অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণ শুরু করায় ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে তান্ডব চালিয়েছে যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা মেয়র এম মনজুর আলমকে অবরুদ্ধ করে রাখে। নগর যুবলীগ যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদ মাহমুদের নেতৃত্বে দু’শতাধিক নেতাকর্মী মঙ্গলবার বিকালে এ ঘটনা ঘটায়। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা প্রথমে কর্পোরেশন ভবন ঘেরাও করে মেয়রের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। এরপর তারা জোরপূর্বক গেট খুলে মেয়রের কে প্রবেশ করে মেয়রকে বিকাল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত দু’ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় নেতাকর্মীদের বাধা দেয়ায় তারা কর্পোরেশনের কর্মচারিদের মারধর করলে ৫ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে রয়েছেন মেয়রের গানম্যান পুলিশ কনস্টেবল মো. রকিব, অফিস সহকারি ফারুক আহমদ, মোহাম্মদ ইসকান্দর, মোহাম্মদ ইসমাইল ও মঞ্জুরুল ইসলাম। অন্যদিকে যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে যাওয়া এমইএস কলেজ কেন্দ্রিক ছাত্রলীগ কর্মীরা মেয়রের করে বাইরে গেটে লাথি মারে। তারা ম্যাজিস্ট্রেটের করে চেয়ার ভাংচুর করে। এ ঘটনায় সিটি কর্পোরেশনে চরম আতংক সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগ যুবলীগ ক্যাডাররা মেয়র মনজুকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে বলে পুরো নগরীতে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। মেয়রের কার্যালয় ঘিরে রাখা বিুব্ধ নেতাকর্মীরা আরো মারমুখি হয়ে উঠলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হয়ে কর্পোরেশনে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আরো ফোর্স পাঠানোর জন্য উর্ধতন কর্তৃপকে জানায়। খবর পেয়ে সিএমপির কোতোয়ালী জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার (এসি) শাহনেওয়াজ খালেদ এবং ওসি গাজী শাখাওয়াত হোসেন শতাধিক পুলিশ নিয়ে দ্রুত কর্পোরেশনে ছুটে যান। এদিকে মেয়রকে আটকে রাখার খবর পেয়ে মহানগর ছাত্রদলের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী একটি বিশাল মিছিল নিয়ে কর্পোরেশনের সামনে আন্দরকিল্লা মোড়ে অবস্থান নেয়। তারা ‘মনজু ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে, যুবলীগের গুন্ডারা হুশিয়ার সাবধান’ বলে শ্লোগান দিতে থাকলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। কয়েকজন ছাত্রদল নেতা এ সময় দ্রুত মেয়রের কে গিয়ে অবস্থান নিলে যুবলীগ নেতাকর্মীদের সাথে তীব্র বাকবিতন্ডা হয়। পরে পাঁচটার দিকে যুবলীগ নেতাকর্মীরা কর্পোরেশন থেকে চলে গেলে পুলিশ পাহারায় মেয়র মনজুর আলম নিজ বাসায় চলে যান।
ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, নগরীর অবৈধ ও অননুমোদিত বিলবোর্ড অপসারণকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার থেকে সিটি কর্পোরেশন নগরীর সব অবৈধ বিলবোর্ড ও স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযান শুরু করে। ম্যাজিস্ট্রেট সালেহ আহমেদের নেতৃত্বে অভিযানকারি দল দুপুরে নগরীর টাইগারপাসে অবৈধভাবে নির্মিত বেশ কিছু দোকানপাট হোটেল উচ্ছেদ করে। এরপর ষোলশহর ২ নম্বর গেটে কবরস্থানের পাশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপিত অবৈধ পাঁচটি বিলবোর্ড অপসারণ করে। এতেই ক্ষেপে যান নগর যুবলীগের দু’নেতা মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং ফরিদ মাহমুদ। এরা দু’জনই বিলবোর্ডের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মহিউদ্দিন বাচ্চুর প্রতিষ্ঠানের নাম অ্যাড ভ্যালি এবং ফরিদ মাহমুদের প্রতিষ্ঠানের নাম স্কাই আর্ট। এরা একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছে। এটির নাম চট্টগ্রাম আউটডোর এডভার্টাইজিং ওনার্স এসোসিয়েশন। তারা জানান, এ সংগঠনের সদস্য প্রায় একশ’ জন। এরা নগরীতে বিলবোর্ড ভাড়া দিয়ে থাকে।
জানা যায়, সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন নেয়া বৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা ১৭৬৪ টি। যা থেকে বছরে কর্পোরেশনের আয় হয় ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। কিন্তু নগরীতে বিলবোর্ডের সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি। এর অধিকাংশই অবৈধ এবং অননুমোদিত। পুরো নগরী ছেয়ে গেছে অবৈধ বিল বোর্ড এবং সাইনবোর্ডে। সরকারি দলের নাম ভাঙ্গিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতা এই বিলবোর্ড বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন করেন। কর্পোরেশনের অনুমোদন ছাড়াই অবৈধ বিলবোর্ড ভাড়া দিয়ে এরা বছরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। জানা গেছে, মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালীন সময় বিলবোর্ড বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন করতেন তার এক ভাগ্নে। আর এই সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন দলের বেশ কয়েকজন নেতা। মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র না থাকলেও আওয়ামী লীগ মতায় থাকার সুবাধে এরাই এখনো বিলবোর্ড বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। এদিকে আসন্ন বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলে চট্টগ্রামে বিলবোর্ড অপসারণের ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ জন্য লাখ লাখ অবৈধ ও অননুমোদিত বিল বোর্ড অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় সিটি কর্পোরেশন। মঙ্গলবার অপসারণ শুরুর প্রথমদিনেই বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে দলবল নিয়ে কর্পোরেশন ভবনে তান্ডব চালায়।
প্রথমে তারা ম্যাজিস্ট্রেট শেখ সালেহ আহমেদের কে গিয়ে তার সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে এবং চেয়ার ভাংচুর করে। পরে দোতলায় গিয়ে মেয়রের অফিসের স্টাফদের মারধর করে গেটে লাথি মারতে মারতে মেয়রের কে ঢুকে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। অফিসের কর্মচারিরা জানান, তাদেরকে মারধর করতে দেখে মেয়র মনজুর আলম এক পর্যায়ে বলেন, ‘তোমরা শুধু শুধু মার খাবে কেন, ওদেরকে আসতে দাও, মারলে আমাকে মারুক।’ এ সময় যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং ফরিদ মাহমুদের নেতৃত্বে হুড়মুড় করে অর্ধ শতাধিক নেতা কর্মী মেয়রের কে ঢুকে তাকে ঘেরাও করে ফেলে। এ সময় উভয় পরে মধ্যে তীব্র বাকবিতন্ডা হয়।
পরে সংবাদ কর্মীরা খবর পেয়ে পরিস্থিতি দেখতে মেয়রের কক্ষে প্রবেশ করলে ক্ষুব্ধ যুবলীগ কর্মীরা শান্ত হয় এবং মেয়রের সঙ্গে সমঝোতামূলক আলোচনা শুরু করে। মেয়র মনজুর আলম সাংবাদিকদের বলেন, যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তা কারো কাম্য নয়। তবে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ ধারন করেনি। অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণ এবং বৈধ বিলবোর্ডের বকেয়া কর আদায়ের ব্যাপারে ভুল বোঝাবুঝি থেকে এ ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার উভয়পক্ষ বৈঠকে বসে গ্রহনযোগ্য সমাধান করা হবে। তবে অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ অভিযান চলবে।
চট্টগ্রাম আউটডোর এডভার্টাইজিং ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও নগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদ মাহমুদ বলেন, অবৈধ বিলবোর্ড থাকলে তা উচ্ছেদ হতেই পারে। কিন্তু অভিযানের আগে কোন নোটিশ দেয়া হয়নি। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারনে এ ঘটনার উদ্ভব হয়েছে। মনজুর আলম নির্বাচিত মেয়র, তাকে সম্মান করি। তাকে হেনস্তা করার কোন উদ্দেশ্য কারো ছিল না। তাদের সঙ্গে দু’শতাধিক কর্মী নিয়ে আসা এবং বাইরে স্টাফদের মারধর ভাংচুর গেটে লাথি মারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাইরে অপেমানরাও ছোটখাট বিলবোর্ডের ব্যবসা করে। তবে ওরা কাউকে মারধর করেনি।
এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা নগর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, লোক সমাগম বেশি হয়েছে বলে একটু ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। কাউকে শুভেচ্ছা জানাতে বা স্মারকলিপি প্রদান করতে গেলেও এরকম হয়। তিনি জানান, বিলবোর্ডের কর বাবদ বকেয়া ৪৭ লাখ টাকা পরিশোধ করে দেয়া হবে। এ নিয়ে মেয়রের সঙ্গে সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে। এ সময় মেয়রের কক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন রিলেশন অ্যাডের মো. মনির, অ্যাড ওয়ে এর শাহীন, কাসিক অ্যাডের এসএম শহীদ সুমন, অ্যাড গার্ডেনের সনদ বড়ুয়া, নগর ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক আরশেদুল আলম বাচ্চুসহ অন্তত ৪০/৫০ জন নেতাকর্মী।
বাইরে অপেমান নেতাকর্মীরাও দল বেধে মেয়রের কে জোরপূর্বক ঢুকতে চাওয়ায় পুলিশ ও কর্পোরেশনের নিরাপত্তাকর্মীরা এক পর্যায়ে মূল গেট বন্ধ করে দেয়। এ সময় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে গেটে লাথি মারতে থাকে। মেয়রের কক্ষের বাইরে সরু গলিতেও অবস্থান নেয় অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী। বিকাল পৌন পাঁচটার দিকে চট্টগ্রাম নগর বিএনপি সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি ও ছাত্রদলের একটি মিছিল কর্পোরেশন ভবনের সামনে আসলে উভয়পরে মধ্যে সংঘর্ষের আশংকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয়। মিছিলটি আন্দরকিল্লা মোড়ে অবস্থান নিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। তারা মেয়র মনজুকে অবরুদ্ধ করে রাখার প্রতিবাদ জানায়। মিছিলে আরো উপস্থিত ছিলেন নগর ছাত্রদল সভাপতি মোশাররফ হোসেন দীপ্তি, সাধারণ সম্পাদক আহমেদুল আলম রাসেল, যুগ্ম সম্পাদক শাহেদ আকবর, কামরুল ইসলাম প্রমুখ।
ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা মিছিল থেকে বেরিয়ে কর্পোরেশনে মেয়রের কে প্রবেশ করে কারা কারা মনজুর আলমকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে জানতে চাইলে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে ফের বাকবিতন্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে যুবলীগ নেতাকর্মীরা মিছিল করে মেয়রের ক থেকে বেরিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময়ও তারা পুলিশের উপস্থিতিতে মেয়রের অফিস করে গেটে লাথি মারে। পরে বিকেল পাঁচটায় পুলিশ প্রহরায় মেয়র মনজু কর্পোরেশন ভবন ত্যাগ করে বাসায় চলে যান। এ সময় তার গাড়িতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী ও এমএ মালেক, ছাত্রদল নেতা শাহেদ আকবর ছিলেন।
ঘটনা প্রসঙ্গে কোতোয়ালী জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণ শুরু করায় ুব্ধ হয়ে যুবলীগ নেতাকর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়ায় কর্পোরেশনে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে খবর পেয়ে আরো ফোর্স নিয়ে তিনি ও থানার ওসি কর্পোরেশনে ছুটে যান। বাকবিতন্ডা হলেও মেয়র লাঞ্চিত হননি এবং স্টাফদের মারধরের ব্যাপারেও মেয়র কোন অভিযোগ দেননি বলে এসি শাহনেওয়াজ জানান।
সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট শেখ সালেহ আহমদ জানান, দু’নম্বর গেটে যে পাঁচটি বিলবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে তার সবগুলোই অননুমোদিত এবং খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ৩৩ হাজার বোল্টের বিদ্যুৎ লাইনের সঙ্গে এসব বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। অপসারণের আগে নোটিশ প্রদান, গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশসহ সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল বলে তিনি জানান।
এ ঘটনায় সরকারের কি প্রতিক্রিয়া হয়, তাই এখন দেখার বিষয় ।