দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই হিটলার যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করলেন এবং এরপর ফ্রান্স দখল করে নিলেন তখন ইউরোপবাসীর টনক নড়ে উঠলো। শান্তির ইউরোপে রক্ত কেন? সে সময়ের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ফ্রান্সের লেখক এইমে সিজার (Aimé Césaire) তাঁর বিখ্যাত ‘ডিসকোর্স অন কলোনিয়ালিজম’ (Discourse on Colonialism) বইয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, হিটলার এমন কী কী করেছেন যা ইউরোপের দেশগুলো শত শত বছর ধরে আফ্রিকার দেশগুলোতে করেনি? বর্তমান আওয়ামী সরকারের কর্মকান্ড দেখে আমার মনেও প্রশ্নের উদয় হয়, আওয়ামীলীগ কী কী করেছে যা জামাতিরা সরকারে থাকতে করেনি?
কিন্তু আমরা কেউ কেউ সেসব ভুলে যাই, কেউ কেউ জানিও না। না জানাটা অবশ্য জামাতিদের রক্তে। না জানার কারণেই তারা জামাতি। পরিচিত এক জামাতির সাথে আলাপের এক ফাঁকে বললাম, জামাতিদের জীবনদানকারী জিয়া ক্ষমতা দখল করার পর সংসদে ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করেছিল সেটা সম্পর্কে সে কতটুকু জানে। সে স্বীকার করলো কিছুই জানে না। যারা জানেন না তাঁদের জন্য বলি। জিয়ার এই আইন অনুয়ায়ী পচাত্তুরের আগের কোন হত্যাকাণ্ড যেমন, একাত্তুরের গণহত্যা, বঙ্গবন্ধু ও জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার কোন বিচার হতে পারবে না। জামাতি ভাইটি অবাক হয়ে গেল।
জামাতিদের সাথে আমাদের পার্থক্য এই যে, আমরা যেকোন অন্যায় অবিচার দেখলে, সে আমাদের প্রিয় সরকার করলেও আমরা প্রতিবাদে শামিল হই। ভ্যাট, কোটা আর সর্বশেষ কিশোর বিদ্রোহে আমরা সমর্থন দিতে কার্পণ্য করিনি। যদিও আমাদের পছন্দের সরকার এর কোনটিই ভাল চোখে দেখেনি। কিন্তু খেয়াল করে দেখেন, হেফাজত গণজাগরণমঞ্চের কর্মীদের হত্যা করার ঘোষণা দেয়ার পর একে একে প্রায় ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তখন আজকের প্রতিবাদে যে জামাতিরা আমাদের পাশে পাচ্ছে, তখন আমরা তাঁদের পাইনি। বরং হত্যার সমর্থনের তাঁদের লেখাজোখা দেখেছি। সর্বধর্মের অনুসারীদের নিয়ে একটি সমন্বয়বাদী সমাজের স্বপ্ন দেখা এই আমাদের এক বিপদ। প্রায় সব দেশেই তারা সংখ্যালঘু। মায়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে যে গুটিকয় বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ প্রতিবাদ করে, অবজ্ঞাভরে তাঁদের নাস্তিক মুসলিমপন্থী ডাকা হয়। একই কথা খাটে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের বেলায় যারা নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে দাঁড়ায়।
কিন্তু এত কিছু বলেও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তটস্থ সরকারের কিশোর বিদ্রোহ দমনের পন্থা নিয়ে সমালোচনা করা থেকে আমরা বিরত থাকতে পারিনা। সরকারের পুলিশ এতই কম পড়েছে যে বাড়তি হেলমেটওয়ালাদের ভাড়া করতে হয়। কিছু গুজব সত্বেও সেসব ছাপিয়ে শিশুদের যে রক্ত আমরা ঝরতে দেখেছি, আওয়ামী সরকার যেন মনে রাখে এই আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি, প্রতিবিন্দু রক্ত থেকে ফিনিক্স পাখির মত প্রতিবাদী আঠারোর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলবে।
এই আন্দোলন নিয়ে শেষ এই লেখায় সিনেমার এক্সট্রা বাংলাদেশের জামাতিদের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলতে চাই। জামাতিরা যেভাবে গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকে সরকার পতনের দিকে নিয়ে যেতে গিয়ে আন্দোলনকে পথহারা করেছে তাতে আমার কবিগুরুর ‘ক্যামেলিয়া' কবিতার কথার মনে পড়ে যায়। এ কবিতায় নায়ক গোপনে ভালবাসে কমলা নামের এক মেয়েকে। মেয়ের পিছু পিছু কোলকাতা থেকে দার্জিলিং যায় সে। সেখানে এক বন্ধু থেকে একটি ক্যামেলিয়া ফুলের টব উপহার পেয়ে সে ভাবে এই গাছের ফুল দিয়েই কমলাকে প্রেমের প্রস্তাব দিবে। দিন যায় আর জলপানি দিয়ে সেই গাছের যত্ন নেয় নায়ক। বহু প্রতীক্ষার পর একদিন ফুল ফোটে। তাঁর বাসায় কাজ করে এক সাঁওতাল মেয়ে। এই মেয়েকে দিয়ে সে ফুল কমলার কাছে পাঠাবে। তাই সাঁওতাল মেয়েটিকে ডাকল সে। মেয়েটি এসে বলল, 'বাবু, ডেকেছিস কেনে।’ নায়ক তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখে সেই ক্যামেলিয়া ফুল সাঁওতাল মেয়ের কানে, তাঁর কালো গালের উপর আলো করেছে। এত যত্নের এত আকাঙ্ক্ষার ফুলের এই পরিণতি দেখে নির্বাক নায়ক মনের দুঃখে দার্জিলিং থেকে কলিকাতায় ফিরে আসে।
জাহিদ কবীর হিমন
আখেন, জার্মানি থেকে
১১ আগস্ট ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৭:০০