটির অভাবেও ভেঙে যায় অনেক সম্পর্ক। একজন বন্ধু হয়তো নিয়মিতভাবে অন্যজনের খোঁজ-খবর নিচ্ছে কিন্তু অন্যজন কখনই খোঁজ নেয় না, সে ক্ষেত্রে এক সময় প্রথমজনের হতাশ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক এবং সে এটাও ভাবতে পারে, তাকে বোধহয় দ্বিতীয় বন্ধুটির আর প্রয়োজন নেই।
এখন নিশ্চয়ই বলা যায়, বন্ধুত্ব ভাঙার কারণগুলো সম্পর্কে আপনি কিছুটা হলেও অবগত। সুতরাং চাইলেই এ বিষয়গুলো এড়িয়ে আপনি পারেন বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে। একটি অপরিচিত মানুষের সঙ্গে অকৃত্রিম বিশ্বাস স্থাপন করে সত্যিকারের গভীর ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে অনেক সময় লাগে। আবার একটি সত্যিকারের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তিল তিল করে, ধীরে ধীরে।
খুব কম লোকই ভাগ্যবান, যারা জীবনে সত্যিকারের বন্ধু পায়। সবচেয়ে বড় কথা, কেন ভাঙতে দেবেন মহামূল্যবান একটি সম্পর্ককে? বন্ধুত্ব বিষয়টি সম্পূর্ণই নির্ভর করে একজন মানুষের মানসিকতা, আন্তরিকতা ও ইচ্ছার ওপর। বন্ধুত্ব সত্যিকারের হলে কোনো বাধাই বাধা নয়। এখন মোবাইল ও ই-মেইলের যুগ। ফোন নাম্বার বা ই-মেইল অ্যাড্রেস থাকলে একটি কল বা ই-মেইল পাঠিয়ে সারপ্রাইজ দিন না পুরনো বন্ধুদের। দেখুন না তারা কেমন রিঅ্যাক্ট করে এতদিন পর আপনার স্পর্শ পেয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ২:৫০