গতবার ছিলো সৌদিয়া এস আলম, এবার ঠিক তার পাশের সৌদিয়া। একটা ভলভো, আরেকটা একেবারে নন এসি। মানসিকতার উন্নতি নাকি অর্থনৈতিক অবনতির দোষ দিব, বোঝা যাচ্ছে না।
যদিও আমার নন এসিই ভালো লাগে, কিন্তু কেন জানি এবার উঠে নিজের হঠাৎ উদ্ভুত অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণেই হয়ত মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
আমার আবার উলটো অভ্যাস আছে,বদভ্যাস বলা যায়। মন খারাপ হলে সেটাকে আরো খারাপ করে দেয়াটা আমার চরিত্রের মাঝেই পড়ে যাচ্ছে। তাই iPOD এ “নয়নতারা” ছেড়ে সীটটা এলিয়ে বসলাম।
পাশের সীটে এক মহিলা, কোলে ৯-১০মাস বয়সী শিশু। ছেলে না মেয়ে বুঝতে পারছি না। এই বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমার বরাবরই এই সমস্যাটা হয়।
বাচ্চা থেকে চোখ সরিয়ে গানে যে মন দেবো, তাও পারছি না। বাস ছাড়ছে না।
ফাঁকে একটা পেপার কিনে নিলাম।
রাস্তায় একটা বুড়ো লোক ভিক্ষা করছে দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত লাগে মাঝে মাঝে, ৪০টা বছর পার হয়ে গেলো দেশটার, এখনো সেই মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম ভিক্ষায় ব্যস্ত।
আমাদের প্রজন্মটাই মনে হয় ভালো আছে, যুদ্ধও দেখিনি, শুধু শুনেই যাই,পড়েই যাই, তাও আবার এক সরকারের আমলে একেক রকম- আর লাফাই।
কোন ত্যাগও করি নাই, শুধু ভোগ।
বাসের ভেতর থেকে একজন মুখ খারাপ করে গালি দিলো, সাথে সাথে দেখি বাস স্টার্ট নিলো। আজকাল এই এক নিয়ম, ড্রাইভার শ্রেণী ভদ্র কথায় কান দিতে চায় না।
যাক, এবার আমি সুমনে মন দিতে পারি।
“সন্ধ্যা হলো, সন্ধ্যা হলো, কখন তুমি আসবে বলো?”
পেপারটা পড়া দরকার, ৮টা টাকা তো আর পানিতে ফেলতে পারি না।
প্রথম পৃষ্ঠায় সেই যথারীতি রাজনীতির কেঁচাল, পাতা উল্টাতে যাব, এমন সময় নিচে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো। দুটি অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে, ভাই-বোনই হবে মনে হচ্ছে, একটা রিকশায় বসে আছে আর মুখ বিকৃত করে কাঁদছে।
ভিতরে পড়া শুরু করলাম।
যা বুঝলাম, এই দুইজন ৮-৯ বছর বয়সী ছেলে মেয়ে দোকান থেকে কিছু একটা নিয়ে দৌড় দেয়। পরে দোকানদার সহ জনতা তাদের ধরে মোটামুটি ভালো উত্তম-মধ্যম দেয়।
গান থেকে ততক্ষণে মনযোগ উঠেই গেসিলো, এবার এয়ারফোনটাও সরিয়ে নিলাম।
বাইরে তাকালাম,বাতাসটা বেশ ভালো। ভালোই লাগছে মোটামুটি।তবে মাথাটা কেমন জানি জ্যাম জ্যাম মনে হচ্ছে।
দোষটা আসলে কাকে দেবো? চুরিকে?
যদি চুরিকে দোষ দিতে হয়, তাহলে কিছুটা দায় নিজের কাঁধেও এসে পড়ে। একটা ৮-৯ বছরের বাচ্চা কেন চুরি করবে? হতে পারে অভাবের তাড়নায়, হতে পারে এটা সামাজিক অবক্ষয়ের একটা উদাহরণ।
যেটাই হোক না কেন, দোষটা তো আমার, আমাদের। তাকে কি দোষ দিব?
কিন্তু কথা সেটা নয়, এতগুলো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ,যাদের অনেকের ঘরেই এই বয়সী ছেলে মেয়ে আছে, এভাবে মারতে পারলো কিভাবে?
মানছি, তারা চোর। তাদের তো আর ধরে চুমু খাওয়া যায় না,শাস্তি দিতে তো হবেই।
তাই বলে এভাবে? এতগুলো মানুষ এভাবে মারতে হবে?
এরাও মানুষ !!
ভেজা চোখটা নিয়ে পাশের সীটের বাচ্চাটার দিকে তাকালাম, সে দেখি আমার দিকে তাকিয়েই ছিল।
মনে হয় এমন সার্কাস বেচারা আর দেখে নাই, একটা মানুষ হঠাৎ এভাবে বিনা কারণে এই অবস্থা শুরু করলো কেন?
তার অপার বিস্মিত চোখে তাকিয়ে মনে মনে বলে ফেললাম,
“বাপ, জীবনে হয় মানুষ হইস, নয় অমানুষ। আমার মত মাঝামাঝি কিছু একটা হতে যাইস না। মানুষ কিংবা অমানুষ দুটোর মধ্যেই মজা আছে, মাঝামাঝি হলে আজীবন শুধু আমার মত সার্কাসই দেখাবি।“
পিচ্চি দেখি চোখ পিটপিট করলো, যেন সবই সে বুঝে ফেললো।
হতাশার মাঝেও হেসে ফেললাম। একটু আতঙ্কিতও হলাম-
যেই কথা বাঙ্গালি জন্মের ৪০ বছর পরও বুঝলো না, তুই ৯ মাসে বুঝে গেলে কেমনে হবে !!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




