সৌদি আরবে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশ থেকে গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে এই রোহিঙ্গারা। পরে তারা জেদ্দার বাংলাদেশ দূতাবাসে দালালদের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে হাতিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট। তাদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এর দায় এসে পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। সৌদিপ্রবাসীদের অভিযোগ, দেশটিতে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা আছে, যাদের হাতে এখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট।
২৬ জানুয়ারি সৌদি আরবে বসবাসরত জেদ্দা ও মক্কা সমিতির প্রবাসী বাংলাদেশিরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির কাছে ফ্যাক্সের মাধ্যমে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছেন। দুই পৃষ্ঠার স্মারকলিপিতে দালালদের দৌরাত্ম্য দ্রুত বন্ধের দাবি জানানো হয়। এই স্মারকে সই করেন সৌদি আরবে জেদ্দা সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম ও মক্কা সমিতির সভাপতি আবদুল গাফ্ফারসহ শতাধিক প্রবাসী ব্যবসায়ী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, সৌদি আরবে রিয়াদ দূতাবাসের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এই স্মারকের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে সৌদি আরবের কারাগারে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী মিয়ানমারের ৬০০ রোহিঙ্গা নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে কূটনৈতিক চাপের মুখে রয়েছে সরকার। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, জেদ্দার তারহিল ক্যাম্পে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা আটক রয়েছে।
গত জানুয়ারিতে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে একটি চিঠি দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই স্বরাষ্ট্রসচিবের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয়ের একটি সভা হবে। ওই সভায় বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বেগম শামসুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য এখন একটি বড় সমস্যা। জনশক্তি রপ্তানি বন্ধের পেছনে তারা একটি বড় কারণ। সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও আইন মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। শিগগিরই এ সমস্যা সমাধানের একটা উপায় বের করা হবে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের নিয়ে এখন অনেক নেতিবাচক কথা হচ্ছে। এর অন্যতম একটি কারণ বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গারা। তাদের সব অপরাধের দায় বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ধরে রাখার স্বার্থেই বিষয়টির দ্রুত সুরাহা হওয়া উচিত।
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের আসা শুরু হলে তাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে চলে যায়। বেসরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশটিতে ৫০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গা রয়েছে। তারা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে বলে দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সত্যি, সৌদি আরবে অনেক রোহিঙ্গা আছে, যারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে গেছে। এর কারণও আছে। মিয়ানমার থেকে যখন বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে, তখন সরকার ভেবেছিল, এরা যদি সৌদি আরব চলে যায় তাহলে দেশের জন্যই ভালো। চাপ কমবে। কিন্তু এখন এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিগগির বিষয়টির সুরাহা না হলে সৌদি আরবের শ্রমবাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অনেক রোহিঙ্গা অবৈধভাবে সৌদি আরবে চলে গেছে, বিষয়টি তিনিও জানেন। তবে এই সংখ্যা কত বা এর সঙ্গে কারা জড়িত, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
দালালদের সহায়তা: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সৌদিপ্রবাসীদের স্মারকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথে ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন পন্থায় সৌদি আরবে ঢুকে পড়ে। অনেকে গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে এসে থেকে যায় এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট তুলে বাংলাদেশি নাগরিক সেজে নানা সুবিধা আদায় করছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ২১ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। বাংলাদেশ দূতাবাস হচ্ছে প্রবাসীদের একমাত্র অভিভাবক প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি এই দূতাবাস দালালদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দূতাবাসের চারপাশে হোটেল, মক্তব, গ্রন্থাগারগুলোয় দালালেরা আড্ডা জমায় এবং প্রকাশ্যে চার-পাঁচ হাজার সৌদি রিয়ালের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। আর বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে জানানোর পরও দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হচ্ছে না।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, দূতাবাসের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে দালাল মুজিব, দেলোয়ার, মামুন, আজহার, জালাল, দুলাল, বশির, মোর্শেদের ঘনিষ্ঠ সখ্য রয়েছে। দালালেরা দূতাবাস, দূতাবাসের পাশের গলি, আশপাশের সুপার মার্কেটে আড্ডা জমায় এবং দূতাবাসের কিছু কর্মচারীর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করে।
সৌদিপ্রবাসীদের চিঠিতে জানানো হয়, দূতাবাসের পাশেই দালাল নাজিমের ভাড়াবাসা ও মক্তব। রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়ে এই নাজিম লাখ লাখ সৌদি রিয়ালের মালিক হয়েছেন। টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতিয়ে নিচ্ছে।
সাব্বির আহমেদ নামের সৌদিপ্রবাসী একজন বাংলাদেশি প্রথম আলোকে বলেন, দালালেরা দূতাবাসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে আলাপ সেরে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আজহারের মাধ্যমে টাকার লেনদেন করে। দালালদের শায়েস্তা করতে গিয়ে বিপদে পড়েন দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা। তাঁদের উল্টো বদলি করানো হয়।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের মক্কা সমিতির সভাপতি আবদুল গাফ্ফার প্রথম আলোকে জানান, পাকিস্তান থেকে আসা মিয়ানমারের মংডু শহরের হেফজুর রহমানের ছেলে আনিসুর রহমানকে সম্প্রতি পাঁচ হাজার সৌদি রিয়ালের বিনিময়ে একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করে দেন দালাল দেলোয়ার। ২২ জানুয়ারি দালাল মুজিব শুক্কুর নামের আরেক রোহিঙ্গাকে পাঁচ হাজার রিয়ালের বিনিময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার সময় সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। শুক্কুর এখন কারাবন্দী থাকলেও দূতাবাসের এক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে দালাল মুজিব রক্ষা পান।
প্রবাসী বাংলাদেশি নজির আহমদ ও আলী হোসেন ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ভারত ও পাকিস্তান হয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা এত দিন মিয়ানমারের শরণার্থী পরিচয় দিয়ে সৌদি সরকারের সহানুভূতি আদায় করে বাংলাদেশিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। এখন সৌদি সরকারের মনোভাব পরিবর্তন হলে রোহিঙ্গারা কৌশলে পাসপোর্ট আদায় করে বাংলাদেশি সেজে নানা সুবিধা আদায় করছে।
জেদ্দার বাংলাদেশ দূতাবাসের কনসাল জেনারেল গোলাম সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, দূতাবাসকে ঘিরে কিছু দালাল আছে, এটি মিথ্যা নয়। তবে দূতাবাসকে দালালমুক্ত রাখার চেষ্টা চলছে, যাতে অবৈধভাবে কেউ পাসপোর্ট না পায়
সুত্রঃ প্রথমআলো
তারিখ: ১৮-০২-২০১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




